শখের বশে নাজনীন নাহারকে খাঁচা সমেত এক জোড়া কোয়েল পাখি দিয়েছিলেন তার এক আত্মীয়। সেগুলো ছিল স্ত্রী কোয়েল। মাসখানেক পাখি দুটোকে যত্নে পালেন। দুটো পাখিই ডিম দিতে শুরু করে। তখন তার আনন্দ দেখে কে? পরে নাজনীন তার স্বামীকে আরও দুটি কোয়েল পাখি কিনে এনে দেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করেন। তার স্বামীরও পোষা প্রাণীর প্রতি প্রেম ছিল। ফলে স্ত্রীর অনুরোধে সাড়া দিয়ে কিনে আনেন আরও ১০টি কোয়েল। মাসখানেক পর সবগুলো পাখিই নিয়মিত ডিম দেয়। এই ১২টি কোয়েল পাখি নিয়ে শুরু হয় গৃহিনী নাজনীনের শৌখিন খামার।
বিজ্ঞাপন
প্রথমে বাসার বারান্দার খাঁচায় পাখিগুলো পালন করছিলেন। এরই মধ্যে নাজনীনের কদমতলীর বাসা লাগোয়া একটি চিলেকোঠার সন্ধান পান তিনি। এক তলা বাসার ছাদে ওই চিলেকোঠা। বাড়ির মালিক তার আত্মীয় হওয়ায় তাকে পাখিগুলো চিলেকোঠায় রেখে পালতে অনুমতি দেন। চিলেকোঠায় খামার করার চিন্তা আসে তার। আবারও স্বামীকে বলেন, আরও কিছু পাখি এনে দিতে। কিন্তু তার স্বামী এবার নতুন করে কোয়েল পাখি কেনেন না। কেননা, ১২টা কোয়েল থেকে প্রায় প্রতিদিনই ১০-১১টা ডিম মিলতো। যা তাদের খাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। কোয়েল পাখির সংখ্যা বাড়ালে সংসারে খাওয়ার জন্য রেখে অতিরিক্ত ডিম বিক্রি করতে হবে। তাই চিলেকোঠায় পালার জন্য এক জোড়া কবুতর কেনেন। কিনে আনেন মস্ত বড় একটা খাঁচা। কিছুদিন যেতে না যেতেই ডিম পেড়ে বাচ্চা ফোটায় কবুতর দম্পতি তা দেখে নাজনীন ও তার স্বামীর আনন্দ আরও বেড়ে যায়। তারা নিয়ম করে কবুতর ও কোয়েল পাখির যত্ন-আত্তি করে আসছিলেন।
এরই মাঝে নাজনীনের স্বামী তাকে বলেন, তাদের যেহেতু বড় খাঁচা আছে তাই তারা চাইলে ঘুঘু পাখিও পালতে পারেন। তারা জেনেছিলেন ধূসর রঙের অস্ট্রেলিয়ান ঘুঘু খাঁচায় পালন করা যায়। এগুলোর বাজারমূল্যও ভালো। সেই চিন্তা মাথায় রেখে নাজনীনকে এক জোড়া পূর্ণবয়স্ক ঘুঘু উপহার দেন তার স্বামী জামান। সপ্তাহ পার হতে না হতেই মাদী ঘুঘু এক জোড়া ডিম দেয়।
সপ্তাহ-তিনেকের মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চাও বের হয়। কিন্তু তাদের ঘুঘু পালনের অভিজ্ঞতা না থাকায় বাচ্চা দুটোকে বাঁচাতে পারেননি। তবুও দমে যাননি। সকাল-বিকাল শস্যদানা ও খনিজ উপাদান খাইয়ে আসছিলেন ঘুঘুদের। ফলে কিছুদিন পর আবারও ডিম দেয় ঘুঘু। আগের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এগুলোর যত্ন করেন। এবার সফলতার মুখ দেখেন। ডিম থেকে দুটা বাচ্চাই ফোটে। দিনে দিনে বড় হয় এগুলো। অন্যদিকে প্রতি মাসেই কবুতর থেকে ডিম-বাচ্চা পেতে থাকেন। ফলে কবুতর ও ঘুঘুর সংখ্যা বাড়তে থাকে।
নাজনীনের কর্মজীবী স্বামী অফিসে যাওয়ার আগে পাখিগুলোকে খাবার ও পানি দেন। দিনভর সেগুলো দেখভাল করেন নাজনীন। বাড়ির কর্তা বিকেলে ফিরে পাখিগুলোকে আবার দেখতে যান। স্বামী ও স্ত্রী দুজনে মিলে এভাবেই চিলেকোঠায় ছোট্ট একটি পাখির খামার গড়েন। যা দেখে আত্মীয়রা তাদের উৎসাহ দিতে থাকেন।
একদিন নাজনীনের ভাসুর তাকে জানান, তার এক বন্ধু ঢাকার অদূরে চীনা মুরগির খামার করেছে। সেখান থেকে কিছু মুরগি এনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। সপ্তাহখানেক পরেই হাতে পেয়ে যান চার জাতের চীনা মুরগির ছোট্ট ছানা। বিড়ালের মতো তুলতুলে সিল্কি মুরগি হাতে পেয়ে নাজনীনের ছোট্ট মেয়ে লিয়ানা যারপরনাই আনন্দিত হয়। সিল্কি ছাড়াও তারা এস এস রেয়ার ব্রিড অ্যান্ড অ্যাগ্রো খামার থেকে উপহার পান কাদাকনাথ,লো হোওয়া চি, হোমিও চি এবং হু ইয়াং চি জাতের চীনা মুরগি। এসব মুরগি দুর্লভ জাতের। তাই শৌখিনভাবেই সবাই পালেন।
বিদেশি জাতের মুরগি পালার জন্য নাজনীন ইউটিউব ঘেঁটে এর পরিচর্যা শেখেন। এবং সেভাবেই পরিপালন করেন। দেখতে দেখতে মুরগিগুলো বড় হয়ে উঠতে থাকে। একই সঙ্গে নাজনীনের এক চিলতে স্বপ্নও ডালপালা গজাতে থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভূক্ত বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করেছেন নাজনীন। ইচ্ছা ছিল চাকরি করার। কিন্তু স্বামী, সংসার ও কন্যাকে দেখভাল করতে গিয়ে চাকরির পড়ার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার ফুসরত মেলে না। এদিকে তার স্বামী তাকে উৎসাহ দিচ্ছিলেন নিজেই কিছু করার। সেজন্য নাজনীন ছাদ খামার করতে উৎসাহিত হয়েছেন।
তাদের খামারটি সমন্বিত একটি উদ্যোগ বলা যায়। স্মার্ট খামার বললেও ভুল হয় না। কেননা, খামারটি সম্পূর্ণ অর্গানিক। পাখিদের প্রাকৃতিক খাবার দেওয়া হয়। পাখি অসুস্থ হলে ওষুধ হিসেবে খেতে দেওয়া হয় তুলসি ও পুদিনা, ধনিয়া পাতা ও থানকুনি পাতা। কখনও কখনও আদা, রসুনও খাওয়ানো হয়। ফলে এসব পাখির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি।
নাজনীন জানান, তাদের খামারে রাতে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে। চিলেকোঠার চাদে বসানো হয়েছে সোলার প্যানেল। যা থেকে দিনে ঘোরে পাখা, রাতে জ্বলে বাতি। এছাড়াও তারা পাখিগুলোকে প্রচুর সবজি খাওয়ান। এসব সবজি তাদের ছাদ বাগানে উৎপাদন হয়। ভেষজ তুলসি, পুদিনা, থানকুনি পাতাও ছাদে টবে চাষ হচ্ছে।
পাখির বিষ্ঠা পচিয়ে সার তৈরি করেন তারা। ওই সার গাছে দেন। পাখির খাঁচা থেকে পড়ে যাওয়া খাবারের অচ্ছিষ্ট যেমন- গম, ধানও ডাল জাতীয় শস্য কুড়িয়ে জমিয়ে রাখেন। ট্রেতে মাটি বিছিয়ে, পানি ছিটিয়ে সেগুলোতে উচ্ছিষ্ট শস্যদানা বপন করেন। সেখানে গজায় সবুজ গাছ। এসব কচি চারা উৎপাদন করা হয়। এসব কচি চাড়া পাখিদের প্রিয় খাবার। এভাবে সমন্বিত কৌশলে তারা পাখি পালনে দিনে অভিজ্ঞ হয়ে উঠছেন। ফলে তাদের পাখি পালনের খরচ খুবই কম।
নাজনীনের স্বামী জামান বলেন, শখের বসে একটি খাঁচায় দুইটি কোয়েল পাখি দিয়ে শুরু। এখন কোয়েল, কবুতর, ঘুঘু, চীনা মুরগি মিলিয়ে ৪০টিরও বেশি পাখি আছে। প্রতি মাসেই দুই থেকে তিন জোড়া করে কবুতর ও ঘুঘুর বাচ্চা ফুটছে। এগুলোর বিক্রি করলে মাসে দুই থেকে তিন হাজার টাকা পাওয়া যাবে। যদিও আমরা এখনো পাখি বিক্রি শুরু করিনি। ছোট পাখি বড় করে এগুলো থেকে ডিম বাচ্চা পেতে চাই।
তিনি জানান, তার স্ত্রীকে উদ্যোক্তা হতে উৎসাহিত করতে ছাদ খামারটি গড়ে তোলেন। এটি তাদের একটি পাইলট প্রকল্প। প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে লিয়ানা কৃষি কালচার। তাদের বিশ্বাস খামারটি এক সময় বাণিজ্যিক রূপ নেবে।
পরিশ্রমী এই দম্পতি মনে করেন, শহরে যাদের ছাদে চিলোকোঠা, খোলা জায়গা কিংবা বারান্দা আছে তারা ছোট আকারের খামার করতে পারেন। খামারে ডিম, মাংস উৎপাদন করে নিজেরাই নিজেদের প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে পারেন। কেউ চাইলে শখ থেকেও উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ আছে।
এজেড/জেবি