রোববার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

প্রতিটি বাধাই আমাকে শক্ত করেছে

ডা. ফারিয়া তাবাসসুম তন্বী
প্রকাশিত: ০৮ মার্চ ২০২২, ১১:৫০ এএম

শেয়ার করুন:

প্রতিটি বাধাই আমাকে শক্ত করেছে

আমি পেশায় ডেন্টিস্ট। ২০০৮ সালে ঢাকা ডেন্টাল কলেজ থেকে বের হয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতাম পোস্ট গ্রেজুয়েশন করব। কিন্তু হাসব্যান্ড সরকারি চাকরি করতেন, তাই ঢাকার বাইরের পোস্টিংটা আমার পড়ার অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়ালো। আট দশটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই নিজের পরিবারের এবং শ্বশুরবাড়ি থেকে পোস্ট গ্রেজুয়েশনের যুদ্ধে কোনো সাহায্য পাইনি।

ছোট বাচ্চা নিয়ে অনেক কষ্টে এম. এস (অর্থোডন্টিক্স) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ হয়। এক মাস পরেই এফ সি পি এস প্রথম পর্বে (কনসারভেটিব ডেন্টিস্ট্রি অ্যান্ড এন্ডোডনটিক্স) পাস করি।


বিজ্ঞাপন


জীবন চলছিল, ছোট বাচ্চা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলাম। এর মধ্যে কোমরের অপারেশন করাতে হয়েছে। অসংখ্য কোমর্বিডিটি নিয়ে দুইবার কোভিড আক্রান্ত হওয়ার পর এম এস ডিগ্রি হাতে এলো জানুয়ারি ২০২১। এখন আমি সিলেট সেন্ট্রাল ডেন্টাল কলেজের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছি।

২০০৮ এ বিডিএস পাস করা থেকে শুরু করে ২০২২ মার্চে এসে সহকারী অধ্যাপক পোস্টটা কেউ আমাকে এমনি দিয়ে দেয়নি। অর্জন করতে হয়েছে। সৎ থেকে উপরে উঠার কোনো শর্ট-কাট রাস্তা নেই। আমার মনে পড়ে, কতদিন বিকাল চারটা পর্যন্ত আমার মেয়ে সকালের নাস্তা খাওয়ার পর না খেয়ে বসেছিল আমার জন্য। বাচ্চা কারো দুর্বলতা নয়। বাচ্চা সারাজীবন ছোট থাকে না। অনেক নারী নিজের প্রফেশনকে ছেড়ে দিয়েছেন শুধু বাচ্চার ভালোর জন্য। তাদের জন্য বলবো, একটু একটু করে ক্যারিয়ার ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যান। হতাশ হবেন না। বাচ্চা যখন একটু বড় হবে, তখন সব ঠিক হয়ে যাবে। যে মা নয় মাস সন্তান গর্ভে ধারণ করেন তার মতো শক্তিশালী, ধৈর্যশীল কে আছে? তাই প্রয়োজনের গুরুত্ব অনুযায়ী কাজের অগ্রাধিকার দিতে হবে। কখনও একটু নিজে আগাতে হবে, কখনও পরিবারের অন্যদের এগিয়ে দিতে হবে। তবুও কাজ ছেড়ে দেওয়া যাবে না। আপনি নারী আপনাকে দিয়ে সব কাজ করা সম্ভব, তা নিজের মনে ধারণ করতে হবে। নারীদের অর্থনৈতিক মুক্তি অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

নারীদের পিছিয়ে পড়া আমাকে সব সময় ভাবায়। আমি এবং আমার আরেক সহকর্মী ডা. সোনিয়া জাহান বিথীর (সহকারী অধ্যাপক) উদ্যোগে ডেন্টালের পিছিয়ে পড়া, বাচ্চার জন্য পোস্টগ্রেজুয়েশন না করতে পারা, পারিবারিক সমস্যায় জর্জরিত আগ্রহী  ফিমেল ডেন্টিস্টদের জন্য ট্রেইনিংয়ের ব্যবস্থা করেছি। শতাধিক ফিমেল ডেন্টিস্ট গত বছরের  অক্টোবর মাস থেকে ট্রেনিং নিচ্ছেন কাজে, সেই সাথে রাত ১০.৩০ থেকে ১২.৩০ পর্যন্ত তাদের রাত্রকালীন পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের জন্য নামমাত্র মূল্যে অনলাইন কোচিং করিয়ে যাচ্ছি।

সবাই বাচ্চা নিয়ে ক্লাসে এবং ট্রেনিং করছেন। এই কয়েক মাসে অসংখ্য ফিমেল ডেন্টিস্ট তাদের কনফিডেন্স ফিরে পেয়ে নিজে চেম্বার দিয়েছে। আমাদের ফিমেল ডেন্টাল সার্জনদের একটি ফেসবুকভিত্তিক গ্রুপ আছে। এখানে আমরা সবাই সমস্যা শেয়ার করার সাথে সাথে সমাধান বের করি। বিভিন্ন পেইজ প্রমোট করি তাদের, যারা ছোট বাচ্চার জন্য ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। আমার কাছে কোনো কাজই ছোট না।


বিজ্ঞাপন


আমরা যদি আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপের মতো বড় দেশের দিকে তাকাই, তারা এক একজন অনেকগুলো কাজ করছে। তারা নিজের পড়ার সাবজেক্টের বাইরেও চাকরি করে। আমাদের চিন্তা -ভাবনাগুলো যদি আরও আধুনিক করতে পারি, কেউ আর বেকার থাকবে না।

আমাদের মেয়েদের কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার বড় বাধা কনফিডেন্সের অভাব, পরিবারের সাহায্য এবং সঠিক পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনা হতে হবে গ্র্যাজুয়েশনের সময় থেকে। শুধু স্বপ্ন দেখলেই হবে না, সঠিক বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে যেতে হবে। পরিবারের সাহায্য সবার থাকে না। সেক্ষেত্রে ভেবে নিতে হবে, ডিগ্রি আমার, চাকরি আমার, তাই কষ্টও আমার। ওই পর্যন্ত নিজেকে তৈরি  করে নিতে হবে। কেউ আপনাকে সাহায্য করবে না, এই ভেবে যদি এগিয়ে যেতে পারেন, তাহলে নিজের মনের দিক থেকে অন্যের ওপর রাগ ক্ষোভ  কমে গিয়ে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন। যদি জীবনে অন্যের সাহায্য কম পান, তাহলে নিজে অন্যকে সাহায্য করে মানসিক প্রশান্তি উপভোগ করুন।

জীবনে সফলতা মানে আমার কাছে শুধু ক্যারিয়ার নয়। আমি অনেক ক্যারিয়ারে উচ্চ আসনের মানুষকে দেখেছি, যারা সুখী নন। আমরা আমাদের ক্যারিয়ারের পাশাপাশি আমাদের পরিবারকে যেন মূল্য দিতে শিখি। ব্যক্তি আমি, সমাজের অন্যদের জন্য কতটা করলাম, কতটা একাডেমিকভাবে ভালো করছি, কতটা প্রফেশনালি ভালো করছি এবং কতটা পারিবারিকভাবে ভালো আছি সবগুলোই গুরুত্বপূর্ণ।

যে তার পরিবার, সমাজ এবং ক্যারিয়ার সবকিছুতে সামঞ্জস্য আনতে পারে তিনিই আমার কাছে সফল নারী। শুধু ক্যারিয়ার  ভালো হলেই যদি সফল নারী হন, তাহলে গৃহিণীরা কি সফল নন? বাচ্চা ভালো মতো মানুষ করাও সফলতার মধ্যে পড়ে।

ক্যারিয়ারের সফলতার পাশাপাশি, অন্য পিছিয়ে পড়া নারীদের নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। পরিবারের অন্য সদস্যদের কথা ভেবে, কীভাবে কতটা ত্যাগ করে, নিজের খুব ক্ষতি না করে, সবাইকে নিয়ে ভালো থাকা যায়, এরই মধ্যে কীভাবে ক্যারিয়ার গড়া যায় এই চেষ্টাই করতে হবে।

আমি আমাকে খুব ভালোবাসি। নিজেকে না ভালোবাসলে কনফিডেন্স আসবে না, স্বপ্ন পূরণ হবে না, বাধাগুলো অতিক্রম করা হবে না। প্রতিটি বাধাই আমাকে শক্ত করেছে। মনোবল বাড়িয়েছে। নিজেকে সম্মান, নিজেকেই প্রথমে করতে হবে। কোনো অবস্থায় নিজেকে অসম্মানিত করা যাবে না। জীবনে চলতে গেলে অসংখ্য বাধা আসবে বিভিন্ন দিক থেকে। আপনি কতটা বুদ্ধিমত্তা, সাহসিকতার সাথে সেগুলো মোকাবেলা কর‍তে পারছেন সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি বিফলতার গল্পই একদিন সফল ব্যক্তির জীবনীতে মূল্যবান শিক্ষনীয় হয়ে ওঠে। সফলতার পাশাপাশি বিফলতাকে ভালোবাসতে জানতে হবে।

সবাইকে নারী দিবসের শুভেচ্ছা।

লেখক: ডা. ফারিয়া তাবাসসুম তন্বী, মুখ ও দন্তরোগ বিশেষজ্ঞ; সহকারী অধ্যাপক, সিলেট সেন্ট্রাল ডেন্টাল কলেজ, সিলেট

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর