বসন্ত বাতাসের দোল খেয়ে ঝরে পড়ছে গাছের পাতা। সমতলের চা বাগানে চলছে পরির্চযার কাজ। বাগানে কোদাল দিয়ে একদল নারী শ্রমিক পরিচর্যার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। তাদের কাছে যেতেই চোখে পড়লো ঘাম নোয়ানো মুখখানা বাধা কাপড়ে।
কথা বলতেই হাসি দিয়ে বললো, আপনেরা কই থেকে আইছেন। বললাম, পঞ্চগড় থেকে। কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসলেন একজন নারী চা শ্রমিক। নাম জিজ্ঞেস করতেই বললো, ‘আমার নাম শান্তি রানী।’
বিজ্ঞাপন
জানা গেল, তার বাড়ি পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলায়। অভাবের সংসারে স্বামীসহ তিন কন্যা রয়েছে। স্বামী মাদকাসক্ত হওয়ায় গত কয়েকমাস আগে তিন কন্যা সন্তানকে সাথে নিয়ে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর এলাকায় পাথরের কাজ করতেন। বর্তমানে ভারত থেকে পাথর আমদানি কমে যাওয়ায় পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া সদরের একটি চা বাগানে কাজ নেন শান্তি রানী।
পরিবারের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, চা বাগানে কাজ করে দিনে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা যা আয়-রোজগার হয়, তা দিয়ে চলে তার অভাবের সংসার। পরিবারের ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখা, এনজিও’র কিস্তি, খাওয়া-দাওয়ার খরচের ব্যবস্থা করতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে তার।
শান্তির দিন শুরু হয় কাকডাকা ভোরে। সকালে ঘরদোর পরিষ্কার, সবার জন্য খাবারের আয়োজন— রোজকার গৎবাঁধা এসব কাজেই চলে যায় অনেকটা সময়। সকাল আটটার আগেই বাগানে কাজের জন্য ছুটতে হয়। টানা আট ঘণ্টা কাজ। তবে কাজ সেরে বাসায় ফিরতে ১০ ঘণ্টা পার হয়ে যায়। ঘরে ফিরে আবার সংসারের কাজ।
জানা যায়, পঞ্চগড়ে নারী শ্রমিকদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ঘরের কাজ সেরে জীবিকার জন্য মাঠে নেমে পড়েন মাঠে-ঘাটে নারী শ্রমিকরা। অনেক ক্ষেত্রে ঘরে-বাইরে নিগৃহীত হচ্ছেন তারা। এমনই হাজারও পাথর ও চা নারী শ্রমিক বাগানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। তাদের কষ্টের কথা কেউ শোনে না।
বিজ্ঞাপন
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় ১০ হাজার নারী শ্রমিক পাথর ভাঙা, প্রক্রিয়াকরণ, সমতলের চা চাষে, চা বাগানে পরিচর্যার কাজে, চা-পাতা সংগ্রহ, চা কারখানায়, ভবন নির্মাণে ও কৃষি কাজে পঞ্চগড় জেলাকে এগিয়ে নিতে কাজ করে যাচ্ছেন। এখনকার নারী শ্রমিকরা প্রতিদিনই পুরুষের পাশাপাশি সমানভাবে কাজে অংশ নিচ্ছেন। তবে কম মজুরি দেওয়া হয় বলে অভিযোগও রয়েছে।
তেঁতুলিয়া উপজেলার চারদেশীয় বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর প্রতিদিনই পুরুষের পাশাপাশি সমানতালে কাজে অংশ নিচ্ছেন নারী শ্রমিকেরা। তবে তাদেরকে তুলনামূলক কম মজুরি দেওয়া হয়। জানা গেছে, জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর এলাকায় একেকজন পুরুষ পাথরশ্রমিক পাথর ভাঙা মেশিনে কাজ করে প্রতিদিন (আট ঘণ্টা) ৫০০ থেকে ৪৫০ টাকা মজুরি পাচ্ছেন, কিন্তু নারী শ্রমিকেরা পাচ্ছেন ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা।
তেঁতুলিয়া সদর ইউনিয়নের সর্দারপাড়া এলাকার পাথর ভাঙা শ্রমিক রেহানা বেগম বলেন, ৯ বছর ধরে পাথর ভাঙার কাজ করছি। ২ মেয়ে ও ১ পুত্র সন্তানের জননী তিনি। স্বামী মারা গেছেন প্রায় ৫ বছর হলো। এক মেয়েকে কোনভাবে বিয়ে দিতে পেরেছি কিন্তু ছোট ছেলে-মেয়ে দুটো লেখাপড়া করছে। অভাবের সংসারের চাহিদা মেটাতে অল্প মজুরি দিয়ে জীবন নির্বাহ করতে হয়।
তিনি আরও বলেন, আগে সবারই মজুরি কম ছিল, তখনও আমাদের নারী-পুরুষের মধ্যে মজুরি পার্থক্য ছিল। এখন মজুরি কিছুটা বেড়েছে, কিন্তু আমরা পুরুষদের সঙ্গে সমানতালে কাজ করেও মজুরি তুলনামূলক কম পাচ্ছি।
সদর উপজেলার দর্জিপাড়ার একটি চা-বাগানের নারী শ্রমিক মাহফুজা বেগম বলেন, ‘চায়ের মৌসুম শুরু হলেও এখনও পুরো দমে পাতা সংগ্রহ শুরু হয়নি। বর্তমানে আমরা দৈনিক হাজিরা হিসেবে কাজ করছি। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে প্রতিদিন আট ঘণ্টা কাজ করে আমরা ৩০০ টাকা পাই। আর পুরুষেরা আমাদের সঙ্গেই কাজ করে পায় ৫০০ টাকা। সমান কাজ করলেও আমাদের মজুরি কম।
পাথর ক্রাশিং কাজে নিয়োজিত ফাতেমা নামে এক নারী শ্রমিক বলেন, ‘আমরা পাথর ক্রাশিং মেশিনে কাজ করছি। সারা দিন সমান কাজ করেও আমাদের মজুরি ৩০০ টাকা আর পুরুষদের মজুরি ৫০০ টাকা ‘
চা বাগান মালিক নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, বর্তমানে চা পাতার মূল্য ১৫ থেকে ১৬ টাকা নেমে গেছে। সার, পানি আর শ্রমিকদের মজুরি দিতেই আমাদের কিছু থাকে না। চা বাগানগুলো প্রথম রাউন্ডে কম পাতা আসে। ফলে চাষি ও বাগান মালিকরা বিপাকে পড়েছেন। কাঁচা চা পাতার দাম ২৪ টাকা হলে নারী শ্রমিকরাও ন্যায্য মজুরি পেত।
স্থানীয় পাথর ব্যবসায়ী ফারুক হোসেন বলেন, ‘পুরুষরা যে কাজটি খুব তাড়াতাড়ি করতে পারে সেই তুলনায় নারীরা ওই কাজ বেশি সময় নিয়ে করে।’ তার মতে— ‘পুরুষ শ্রমিকরা বেশি পরিশ্রম করে থাকে। তাই পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় নারী পাথর শ্রমিকদের কম মজুরি দেওয়া হয়।’
পঞ্চগড় বেসরকারি সংস্থা পরস্পর’র নির্বাহী পরিচালক আখতারুন নাহার সাকী বলেন, পুরুষদের মতই সকাল থেকে বিকেল অবধি সমানভাবে কাজ করেও নারী শ্রমিকরা মুজুরি বৈষম্যের শিকার। পাশাপাশি নারী শ্রমিকরা স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে কাজ করলেও কোন ক্ষতিপূরণ পায় না। এমনকি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোন চিকিৎসার ব্যবস্থাও করে না মালিকপক্ষ। এটা মালিক পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি ও মননশীলের অভাব বলে মনে করি। মানুষের বিকাশের যত সুযোগ, তার সবকিছু থেকেই তারা বঞ্চিত।
তিনি আরও বলেন, আমরা বরাবরই এসবের প্রতিবাদ করে আসছি। আমরা চাই এই বৈষম্য দূর হোক। এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ শ্রম আইন নিয়ে কাজ করা সংস্থার দৃষ্টি আকর্ষণ করবো।
এ বিষয়ে তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহাগ চন্দ্র সাহা বলেন, তেঁতুলিয়াসহ পুরো পঞ্চগড় জেলায় হাজার হাজার বেকার নারী শ্রমিকদের কর্মস্থানের সৃষ্টি হয়েছে (পাথর শ্রমিক ও চা শ্রমিক হিসেবে)। বেকার নারীরা চা বাগানে কাজ করে অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল হওয়ার পাশাপাশি পঞ্চগড়ের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখছেন৷
তিনি বলেন, আমরা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নারী শ্রমিকদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছি৷ সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে প্রতি বছর চা শ্রমিকদের ৫ হাজার টাকা করে সহযোগিতা করা হয়। সেই তালিকায় যেন নারী শ্রমিকদেরকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় সে জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদ্যাগ নেওয়া হবে৷ পাশাপাশি পাথর শ্রমিক হিসাবে যে নারীরা কাজ করেন তাদেরকেও সহযোগিতা করা হবে।
এইচই/এএ