সবে ভোরের আলো ফুটেছে। একজন-দুজন কিংবা কখনও দলবেঁধে টুকরি-কোদাল কাঁধে ঝুলিয়ে জড়ো হন চৌরাস্তার মোড়ে। এরপর চলে দর কষাকষি। চেহারা ও শক্তি-সামর্থ্য দেখে দৈনিক চুক্তিতে কাজের জন্য নেওয়া হয় কাউকে। আবার অনেকেই অপেক্ষায় বসে থেকে নিরাশ হয়ে খালি হাতে ফিরে যান ঘরে।
মৌলভীবাজার শহরের চৌমোহনা চত্বরে শতাধিক মানুষের জটলার এই চিত্র প্রতিদিনের। যেখানে ভাসমান শ্রমিকদের শ্রম বেচাকেনার হাট বসে।
বিজ্ঞাপন
ঝড়-বৃষ্টি, তাপদাহে কিংবা হাড়কাঁপানো শীত উপেক্ষা করে জীবন জীবিকার তাগিদে প্রতিদিনই দিনমজুররা এই হাটে আসেন। ভোর থেকে শুরু হয়ে সকাল দশটা অব্দি চলে দর কষাকষি ও শ্রম বেচাকেনা।
আগন্তুক দেখলেই ভিড় করে শ্রমজীবী মানুষগুলো। তাদের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা যায়, এই চত্বর ঘিরে চারদিকের বিভিন্ন দোকানের বারান্দা, ফুটপাতে টুকরি-কোদাল নিয়ে কাজে অপেক্ষায় থাকেন তারা। শ্রমিক নিতে আসা লোকজন বিভিন্ন নির্মাণ কাজ, ধানকাটাসহ গৃহস্থালির নানা কাজের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী পছন্দসই শ্রমিককে নিয়ে যান কর্মক্ষেত্রে। শ্রমজীবীরা দিন চুক্তি অথবা কাজ চুক্তিতে মহাজনের কাছে বেচাকেনা হয়ে থাকেন। কাজ অনুযায়ী প্রতিদিনের মজুরি ৬শ থেকে ৭শ টাকা। তবে বেলা বাড়লে দিনমজুরের মূল্যও কমতে থাকে।
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি ঢাকা মেইল প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপ হয় সত্তরোর্ধ্ব সিদ্দিক আলীর। তিনি বলেন, বয়স হওয়ায় এখন কাজকাম কম পাই। সপ্তাহে তিন-চার দিন কাজ জুটলেও মজুরি পাই কম। বিশ বছর আগে দৈনিক ২শ টাকা মজুরিতে কাজ শুরু করি, এখন ৫শ-৬শ টাকা পাই। সময়ের সঙ্গে জিনিসপত্রে দাম বাড়ায় সংসার চালাতে এখন বড়ই কষ্ট হয়।
সিদ্দিক আলী পাশে দাঁড়ানো আব্দুল জব্বার নামের চল্লিশোর্ধ এক শ্রমিক বলেন, সিদ্দিক চাচা এই বয়সেও ভালো কাজ করতে পারেন। যারা বোঝেন তারা কাজ জানা মানুষদের মূল্যায়ন করেন। আমি দীর্ঘ তেরো বছর ধরে দিনমজুরের কাজ করি। যখন যে কাজ পাই সেই কাজই করি।
মে দিবসের প্রসঙ্গ তুলতেই এই শ্রমিক বলেন, ১ মে শ্রমিক দিবস জানি। কিন্তু এই দিবসের কোনো সুফল আমাদের জীবনে আসে না। প্রতিদিনই কাজের জন্য এখানে আসতে হয়। আমাদের শ্রমিক দিবসেও কাজ করতে হবে, পেটের তাগিদে।
মধ্যবয়সী শ্রমিক রহমান আক্ষেপের সুরে বলেন, প্রতিটা জায়গার শ্রমিকদের নিয়মনীতি থাকলেও ভাসমান শ্রমিকদের কোনো অধিকার নেই। নিয়মকানুন নেই। মালিক যখন তখন কটুকথা বলেন। অনেক সময় কাজের সঠিক মজুরি না দিয়ে বিদায় করে দেন। আমাদের তো কোনো সংগঠন নেই যে কারও কাছে গিয়ে বিচার চাইব।
এমন আলাপচারিতায় যোগ দেন নুরুল মিয়া। তিনি বলেন, আমাদের এক কাজের কথা বলে নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের কাজ করায় মালিকপক্ষ। প্রতিবাদ করলে গায়ে হাত তোলে। মালিকপক্ষ অনেক সময় আমাদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করে। অতিরিক্ত সময় কাজ করাতে বাধ্য করে। এই বিচার কার কাছে দেব।
দিনমজুর হাটের শ্রমিক চাঁদনীঘাট এলাকার রফিকুল জানান, ৫ জনের সংসারে তার একার উপার্জনের ওপরই তাদের খাওয়া-পরা নির্ভরশীল। তাই দিনরাত কাজ করেও তার অভাব যায় না।
শহরের গোবিন্দশ্রী এলাকার একটি মেসে থাকেন জহির মিয়া। তিনি জানান, মেসে থাকা খাওয়ার জন্য একজনের সপ্তাহে খরচ হয় ১৮শ থেকে ২ হাজার টাকা। মাসে ২০ থেকে ২২ দিন কাজ না পেলে বাড়িতে টাকা পাঠানো কষ্টকর হয়ে যায়।
এই হাটের নতুন সদস্য বিশ বছর বয়সী সুখেন জানান, তার বাবাও একজন দিনমজুর ছিলেন, এখন তিনি রোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী। সংসারের দায়িত্ব পড়েছে। তাই মা ও ছোট দুই ভাইবোন এখন তার রুজির ওপরেই চলে।
শ্রমিকদের সর্দার মইন আলী বলেন, শক্তি সামর্থ্য, চেহারা দেখে মালিকরা শ্রমিক নিয়ে যান। এই তো কিছুক্ষণ আগে এক শ্রমিকের শারীরিকভাবে একটু দুর্বল দেখাচ্ছিল বলে এক মালিক দরদাম করার পরও তাকে নিয়ে যায়নি। এ বিষয়গুলো খুব খারাপ লাগে।
তিনি বলেন, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের জন্য আইনকানুন থাকে। কিন্তু এই ভাসমান শ্রমিকদের জন্য কোন আইন নেই। যে যার ইচ্ছেমতো আমাদের শোষন করে। প্রতারিত করে। তিনি সরকারের কাছে দাবী জানান, তাদের মতো ভাসমান শ্রমিকদের জন্য যেন একটি নীতিমালা করা হয়।
প্রতিনিধি/এইচই