আধুনিক সভ্যতায় স্বাধীনতার পরিপূরক শব্দে পরিণত হয়েছে অর্থনৈতিক মুক্তি। একজন মানুষ তখনই পুরোপুরি স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারেন যখন তিনি অর্থনৈতিকভাবে মুক্তি লাভ করেন। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নানাভাবে নারীরা নির্যাতিত-নিষ্পেষিত হচ্ছেন। এর প্রধান কারণ নারীদের অর্থনৈতিক পরাধীনতা। তবে তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতায় এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে। নারীরা তাদের নির্দিষ্ট গণ্ডি পেরিয়ে পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছেন। উপার্জনোক্ষম ব্যক্তি হিসেবে হাল ধরছেন পরিবারের। আর এটি সম্ভব হচ্ছে অনলাইন ব্যবসা বা ই-কমার্সের কল্যাণে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশের শতকরা ৮০ শতাংশ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানই চালাচ্ছেন নারী উদ্যোক্তারা।
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসে বিশ্ব অর্থনীতি অনেকটা বিপর্যস্ত। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের জন্য করোনা অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিপরীতে করোনা অনলাইন ব্যবসায় টার্নিং পয়েন্ট হয়ে দাঁড়ায়। গত কয়েক বছরে দেশ অনলাইনভিত্তিক ই-কমার্স ব্যবসার বিশাল একটি বাজার গড়ে ওঠেছে। যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন নারী উদ্যোক্তারা। বেশিরভাগ নারীই ঘরে তৈরি খাবার, বিভিন্ন ধরনের পিঠা, কাপড়, হ্যান্ড মেইড অর্নামেন্টস ইত্যাদির মাধ্যমে নিজেদের অনলাইন ব্যবসা পরিচালনা করছেন। ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) তথ্য বলছে, দেশে ২০ হাজারের বেশি ফেসবুক পেজে কেনাকাটা চলছে। এর মধ্যে অন্তত ১২ হাজার পেজ চালাচ্ছেন নারীরা।
বিজ্ঞাপন
তবে অনলাইন ব্যবসা পরিচালনা করতেও নারীরা অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছেন। এর মধ্যে পারিবারিক ও সামাজিক বাধা, আর্থিক সহায়তা না পাওয়া, প্রশিক্ষণ ও অভাব, ডেলিভারিজনিত সমস্যা ও তথ্যের অভাব রয়েছে। তবে এতশত বাধা শর্তেও নারীরা তাদের সফলতার ভিন্ন ভিন্ন গল্প নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন সামাজের সামনে। হয়ে উঠেছেন আত্ম-নির্ভরশীল, অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন, সফল উদ্যোক্তা এবং নির্যাতিত নারী সমাজের মুক্তির দূত।
গৃহিণী থেকে ক্লথিং ব্র্যান্ড ‘সাতকাহন’-এর স্বত্বাধিকারী
নূরুন্নাহার নীলা জনপ্রিয় ক্লথিং ব্র্যান্ড ‘সাতকাহন’ ( www.shatkahonbd.com) এর স্বত্বাধিকারী। ময়মনসিংহের ত্রিশালে জন্মগ্রহণ করা নীলা ময়মনসিংহ ক্যান্টনম্যান্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি এবং আনন্দমোহন কলেজ থেকে অর্থনীতিতে অনার্স করেছেন। মা-বাবার ইচ্ছায় অর্থনীতিতে মাস্টার্স করলেও চাকরির দিকে পা বাড়াননি তিনি। বরং পোশাক নিয়ে কাজ করার সুপ্ত বাসনা থেকে হয়ে উঠেছেন একজন সফল উদ্যোক্তা। হয়ে উঠেছেন উদ্যোক্তাদের একজন রোল মডেল।
সাতকাহনের যাত্রা শুরু সম্পর্কে জানতে চাইলে নূরুন্নাহার নীলা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘অর্থনীতিতে পড়াশোনা করলেও আমি কখনোই চাকরি করার পক্ষপাতি ছিলাম না। নিজেই কিছু করার কথা ভেবেছিলাম। ছবি আঁকাতে ভালোবাসতাম। ছবি আঁকার হাতেখড়ি দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই। নিজের ও বন্ধুদের জামা, টি-শার্টে নানা নকশা করেছি। এরপর নিজের বাসা থেকেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন শুরু করেছি। ভারতীয় জামা-শাড়ি খুব সহজলভ্য হওয়ায় অনেকেই তা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু আমি নিজের জমানো টাকায় টাঙ্গাইল গিয়ে কিনে আনলেন ১৪টি শাড়ি। বাসায় এসে মোবাইলে কিছু ছবি তুলে একটা ফেসবুক পেইজ সাজালাম। নাম দিলাম ‘সাতকাহন’। এই ১৪টি শাড়ি দিয়েই সাত বছর আগে শুরু হয়েছিল আমার প্রতিষ্ঠানের পথচলা।’
বিজ্ঞাপন
নিজের সফলতার রহস্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘ব্যবসার শুরুতেই মানুষের বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টা করেছি। বহু ক্রেতার কাছে শাড়ি পাঠিয়েছি টাকা ছাড়াই৷ ক্রেতারা শাড়ি পেয়ে খুশি হয়ে পরে টাকা দিয়েছেন। বিশ্বাস ও আস্থায় অল্প দিনের মধ্যেই সাতকাহন লাভজনক হয়ে উঠল। বাড়তে থাকে অর্ডার। একসময় একজন কর্মচারী নিয়োগ দিলাম। উত্তরায় নিজের আলাদা অফিস আর শোরুম হলো সাতকাহনের। বসুন্ধরা সিটিতে চালু করেছি সাতকাহনের দ্বিতীয় শোরুমটি। শাড়ির পাশাপাশি নিজের ডিজাইন করা পাঞ্জাবি, ব্লাউজ, কূর্তি, গহনা, সালোয়ার-কামিজ নিয়েও কাজ শুরু করলাম। দেশীয় ঐতিহ্যের ছোঁয়া আমি নিজেই ডিজাইলগুলো করছি।’
‘এর মাধ্যমে আমি আমার দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিজেকে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেব গড়ে তুলেছি। নিজে স্ব-নির্ভর হওয়ার পাশাপাশি আরও মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছি,’ যোগ করেন এই সফল উদ্যোক্তা।
নার্সিং শিক্ষার্থী থেকে মায়ের অনুপ্রেরণায় উদ্যোক্তা
নাজমুন নাহার নিপু রাজধানীর মার্কস মেডিকেল কলেজে বিএসসি ইন নার্সিংয়ে চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। মায়ের অনুপ্রেরণায় ২০১৯ সালের জুন মাসে নারী উদ্যোক্তা হিসেবে যাত্র শুরু করেন। করোনা মহামারির সময়ে লকডাউন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সময়টাকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলেছেন নাজ সেল’স কর্নার (https://www.facebook.com/najsellscorner)। প্রাথমিক অবস্থায় শুধু নিজ জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শুরু করলেও নিজ জেলার মানুষের মন জয় করে এবার ঢাকাসহ সারাদেশে কাজ করার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে চলছেন। প্রথম দিকে কেক, পেস্ট্রি নিয়ে অনলাইন ব্যবসা শুরু করলেও লাড্ডু এবং হালকা নাস্তা জাতীয় খাবার প্রস্তুত ও বিপণন করছেন।
নাজ সেল’স কর্নারের কাজের শুরু নিয়ে ঢাকা মেইলকে এই উদ্যোক্ত বলেন, ‘২০১৯ এ শুরু করলেও করোনাকালে আমার ক্লাস বন্ধ থাকাটাকে কাজে লাগিয়েছি। অনলাইনে ব্যবসাটি আমার আম্মুর প্ল্যান ছিল। আমার আম্মুর প্রবল আগ্রহ থেকেই আমাদের যাত্রা শুরু। লকডাউনে সম্পূর্ণ সময় আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছিলাম। তখনই এটিকে প্রতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া। করোনার বন্ধের সুযোগটা কাজে লাগিয়েছি এবং খুবই অল্প সময়ের মধ্যে অনেক মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি। সাধারণত উদ্যোক্তারা প্রাথমিক অবস্থায় পরিবার থেকে বাধা পায়, আমার ক্ষেত্রে বরং তার উল্টোটা হয়েছে। আম্মু নিজেই ছিলেন প্রথম উদ্যোক্তা, একই সঙ্গে আত্মীয়-স্বজনদের থেকেও সহযোগিতা পেয়েছি। ফলে পড়াশোনা করেও আম্মুর সহযোগিতায় আমি চালিয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছি।’
নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে নিপু বলেন, ‘কাজ শুরু করার পর ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ভালো একটি সাড়া পেয়েছি। এখন আমার আম্মু কাজটি চালিয়ে যাচ্ছে, আমি যতদূর সম্ভব সহযোগিতা করছি। ই-কমার্স থেকে এতটা সাড়া পাবো তা ভাবিনি। আমরা ঢাকাসহ সারাদেশে কাজ করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এটি আমাকে আত্মবিশ্বাসী করেছে, আমাকে দায়িত্বগ্রহণ ও ব্যবসা পরিচালনা করার সক্ষমতা তৈরিতে গুরুত্ব ভূমিকা পালন করেছে। একইসঙ্গে এটি আমাকে অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছলতা এনে দিয়েছে, আমি এখন স্ব-নির্ভরশীল।’
‘অনলাইন ব্যবসার ক্ষেত্রে যেটা সবথেকে বড় বাধা তা হচ্ছে প্রোডাক্ট ডেলিভারি। এটি নিয়ে অনেক সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়। তবুও আমি বলবো ই-কমার্স মেয়েদের জন্য খুবই ভালো একটি প্লাটফর্ম। আমরা ঘরে থেকেই এটি মেইনটেইন করতে পারছি। যা অনলাইন ব্যবসার সবথেকে বড় সুবিধা’, বলছিলেন নাজমুন নাহার নিপু।
‘মেয়ে হয়ে ব্যবসা করাটাকে কেউ স্বাভাবিকভাবে নেয়নি’
‘পড়াশোনার পাশাপাশি অনলাইন ব্যবসা আমাকে স্ব-নির্ভরশীল করেছে’ বলছিলেন কিশোরগঞ্জের নারী উদ্যোক্ত তাসফিয়া প্রধান তমা। গুরুদয়াল সরকারি কলেজে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত এই শিক্ষার্থী অম্বর শৈলীর (https://www.facebook.com/amborshoili) স্বত্বাধিকারী।
ই-কমার্স যাত্রা শুরুর বিষয়ে তমা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সময় চাকরির প্রস্তুতিসহ সার্বিক পড়াশোনায় বড় একটি ছেদ পড়ে। বাসায় দীর্ঘদিন অলস সময় কাটানো অবস্থায় প্রথম নিজে কিছু করার চিন্তা মাথায় আসে। সেখান থেকেই ‘অম্বর শৈলী’ এর যাত্রা শুরু। প্রথমিক অবস্থায় পারিবারিক বাধা ছিল। মেয়ে হয়ে ব্যবসা করাটাকে কেউ স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। অনলাইন ব্যবসা সম্পর্কে ভালোভাবে ধারণা না থাকায় পরিবার ও প্রতিবেশীদের নেতিবাচক মন্তব্য ও মনোভাব মোকাবিলা করতে হয়েছে। তবে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়েছে। এখন বরং পরিবার থেকে সাহস ও সহযোগিতা পাচ্ছি।’
ই-কমার্স থেকে প্রাপ্তির কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মানুষের অনেক সাড়া এবং ভালোবাসা পেয়েছি। অনলাইন ব্যবসার নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস এবং সামাজের নানা সমালোচনা ও বাধা-বিপত্তি মোকাবিলার সক্ষমতা তৈরি করে দিয়েছে। এটি আমাকে অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী করে তুলেছে। পরিবারের ওপর থেকে সম্পূর্ণ আর্থিক নির্ভরশীলতা কমায় স্বাধীনতা বৃদ্ধি পেয়েছে।’
এমএইচ/জেবি