দুই শতাধিক কিশোরীর বাল্যবিবাহ রুখে দিয়েছেন আকাশী

জেলা সদর মাদারীপুরসহ উপজেলাগুলোতে দৈনিক সুবর্ণ গ্রামের বার্তা সম্পাদক ও সাংবাদিক হিসেবে আয়শা সিদ্দিকা আকাশীর নাম ছড়িয়ে পড়ে একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান নারী সাংবাদিক হিসেবে। ছোটবেলা থেকে বইপড়া ও সংগ্রহ করা শখ তার। তার সংগ্রহে উল্লেখযোগ্য সংখক বই রয়েছে। সেই সাথে বর্তমানে তিনি হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ধরে রাখতে সংগ্রহ করছেন বিভিন্ন ধরনের বিলুপ্তি নানা জিনিসপত্র। যেমন হারিয়ে যাওয়া টেকি, যাতা, পিতলের জিনিসপত্র, অ্যানালক ক্যামেরা, হারিকেন, ল্যাম্ব, সাদাকালো টেলিভিশন ইত্যাদি তার সংগ্রহে আছে। হারিয়ে যাওয়া জিনিসপত্রগুলো যাতে করে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পারে, সেই জন্য নিরবে তিনি ও তার স্বামী রাজন মাহমুদ সংগ্রহ করে যাচ্ছেন।

২০০৮ সালে ২১শে বই মেলায় কর্ণেল খলিলুর রহমানের সহযোগিতায় ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশন থেকে ‘এক জলকন্যার রির্পোটের শিরানাম’ নামে একটি কবিতার বই বের হয়। বইয়ের জন্য গাংচিল সাহিত্য পরিষদ থেকে পান পদক, গল্প লেখার জন্য পান সুনীল সাহিত্য বিশেষ পুরস্কার ও মাদারীপুর জেলায় প্রথম নারী সাংবাদিক হবার জন্য আবৃত্তি সংগঠন ‘মাত্রা’ তাকে দেন বিশেষ সম্মাননা পুরস্কার।

এছাড়া ২০১১ সালে জেলায় সফল নারী হিসেবেও তাকে সম্মাননা ক্রেস্ট দেয়া হয়। এতে আয়েশা আকাশীর উদ্যম বেড়ে যায়। বেড়ে যায় মনের সাহস ও উদ্দীপনা। অনেকের মধ্যে পরিচয় হয় পরিবেশবাদী সংগঠন ফ্রেন্ডস অভ নেচারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক রাজন মাহমুদের সাথে। শুরু হয় পরিবেশ নিয়ে বিভিন্ন কাজ। একজন সক্রিয় সদস্য হয়ে উঠে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ জোট ‘আমরাই পারি’ এর। কাজের পরিধি বেড়ে গেলে জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মাহমুদা আক্তার কনা’র সহযোগিতায় নিজেই প্রতিষ্ঠিত করে নকশি কাঁথা নামের একটি নারীবাদি সংগঠন। জেলায় নানা নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ ও সংবাদ করে খুব অল্প বয়সেই পরিচিত হয়ে উঠেছেন একজন নারী নেত্রী হিসেবে। তিনি জেলার অনেক গরীব দুখীদের পাশে দাড়িয়ে তাদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করছেন। তাকে প্রতিনিয়ত মোকাবেলা করতে হয় নানা সমস্যার। একজন নারী হিসেবে নানা প্রতিকূলতাকে পাড় করেছেন তবুও তিনি থেমে নেই। 

২০১১ সালের ১ জানুয়ারি বিয়ে করেন মাদারীপুর শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, সমাজসেবক ও পরিবেশবাদী সংগঠন ফ্রেন্ডস অভ নেচারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক রাজন মাহমুদকে। বিয়ের পর কাজের অনুপ্রেরণা ও পিছনের মানুষ হিসেবে রাজন মাহমুদ সব ধরণের সহযোগিতা করে আসছেন।

আর সেই সব নিন্দুক মানুষদের পিছনে ফেলে ২০১৯ সালের কালের কণ্ঠ শুভসংঘের পক্ষ থেকে সেরা সংগঠন হিসেবেও পুরস্কার পান। সেই সাথে মাদারীপুর জেলা শহরের সবাই তাকে চেনে-জানে একজন সৎ সাহসী সাংবাদিক হিসেবে। 

‘বাঁশপাতা ও স্বীকারোক্তি’ নামের ২টি ম্যাগাজিনের সম্পাদকসহ একাধিক ম্যাগাজিনের সহ-সম্পাদক ছিলেন সাংবাদিক আয়শা সিদ্দিকা আকাশী। তিনি জাতীয় পর্যায়ে একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন। অর্জন করেছেন স্কয়ার গ্রুপের রাধুনী কীর্তিমতী সম্মাননা (নারী সাংবাদিকতা)। আরো পেয়েছেন ভাষাসৈনিক মিলনমেলায় নারী সাংবাদিকতায় উৎসাহ পদক, প্রাণ চাটনি জীবনের গল্প এর আয়োজনে নারী সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য বিশেষ সম্মাননা, আন্তর্জাতিক নারী দিবসে পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের পক্ষ থেকে জেলায় প্রথম নারী সাংবাদিক হিসেবে অবদানের জন্য বিশেষ সম্মাননা, মাদারীপুর জেলা তথ্য অফিসের আয়োজনে জেলার সেরা ২০টি ছবির প্রদর্শণ  করে পেয়েছেন বিশেষ পুরস্কার, সুনীল সাহিত্য পুরস্কার, জেলায় প্রথম নারী সাংবাদিক হবার জন্য আবৃত্তি সংগঠন মাত্রা দিয়েছেন বিশেষ সম্মাননা, গাংচিল সাহিত্য পদক (কবিতার বই এর জন্য) প্রমুখ।

তাছাড়া তিনি মাদারীপুরের নানা সংগঠনের সাথে জড়িত আছেন। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হচ্ছে নারী উন্নয়ন সংস্থা নকশি কাঁথা নামের একটি সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক, মাদারীপুরে পরিবেশবাদী সংগঠন ’ফ্রেন্ডস অব নেচার’র যুগ্ম সম্পাদক, জাতীয় কবিতা পরিষদ, গাংচিল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ ও  দক্ষিণ বাংলা সাহিত্য পরিষদ সদস্য, জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম’র কার্যকরি কমিটির সদস্য, মাদকবিরোধী সংগঠন ‘মানস’র কার্যকরি কমিটির সদস্য, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর কার্যকরি সদস্য, এমএম হাফিস মেমোরিয়াল পাবলিক লাইব্রেরির কার্যকরি সদস্য, দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি (দুপ্রক) সদস্য প্রমুখ।

তা দেখে মাদারীপুর, ঢাকাসহ দেশের বাহিরে ইতালি, সৌদি আরব, কুয়েত, মালেয়শিয়াসহ অসংখ্য বন্ধু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। তাদের কাছ থেকে অনুদান সংগ্রহ করে তা ওইসব অসহায় মানুষদের দেন।

শুধু মাদারীপুর জেলায় নয়, ফেসবুকের অসংখ্য চেনা-অচেনা বন্ধুর কাছে আয়শা সিদ্দিকা আকাশী একজন বিশ্বস্ত মানুষ, গরীবের বন্ধু। ইতিমধ্যে তিনি ফেসবুকের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে তিন শতাধিক পরিবারকে সহযোগিতা করেছেন। 

সড়ক দুর্ঘটনায় একটি পা বিছিন্ন কিশোরী, মাদারীপুর সদর উপজেলার হুগলীর আদিত্যপুর গ্রামের শাজাহান খোয়াজের মেয়ে শুভ আক্তারকে কৃত্রিম পা লাগানোর জন্য তার মা ফরিদা বেগমের হাতে ৫০ হাজার টাকা তুলে দেন। সেই টাকা দিয়ে কিশোরী শুভ কৃত্রিম পা লাগিয়েছে।

দুর্ঘটনায় দুটি পা হারিয়ে আব্দুল হকের জীবনে নেমে আসে  অন্ধকার। এই যুবক বয়সে দুটি পা বেচে দুটি কৃত্রিম পা লাগিয়েছিলেন। কিন্তু কয়েক বছর পর ঐ কৃত্রিম পা দুটি নষ্ট হয়ে যায়। পড়তে হয় তাকে নানা সমস্যায়। কিন্তু টাকার অভাবে পুনঃরায় পা বানাতে পারছিলো না। অনেক কষ্ট করে ২৫ হাজার টাকা জোগার করলেও তা পর্যাপ্ত ছিলো না। প্রয়োজন ছিলো আরো টাকার। খোঁজ পেয়ে তিনি আসেন আয়শা সিদ্দিকা আকাশীর কাছে। তিনি ফেসবুকের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করেন। ৬০ হাজার টাকা তুলে দেন মাদারীপুর সদর উপজেলার ঘটমাঝি গ্রামের সলেমান মাতুব্বরের ছেলে মো. আ. হকের হাতে। সেই টাকা দিয়ে সে পা লাগিয়েছেন।

এছাড়া মাদারীপুর সদর উপজেলার রাস্তি ইউনিয়নের ৯০ বছরের বৃদ্ধ মো. হাকিম উদ্দিন বয়সের ভারে হাঁটতে না পারলেও বাঁচার তাগিদে তাকে ভিক্ষা করতে হতো। ফেসবুকের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করে হাকিম উদ্দিনকে দুই বছর পর্যন্ত চাল, ডালসহ প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস প্রতি মাসে কিনে দেয়া হতো। তিনি মারা যাবার পারও তার স্ত্রীকে প্রায় এক বছর সহযোগিতা করা হয়েছে। অসহায় শিশুকে দুধ কিনে দেয়া, স্বাবলম্বী হবার জন্য প্রায় অসংখ্য জন নারীকে সেলাই মেশিন কিনে দেয়া, অসহায় বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুকে হুইল চেয়ার কিনে দেয়া, অসহায় শিক্ষার্থীদের বই কিনে দেয়া, চিকিৎসার জন্য অনুদান, ৫ বছর ধরে প্রতি ঈদের অসহায় বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তি, দুস্থদের নতুন জামা বিতরণ, কম্বল বিতরণ ও শীতের সময় মানবতার দেয়াল শিরোনামে সহযোগিতা করা হয়।

যেমন প্রত্যন্ত এলাকা থেকে শহরের কোন কাজে বিশেষ করে অসহায়-নির্যাতিত নারীদের আইনের সহযোগিতা ও চিকিৎসার জন্য মাদারীপুরে আসতে হয়। কিন্তু কোন কারণে তাদের রাত হলে কিংবা বিশ্রাম নেয়ার প্রয়োজন হয়, কিন্তু তাদের জন্য তেমন কোন আশ্রয় কেন্দ্র নেই। তাই ওইসব নারীরা যেন নিরাপদে নারী আশ্রয় কেন্দ্রে আসতে পারবে, এমন একটা প্রতিষ্ঠান তৈরি করার ইচ্ছা আছে। 

আয়েশা সিদ্দিকা আকাশী বলেন, মানুষকে সাহায্য করার প্রবল ইচ্ছা থেকেই এখন নেশা হয়ে গিয়েছে। মানুষের পাশে থেকে যখন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেই তার থেকে যে ভালবাসা পাই এটাই আমার বড় প্রাপ্তি। আমি চাই জীবনের শেষ দিন অবধি এভাবেই মানুষের পাশে থেকে সাহায্য করবো। 

মাদারীপুর জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মাহমুদা আক্তার কনা বলেন, মাদারীপুরে যদি কেউ নারী আর শিশুদের জন্য ভেবে থাকেন সেটা আকাশী। শুধু নারী নয় সে অসংখ্য  অসহায় মানুষের পাশে থেকে সাহায্য করে যাচ্ছে। তার মধ্যে যে সততা আছে সেটা আসলেই নজীর সৃষ্টি করেছে।

এইচই