রাজধানীর মৌচাক এলাকায় একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন নাজমা বেগম। মুগদা বিশ্বরোড থেকে বাসে উঠে অফিসে যেতে হয় তাকে। প্রায় প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৮টার দিকে রীতিমতো যুদ্ধ করে বাসে ওঠেন তিনি। অনেক সময় বাসে উঠতে না পেরে বেশি ভাড়া দিয়ে রিকশায় যেতে হয়। আবার অফিস থেকে বাসায় ফেরার সময় মালিবাগ রেলগেট এলাকা থেকে বাসে ওঠেন। কোনো দিন একটু দেরি হলেই ফেরার সময়ও তাকে যথারীতি যুদ্ধ করে বাসে উঠতে হয়।
নাজমা বেগম ঢাকা মেইলকে বলেন ‘এসব দুর্ভোগের কথা বলে আর কী হবে? আমাদের জন্য সংরক্ষিত আসন তো দূরের কথা, আমরা তো বাসেই উঠতে পারি না। আমরা বাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকি, আমাদের সিটে পুরুষ মানুষ বসে থাকে। এসব আইন-টাইন করে লাভ কী!’
বিজ্ঞাপন
একই এলাকা থেকে যাতায়াত করেন সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের শিক্ষার্থী শাপলা আক্তার। তিনিও জানালেন একই অভিজ্ঞতার কথা। শুধু নাজমা, শাপলা নয়। প্রতিদিন হাজারো নারীকে গণপরিবহনে যাতায়াত করতে এ ধরনের ভোগান্তির শিকার হতে হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, মঙ্গলবার (৮ মার্চ) সকাল ১০টার দিকে রাজধানীর খিলগাঁও পুলিশ ফাঁড়ি এলাকায় অনেক মানুষ বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই অফিসগামী। এর বড় একটি অংশ নারী ও শিক্ষাথী। বেশির ভাগ বাসই না থেমে দরজা লক করে চলে যাচ্ছে। এ সময় শনির আখড়া, যাত্রাবাড়ী থেকে আসা লাব্বাইক পরিবহনের একটি বাস এখানে এসে থামে। সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে বাসের ওপর। এরমধ্যে কয়েকজন বাসের রড ধরেই ঝুলে থাকেন। বাসে উঠার জন্য আরও কয়েকজন পেছন পেছন দৌড়াতে তাকেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উঠতে পারলেন না। যেখানে পুরুষেরই বাসে উঠতে এমন দুর্ভোগে পোহাতে হচ্ছে সেখানে নারীদের ভোগান্তি কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সংরক্ষিত আসন তো দূরের কথা বাসে উঠাই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
সোমবার (৭ মার্চ) সন্ধ্যা ৬টার দিকে রাজধানীর উত্তরা থেকে বাড্ডা রামপুরা হয়ে আসা রাইদা পরিবহনের একটি বাস মালিবাগ রেলগেট এলাকায় থামল। বাস থামতেই যাত্রীরা হুমড়ি খেয়ে পড়েন। এসময় চালক হেলপারকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন ‘মাহিলা উঠাইস না, সিট নাই’ অথচ সেই বাসে সব সিটেই পুরুষ বসা ছিল। এমনকি নারীর জন্য সংরক্ষিত যে আসনগুলো সেখানেও পুরুষ বসা। শুধু ইঞ্জিন কভারের উপর দুজন নারী বসা।
নারীর জন্য সংরক্ষিত আসনে পুরুষ বসা কেন জানতে চাইলে চালকের সহকারী বললেন ‘ওরা অনেক দূর থেইকা আসতাছে। আমি অহন কারে উঠাই দিমু।’আবার একই রুটে অনেক গাড়িতে দেখা গেছে নারীরা দাঁড়িয়ে থাকলেও সামনের সিটগুলোতে বসে আছে পুরুষ।
বিজ্ঞাপন
শুধু বাসে উঠতে ভোগান্তিই নয়, বাসের মধ্যে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয় অনেক নারীকে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের এক গবেষণা বলছে, গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় ৯৪ শতাংশ নারী মৌখিক, শারীরিক বা অন্য কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ৪১ থেকে ৬০ বছর বয়সী পুরুষদের দ্বারাই নারীদের বেশিরভাগ যৌন হয়রানির শিকার হন, এই হার ৬৬ শতাংশ। শারীরিকভাবে যৌন হয়রানির মধ্যে রয়েছে ইচ্ছাকৃত স্পর্শ করা বা চিমটি কাটা, কাছ ঘেঁষে দাঁড়ানো বা আস্তে ধাক্কা দেওয়া, নারীদের চুল স্পর্শ করা বা কাঁধে হাত রাখা ইত্যাদি৷ এসব যৌন হয়রানির মূল কারণ হচ্ছে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ না থাকা, বাসে অতিরিক্ত ভিড়, যানবাহনে পর্যাপ্ত আলোর অভাব।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গণসচেতনতা বাড়ানো ও আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে গণপরিবহনে নারী ভোগান্তি দূর করা সম্ভব। এ বিষয়ে মহিলা পরিষদের প্রোগ্রাম অফিসার কেয়া রায় ঢাকা মেইলকে বলেন ‘গণপরিবহনে নারী হয়রানি কমাতে সর্বপ্রথম যেটা করতে হবে আমাদের মধ্যে গণসচেতনতা বাড়াতে হবে। বিভিন্ন ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে সেটা সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে হোক বা সরাসরি হোক, ব্যাপকভাবে মানুষকে সচেতন করতে হবে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, বাসে নারীদের জন্য যে সংরক্ষিত আসন রয়েছে সেগুলোতো ফাঁকা পাওয়া যায় না। কোনো না কোনো পুরুষ সেখানে বসে থাকে। এসব সংরক্ষিত আসনে নারীদের বসার বিষয়টা নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে।’
আইন অনুযায়ী, গণপরিবহনের বড় বাসগুলোতে নয়টি এবং ছোট বাসগুলোতে ছয়টি আসন সংরক্ষিত রাখান বিধান রয়েছে। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে গণপরিবহনে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য আসন সংরক্ষণের বিধান করা হয়। সে সময় গণপরিবহনে নারীদের জন্য ৩০ শতাংশ আসন সংরক্ষণে বিআরটিএকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। পরে সিদ্ধান্ত হয়, বড় বাসে নয়টি এবং মিনিবাসে ছয়টি আসন নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ও বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য সংরক্ষণ করা হবে। সড়ক পরিবহন আইনেও গণপরিবহনে নারী, শিশু, বয়োজ্যেষ্ঠ ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত আসন রাখা হয়েছে। ওই আইনে সংরক্ষিত এসব আসনে অন্য কেউ বসলে তাকে এক মাসের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। শুধু সংরক্ষিত আসন নয়, আইনে চালকের পেছনে অর্থাৎ বাসের সামনে দিকের সারিতে সংরক্ষিত আসন রাখতে হবে। চালকের পাশের লম্বা আসন (ইঞ্জিন কাভারের পাশে) কিংবা দরজার পাশে রাখা যাবে না। আসনের ওপরে সংরক্ষিত আসন লিখে দিতে হবে। কিন্তু নগরীর অনেক গণপরিবহনে এর উল্টোচিত্র দেখা গেছে।
এ বিষয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘রাজধানীসহ শহর এলাকায় যে বাসগুলো চলাচল করে এসব বাসে তো সাধারণ যাত্রীরাই অনেক ভোগান্তির শিকার হচ্ছে, সেখানে নারীদের অবস্থা তো আরও শোচনীয়, অবর্ণনীয়। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এসব বিষয় বলে আসছি। যার মধ্যে আইনেও কিছু সংস্কারও আনা হয়েছে। আইনে জেল জরিমানার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এসব তো শুধু কাগজে-কলমের মধ্যেই সংরক্ষিত। বাস্তবে এর কোনো প্রয়োগ নেই। মোটাদাগে বলতে গেলে রাজধানীর গণপরিবহনে নারীদের যাতায়াতের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। আইনের ব্যবহার না থাকার কারণে নারীদের ভোগান্তি নিয়েই যাতায়াত করতে হচ্ছে। এখান থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে যথাযথ কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। শুধু আইন করলেই হবে না। এটা শতভাগ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা দরকার। ঢাকা শহরে কিছু মহিলা বাস সার্ভিস চালু আছে, যা অতি নগণ্য। মহিলা বাসের সংখ্যা বাড়াতে হবে।’
টিএই/জেবি