শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

প্রবাসী নিলুফার ‘স্বদেশি’ স্বপ্ন

আসাদুজ্জামান লিমন
প্রকাশিত: ০৮ মার্চ ২০২২, ০৯:১৬ এএম

শেয়ার করুন:

প্রবাসী নিলুফার ‘স্বদেশি’ স্বপ্ন

দেখতে ফর্সা। গোলগাল মুখমণ্ডল। চোখের মনি ধুসর। মাথায় আরব রমনীদের হিজাব। বেশভূষায় মনে হচ্ছে আরবের নারী। ইংরেজিতে তার কাছে জানতে চাওয়া হলো ‘আর ইউ অ্যারাবিয়ান’? প্রশ্ন শুনে ভ্রু কুঁচকে গেলো মধ্যবয়সী ওই নারীর। ইংরেজির অ্যাকসেন্টে জবাব দিলেন, ‘নো, আই অ্যাম বাংলাদেশি’। উত্তর শুনে দ্বিধায় পড়তে হলো।

দ্বিধার বিষয়টি বুঝতে পেরে তিনি নিজে থেকেই এগিয়ে এলেন। বাংলায় বললেন, ‘আমি সাড়ে ছয় বছর সৌদি আরব ছিলাম’। উত্তর শুনে বললাম ‘আচ্ছা, তাই। ভেবেছিলাম আপনি হয়তো আরবের নারী হবেন।’ স্মিত হেসে বললেন, ‘আরব দেশ থেকে এসেছি তো। সেজন্য তাদের পোশাকেই সেজেছি। আমি আরবিও জানি।’


বিজ্ঞাপন


প্রশ্নকর্তার মনের অবস্থা ওই নারী মনে হয় বুঝতে পেরেছিলেন। তাই বললেন, ‘সৌদিরাও আমাকে তাদের দেশের মানুষ ভাবতেন।’ এ কথা শুনে বুজলাম আমার ধারণাও অমূলক ছিল না।

কথায় কথায় জানা হলো তার নাম। মধ্যবয়স্ক ওই নারীর নাম নিলুফা শিকদার। বললেন, সপ্তাহখানেক আগে দেশে এসেছেন। তার এক আত্মীয়ের বাসায় বসে কথা হচ্ছিল। খাটে হেলান দিয়ে তিনি বসেছিলেন। মুখোমুখি চলছিল আলাপচারিতা। তার দিকে মনোনিবেশ করতে চোখে পড়ল তার সৌখিনতার ছাপ। হাতের আঙ্গুলে বেশ কয়েকটি আংটি পরেছেন। হাতে শোভা পাচ্ছে ঘড়িও। বালিকাদের মতো মাথা দুলিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন। মনে হচ্ছিল তিনি আর পাঁচটা সাধারণ বাঙালি বধূর মতো নন। অন্যদের চেয়ে তিনি খানিকটা আলাদা। যদিও তার চোখে তখনো ভ্রমণের ক্লান্তির ছাপ ছিল।

nari laborকৌতুহল বাড়ে তার সম্পর্কে। মাথায় একটার পর একটা প্রশ্ন সাজাই। জানতে চাই তার সম্পর্কে। প্রশ্নবানে জর্জরিত হন। বলেন, ‘কোনটা রেখে কোনটার উত্তর দেবো। তার চেয়ে আমিই আমার জীবনের কাহিনি বলি। সবটা শুনে আপনার যদি আরও কিছু জানার থাকে তবে প্রশ্ন করবেন।’

উত্তরটা ভালো লাগে তার। বেশ বুদ্ধিদীপ্ত মনে হলো তাকে। ওই রমনীর দিকে খানিকটা ঝুঁকে মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকি জীবনের গল্প। গল্প শুনছিলাম আর মোবাইল ফোনে নোট নিচ্ছিলাম।  

হতাশা জড়ানো কণ্ঠে বলছিলেন তার সংগ্রামী জীবনের কথা। বোঝা গেলো বেশ গুছিয়ে বলতে পারেন। কথায় জড়তা নেই। নেই সংকোচও। বেশ কয়েক বছর বিদেশ-বিভূঁয়ে কাটিয়ে ভদ্রতা, সৌজন্যতাও বেশ রপ্ত করেছেন। তার কথাগুলো হৃদয়গ্রাহী ছিল। মনোযোগ দিয়ে তার সব কথা শুনছিলাম আর নোট নিচ্ছিলাম।

nari laborনিলুফা জানান, বয়স তার ৪২। কিন্তু তাকে দেখে মনে হয় বয়স ৩০ এর বেশি হবে না। তবে তার স্বাস্থ্যভালো। উচ্চতা মাঝারি। কথা বলার ফাঁকে দুম করে প্রশ্ন করি, ‘আপনি কি বিবাহিতা?’ প্রশ্ন শুনে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠেন। বলেন, ‘আমি দুই সন্তানের জননী।’

শুনে অবাক হতে হয়। নতুন করে প্রশ্ন না করে শুনতে থাকি। আমার কথায় তার কথার মাঝে ছেদ পরে। খানিকক্ষণ চুপ থেকে আবার শুরু করেন।

শুনছিলাম তার গল্প। যার সারমর্ম এমন-নিলুফার বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জে। ২০০০ সালে নোয়াখালীর বাসিন্দা মাসুদের সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রী মিলে থাকতেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার তারাবোতে। সেখানকার একটি তৈরি পোশাক কারখানায় এই দম্পত্তি চাকরি করতেন। ভালোই চলছিল তাদের নতুন জীবন। কিন্তু দুজনের যা উপার্জন হতো তা দিয়ে সংসার চলতে হিমশিম খেতে হয়। তাই নিলুফার স্বামী মাসুদ গাড়ি চালানো শিখে চাকরি নেন। এতে তাদের কিছুটা স্বচ্ছলতা ফেরে। কিন্তু বেশিদিন গাড়ি চালাতে পারেনিনি তিনি। অস্থির স্বভাবের হওয়ায় মাসুদ কোনো চাকরিতেই খাপ-খাওয়াতে পারছিলেন না। এরই মধ্যে তার মাথায় বিদেশে যাওয়ার ঝোঁক চাপে। সেজন্য ইলেকট্রিকের কাজ শেখেন।

নিলুফা তৈরি পোশাক কারখানা থেকে যা আয় করতেন তার খানিকটা জমিয়ে স্বামীর হাতে তুলে দেন। যাতে বিদেশে যেতে পারেন। কিছুদিনের মধ্যেই মাসুদ সিঙ্গাপুরে চলে যান।

ঘটনাটা ২০০৪ সালের। স্বামী বিদেশে যাওয়ার আগেই পৃথিবীতে আসে তাদের প্রথম সন্তান রাহাত। স্বামী বিদেশ, আর্থিক অনটন ঘুঁচবে সেই আমায় পোশাক কারখানার চাকরি ছেড়ে ছেলে নিয়ে নোয়াখালিতে শ্বশুর বাড়িতে ওঠেন।

nari laoborশ্বশুর-শ্বাশুড়ি, ভাসুর-দেবরদের নিয়ে প্রথম প্রথম ভালোই চলছিল নিলুফার সংসার। এদিকে মাসুদ সংসার চালানোর জন্য খুব একটা টাকা পাঠাতেন না। ফলে সংসারে অভাব লেগেই থাকতো। শ্বশুর-শ্বাশুড়ি নিলুফার সঙ্গে খুব একটা ভালো ব্যবহার করতেন না। পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেন ভাসুর ও দেবর। তারাও নিলুফাকে নানাভাবে নির্যাতন করতেন।

বছর তিনেক পর সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশে ফেরেন মাসুদ। তখন তার স্ত্রী জানতে চান এত বছর বিদেশে থেকেও তাদের আয় উন্নতি নেই কেনো?  জবাবে মাসুদ স্ত্রীকে জানান, বিদেশে আয়ের একটা অংশ তিনি জমিয়েছেন। সিঙ্গাপুর থেকে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার জন্য। আরও কিছুদিন কষ্ট করতে বলেন। মাসুদ অস্ট্রেলিয়া যেতে পারলে সংসারের অভাব থাকবে না বলে দাবি করেন। এই স্তুতি বাক্য শুনিয়ে ফের সিঙ্গাপুরে পাড়ি জামান।

এদিকে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই নিলুফার কন্যা সন্তানের জননী হন। এরপর শ্বশুরবাড়ির লোকজন তার ওপর আগের চেয়েও বেশি নির্যাতন চালাতে থাকে। মুখ বুঝে সহ্য করেন নিলুফা। অপেক্ষা করতে থাকেন স্বামীর জন্য। কিন্তু অপেক্ষার প্রহর যেনো শেষ হয় না।

এদিকে মাসুদ অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার লোভে সিঙ্গাপুরে এক ইন্দোনেশিয়ান নারীকে বিয়ে করেন। বিয়ের আগে ওই নারী মাসুদকে অস্ট্রেলিয়া পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই পরিকল্পনা নিয়ে মাসুদ ওই নারীর সঙ্গে ইন্দোনেশিয়া যায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে দৃশ্যপট বদলে যায়। মাসুদের সব টাকা হাতিয়ে নিয়ে তার নামে মামলা ঠুকে দেন ওই নারী। তিন মাস জেল খেটে ভগ্ন মনে দেশে ফেরেন।

বাংলাদেশে এসে নতুন ফন্দি আঁটেন মাসুদ। এবার তিনি বিদেশ না গিয়ে স্ত্রীকে পাঠানোর ধান্দা করেন। দুই সন্তান রেখে বিদেশে যেতে চাইছিলেন না নিলুফা। কিন্তু নাছোড়াবান্দ মাসুদ অনেক বুঝিয়ে শেষ পর্যন্ত স্ত্রীকে বিদেশে পাঠাতে রাজি করান। অনেকেটা চাপে ফেলে ২০১৪ সালে স্ত্রীকে তুলে দেন দুবাইগামী বিমানে।

nari laborদুবাই গিয়ে আলী নামে এক পুলিশ কর্মকর্তার বাসায় কাজে নিয়োজিত হন নিলুফা। আলীর স্ত্রী, দুই ছেলে ও তিন মেয়েকে নিয়ে সংসার। এই সংসারের রান্না-বান্না থেকে শুরু করে ঘরকন্যার যাবতীয় কাজ করতে হতো। পাশাপাশি আলীর মায়ের বাসায় এবং আলীর স্ত্রীর মায়ের বাসায়ও কাজ করতেন। এজন্য তিনি মাসে ৩০ হাজার টাকা বেতন পেতেন। নিলুফার বিদেশি ওই সংসারে থাকা-খাওয়া ফ্রি ছিল। তাই আয়ের পুরো টাকাটাই স্বামীর কাছে দেশে পাঠাতেন। তার দুই সন্তানের দায়িত্ব তাদের দাদা-দাদীর ওপর চাপিয়ে মাসুদ উচ্ছৃঙ্খল জীবন-যাপন করতে থাকেন। বউয়ের কষ্টার্জিত উপার্জন বেহিসাবে খরচ করেন। অন্যদিকে রোজ আলীর স্ত্রীর কাছে মার খেতো নিলুফা। কেননা, দেখতে সুন্দর হওয়ার আলীর নজর ছিল নিলুফার দিকে। তাই তাকে গোপনে জামা-কাপড় ও প্রসাধনী কিনে দিতেন। বিষয়টা আলীর স্ত্রীর দৃষ্টিগোচর হলে এ নিয়ে তাদের সংসারে অশান্তি শুরু হয়। নিলুফাকে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করতে থাকেন। ফলে ২৩ মাসের মাথায় দুবাইয়ের পাঠ চুকিয়ে দেশে ফেরেন নিলুফা।

দেশে এসে জানতে পারেন তার পাঠানো সব টাকাই খরচ করেছেন তার স্বামী। সংসারে আগের মতো অভাব দেখে স্বামী আবার বিদেশে কাজের জন্য চলে যেতে বলেন। নিজেই উদ্যোগী হয়ে এজেন্সির মাধ্যমে সৌদি যাওয়ার বন্দোবস্ত করেন। অগত্যা নিলুফাও রাজি হন।

এবারও সৌদি গিয়ে একটি বাড়িতে গৃহকর্মে নিযুক্ত হন। তাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন সৌদি বিমান বন্দরের এক পুলিশ কর্মকর্তা। নাম আব্দুর রহমান। সে নিলুফাকে নিযুক্ত করেন তার বৃদ্ধ বাবা-মাকে দেখভাল করার জন্য। তার বাবার নাম আলী শামরানি, মায়ের নাম ছিল গাদরিয়া। এই দুজনকে দেখভাল করতেন নিলুফা। তারা থাকতেন জেদ্দার আল কাতির নামের একটি গ্রামে থাকতেন। সেখানে ওই দুই বৃদ্ধার সংসারের রান্না, ঘরবাড়ি গোছগাছ থেকে শুরু করে তাদের সেবা-যত্ন করতেন।

ভালোই চলছিল এভাবে। বেতন যা পেতেন তার সবটাই স্বামীকে দেশে পাঠাতেন। আর বলতেন সংসার খরচের পর যে টাকা বাঁচে তা জমিয়ে রাখতে। কিন্তু কে শোনো কার কথা। নিলুফার সৌদি যাওয়ার নয় মাসের মাথায় মাসুদ গোপনে আরেকটা বিয়ে করেন। নিলুফা সেটা জানতেই পারেননি। বছর তিনেক পর ছুটি পেয়ে দেশে আসেন। এবারও তিনি স্বামীর কাছে পাঠানো টাকার হিসাব চান। কিন্তু তার স্বামী কোনো হিসাব দেখাতে পারিনি। উল্টা তাকে নির্যাতন করেন। ফলে স্বামীর ওপর যারপরনাই নাখোশ হন। মাস খানেক দেশে থেকে আবার সৌদি চলে যান। গিয়ে আগের বাসায় গৃহকর্মে নিযুক্ত হন। কিন্তু এবার আর স্বামীর কাছে টাকা পাঠান না। বিদেশ থেকে স্ত্রীর টাকা না পেয়ে ক্ষোভে স্ত্রীকে তালাক দেন মাসুদ। তালাকনামা স্ত্রীকে ডাকযোগে সৌদিতেও পাঠিয়ে দেন। তখন মুষড়ে পড়েন নিলুফা। কিন্তু দুই সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সৌদিতে থেকে যান।

nari laborনিলুফা বলেন, ‘স্বামী আমাকে তালাক দেয়ার খবর পাওয়া পর ভেবেছিলাম বিদেশ থেকে দেশে চলে আসি। কিন্তু পর ভাবলাম দেশে গিয়ে আমি কী করবো? কে আমাকে খাওয়াবে? আমার দুই ছেলে-মেয়েরই বা কী হবে?’

এসব দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে সৌদি ওই দম্পত্তির সংসারে মনোনিবেশ করেন নিলুফা। বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা তাকে খুবই স্নেহ করতেন। তারা ছিলেন মূলত কৃষক। তাই তাদের কৃষিকাজেও সাহায্য করতেন। নিলুফার রান্না খুব পছন্দ ছিল তাদের। যদিও সৌদির মানুষ রুটি, সবজি, পোলাও ও বিরিয়ানি বেশি খেতেন। কিন্তু নিলুফা তাদের ভাত, মাছ, মাংস, মিষ্টান্নসহ বিভিন্ন ধরনের, পদের বাঙালি রান্না করে খাওয়াতেন। যা তাদের খুবই পছন্দ ছিল। এভাবেই আরও তিনটা বছর পার হয়। এদিকে হঠাৎ করেই বৃদ্ধা গাদরিয়া অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার ছেলে আব্দুর রহমান মাকে হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে নার্সরাই যত্নাত্তি করে। ফলে প্রয়োজন ফুরায় নিলুফার। ৭ ফেব্রুয়ারি ফিরে আসেন দেশে। আশ্রয় নেন বাবা-মায়ের কাছে বাকেরগঞ্জে।

নিলুফা জানান, তার সাড়ে আট বছরের প্রবাস জীবনের প্রথম সাড়ে পাঁচ বছরের কোনো অর্জন নেই। তার কষ্টার্জিত আয়ের বেশিরভাগ অংশই তার স্বামী নষ্ট করেছে। স্বামী তালাক দেওয়ার পর তিনি শেষ সাড়ে তিন বছরে কিছু টাকা জমিয়েছিলেন। যা দিয়ে বাকেরগঞ্জে জমি কিনেছেন। বাণিজ্যিকভাবে পালনের জন্য অস্ট্রেলিয়ান জাতের গরু কিনেছেন। এখন সেখানেই থিঁতু হতে চান। আর বিদেশ যাওয়া ইচ্ছা নেই তার। তাদের বড় ছেলে দাদা-দাদীর কাছে নোয়াখালীতে বড় হচ্ছে। এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে সে।

আর মেয়েকে নিজের কাছে রেখেছেন। অন্যদিকে তার স্বামী গাজীপুরে তার তিন নম্বর বউকে নিয়ে সংসার করছেন। এমন অবস্থার মধ্যেও দমে যেতে চান না নিলুফা। স্বপ্ন দেখেন সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে।

এজেড/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর