রোববার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

‘এত কষ্ট করেও আমরা যে ট্যাহা পাই, বেডান পায় তার ডাবল’

জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৮ মার্চ ২০২২, ১২:৫৬ পিএম

শেয়ার করুন:

“আমার ঘরে পাঁচজন খাওয়ার মানুষ। বেডানডা (স্বামী) অসুখের লাইজ্ঞা কোনও কাম (কাজ) করবার পায় না। ডাক্তর (ডাক্তার) দেহাবার ট্যাহাও তো নাই। ইনু (চাতাল মিল) সারাদিন কাম কইরা ১৮০ ট্যাহা পাই, এইডা দিয়ে কী কিনমু। বাজারে আগুন। বাপুরে, সংসারডা চলে না।”

কথাগুলো বলতে গিয়ে যেন গলা ধরে আসছিল শেরপুর সদরের চরশেরপুর থেকে আসা চাতাল শ্রমিক জহুরা বেগমের। তার স্বামী অসুস্থতার কারণে ঘরবন্দি। সবকিছুর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় চার ছেলে-মেয়েসহ পাঁচজনের সংসার চালাতে এখন চোখেমুখে ঘোর অন্ধকার জহুরার।


বিজ্ঞাপন


শুধু জহুরা-ই নন, রোদ, বৃষ্টি উপেক্ষা করে চাতাল মিল, ইট ভাটা, বন্দরে পাথর ভাঙ্গা, হোটেলে রান্নায় সহায়তা, হিমাগারে আলু বাছাই, নার্সারিতে মাটির কাজসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রমিকের কাজ করেন এমন অংসখ্য নারী। পরিবারের দিকে তাকিয়ে বিভিন্ন খাতে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন শেরপুরের নারী শ্রমিকরা। কিন্তু একজন পুরুষ শ্রমিকের সমান কাজ করেও সমান বেতন পান না তারা। দিনভর হাড়-ভাঙা খাটুনির পর যে মজুরি পান তা দিয়ে সংসার চালানো দায়। দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অথবা এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে চলতে হয় তাদের। বছরের পর বছর বেতন বৈষম্য শিকার হলেও মজুরির কোন পরিবর্তন হয় না। তাই নারী নেত্রীরা দাবি তুলেছেন, নারীর অধিকার, মজুরিসহ নানা বিষয়ে সমঅধিকার নিশ্চিতের।

নারী শ্রমিকরা বলছেন, একই সময়ে কাজে এসে পুরুষের পরে কাজ থেকে ফিরলেও তারা মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। পুরুষেরা যেখানে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা পান, সেখানে দিন-রাত পরিশ্রম করেও নারীরা পান ১৮০ থেকে ২০০ টাকা। অথচ সমান কাজ করেন তারা।

sherpur-women-labor-2চাতাল মিলের শ্রমিক হুসনে আরা বলেন, ‘যেসময় মানুষ ঘর থাইক্কা (থেকে) বাইর (বের) অইতে পারে না, তখন কাঠফাটা রোদে আমরা ধানের খলায় ধান শুকাই। আবার মেঘের দিন অইলে এক কাপড়েই ভিজি, অই কাপড়েই শুকাই। সকালে আটটা, নয়টার দিকে আহি (আসি) আর ফিরি সন্ধ্যার আগদিকে। এত কষ্ট করেও ট্যাহা পাই ১৮০ডা। আর বেডান (পুরুষরা) পায় ডাবল— ৩৫০ থাইক্কা ৪শ’ ট্যাহা। 

চাতাল মিলের আরেক শ্রমিক জুলেখা বানু বলেন, আমি কুড়া ঝাড়ি। সারাদিনে মাইনা পাই ২শ’ ট্যাহা। আর একই সময় আইসা বেডান (পুরুষ) পায় ৪০০ থেকে ৪৫০ ট্যাহা (টাকা)।


বিজ্ঞাপন


তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চাতাল মালিক বলেন, জেলার প্রায় সবগুলো চাতাল বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা যারা দু-একটা চালাচ্ছি তাও লোকসানে। এখন শ্রমিকদের মাইনে কেমনে বাড়াবো। আর কোনও ব্যবসা জানা নেই, তাই লোকসানেও কোনোমতে ধরে রেখেছি। 

একই পরিস্থিতি ইটভাটাগুলোতেও। যেখানে নারীরা পান সপ্তাহে খুব বেশি হলে ১৫ শ’ থেকে দুই হাজার টাকা। আর পুরুষদের অগ্রীম টাকা দিয়ে কাজে আনা হয়। বেতন কম, এ নিয়ে সরদারকে অভিযোগ জানালে কাজ থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয় বলেও জানান নারী শ্রমিকরা। 

নার্সারিতে কাজ করেন ঝিনাইগাতী উপজেলার কাংশা ইউনিয়নের পানবর গ্রামের চাঁন মিয়ার স্ত্রী সালমা বেগম। তার সাথে কথা হয় ঢাকা মেইলের। সালমা বেগম জানান, প্রতিদিন প্রায় তিন কিলোমিটার রাস্তা পায়ে হেঁটে কাজে আসেন তিনি। সকাল ৮টায় কাজে এসে যেতে হয় বেলা ডোবার সময়। সারাদিন মাটি কাটেন, মাটি ঝুড়িতে তুলে দেন আবার মাথায় করে মাটি বহনও করতে হয়। মজুরি পান ২শ’ টাকা, যা দিয়ে তার সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে উঠেছে। আর সাথে পুরুষ শ্রমিকরা একই সময়ে কাজে এসে মজুরি পান ৪শ’ থেকে ৫শ’ টাকা। 

একই অবস্থার কথা জানান ওই ইউনিয়নের গুরুচরণ দুধনই গ্রামের আয়েশা বানু। তিনি বলেন, ‘বাপুরে সব জিনিসের দাম বাড়লেও আমগোর কামের (কাজের) দাম বাড়ে না। সারাদিনে দুইশ’ ট্যাহা দেয়, এই ট্যাহা (টাকা) দিয়ে সংসার চলে না। খুব কষ্টে আছি, আমগোর কষ্ট কেউ বুঝে না।’ 

ঝিনাইগাতীর ছোট গজনী এলাকার কৃষি শান্তি রানি, মালিনী কোচ, পল্লবী রেমা, সেলচি সাংমা বলেন, আমরা কোনওভাবেই পুরুষের চেয়ে কাজ কম করি না। পুরুষের সমান সমানই কাজ করি। পুরুষদের মতোই আমরা সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কাজ করি। কিন্তু এরপরও আমাদের মজুরি পুরুষের তুলনায় অর্ধেক।

আদিবাসী নারী নেত্রী কেয়া নখরেখ ক্লোরিডা ঢাকা মেইলকে বলেন, একজন নারী কোনোভাবেই পুরুষের চেয়ে কম কাজ করেন না। বিশেষ করে আমাদের গারো পাহাড়ের আদিবাসী নারীরা কৃষি কাজে খুবই পারদর্শী এবং কর্মঠ। একজন পুরুষের সমানই কাজ করেন তারা। তাই মজুরি বৈষম্য মেনে নেয়া যায় না। বিষয়টি নিয়ে সরকারিভাবে মাঠপর্যায়ে কাজ করা উচিত। নারী শ্রমিকদেরও সচেতন হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।

sherpur-women-labor-3মানবাধিকারকর্মী ও স্থানীয় মহিলা শ্রমিক লীগ নেত্রী সাবিহা জামান শাপলা বলেন, শেরপুরে এখনও নারী-পুরুষদের বৈষম্য দূর হয়নি। বছরের পর বছর বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তারা। নারী শ্রমিকরা তাদের অধিকার সম্পর্কে কম সচেতন হওয়ায় তাদের দিয়ে কর্তৃপক্ষ সহজেই বেশি কাজ আদায় করে নিতে পারেন। কিন্তু নারীর শ্রম পুরুষের চেয়ে কম না হলেও তাদের বেতন বৈষম্য চোখে পড়ার মতো। 

তিনি বলেন, এ ধরণের মানসিকতা থেকে সমাজ মুক্তি পাক। পাশাপাশি সমাজে নারী ও পুরুষের মজুরি বৈষম্য দূর করে নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হোক বলেও দাবি জানান তিনি।

জাতীয় মহিলা সংস্থার জেলা চেয়ারম্যান নাছরিন বেগম ফাতেমা বলেন, নারী-পুরুষের বৈষম্য অনেক আগে থেকে চলে আসছে। বৈষম্য রোধে আমরা বিভিন্ন সময় সভা সেমিনার করেছি। নারীদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেছি। এ জন্য সমাজের সবস্তরের মানুষকে এক কাতারে দাঁড়াতে হবে। তাহলেই নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর হবে।

জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা লুৎফুল কবীর ঢাকা মেইলকে বলেন, পুরুষের চেয়ে নারী শ্রমিকের মজুরি অর্ধেক হওয়া সত্যি দুঃখজনক। সরকারি কোন দফতরে বেতন বৈষম্য নেই, তবে ব্যক্তি মালিকানায় এ বৈষম্য রয়েছে। এই বৈষম্য নিরসনে সচেতনতামূলক সভাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছি।

এএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর