জহুরুল ইসলাম এক সময় ময়মনসিংহ জেলার একটি গ্রামে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। কিন্তু ১০ বছর আগে এলাকার এক ব্যক্তির হাত ধরে ঢাকায় আসেন। শুরু হয় ঢাকায় তার রাজমিস্ত্রির কাজ। শুরুর দিকে ভালোই কাজ পেতেন। কিন্তু গত বছর থেকে তার কাজে ভাটা পড়েছে। মজুরি বাড়লেও কাজ কম। ফলে আগের মতো আয় হয় না। পরিবার নিয়ে থাকতেন ঢাকা উদ্যান এলাকায়। কিন্তু আয় রোজগারের অবস্থা ভালো না হওয়ায় বাধ্য হয়ে পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়েছেন জহুরুল।
সোমবার (১ মে) সকাল দশটার দিকে মোহাম্মদপুরের টাউন হল বাজার জামে মসজিদের সড়কের পাশে কাজ পাওয়ার অপেক্ষায় থাকা জহুরুল তার কষ্টের কথাগুলো জানান।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, আজ সকালে আসছি। কিন্তু এখনো কেউ ডেকে নিল না। কাজ পাব কিনা তাও জানি না।
জহুরুলের কথায় স্পষ্ট বোঝা যায়, কাজ পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছেন। তার সাথে কথা সময় পাশেই আরও চারজন পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তি রাজমিস্ত্রি হিসেবে কাজ করার জন্য সরঞ্জামসহ বসে ছিলেন। অপেক্ষায় আছেন, কেউ এসে দরদাম করে তাদের কাজের জন্য নিয়ে যাবেন।
তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সম্প্রতি ঢাকায় রাজমিস্ত্রির পেশার লোক বেড়েছে। ফলে ভাগ হয়ে যাচ্ছে কাজ। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে ঢাকায় কাজ পাওয়া নিয়ে ভাসমান রাজমিস্ত্রিদের সারাদিন দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। ফলে নিয়মিত কাজ না পেয়ে আর্থিক সংকটে অনেকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
এটি শুধু রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার ভাসমান শ্রমিকদের চিত্র নয়, এ অবস্থায় এখন পড়েছেন ঢাকার অলিগলিতে শ্রম বিক্রি করে সংসার চালানো শ্রমিকদের।
বিজ্ঞাপন
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোহাম্মদপুরের পাশাপাশি প্রতিদিন সকালে আদাবর, শিয়া মসজিদ, ফকিরাপুল, মিরপুর, হাজারীবাগ, যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর তিন রাস্তার মোড়, লালবাগ, হাতিরপুল, বকশীবাজার, দয়াগঞ্জ মোড় ও পুরান ঢাকায় এভাবে বিভিন্ন পেশার ভাসমান শ্রম বিক্রয়কারী শ্রমিকরা জড়ো হন। এরপর তাদের সাথে দরদাম করে যারা কাজ করাতে ইচ্ছুক তারা নিয়ে যান।
তাদের মধ্যে কেউ সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত কাজ করেন। আবার কেউ সকাল ১০টায় কাজ শুরু করে শেষ করেন ৬টায়। এর মাঝে তাদেরকে কেউ দেন নাস্তা, আর কেউ দেন দুপুরের খাবার। তবে আগের মতো আর দুপুরের খাবারও দেয়া হয় না। তার বিনিময়ে খাবারের জন্য দেয়া হয় সামান্য টাকা।
দুই যুগ ধরে মোহাম্মদপুর টাউন হলের সামনে বসেই শ্রম বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন রমিজ উদ্দিন সরকার (৫৫)। এই শ্রম বিক্রি করেই এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন, ছোট ছেলে পড়াশুনা করে গ্রামে। তবে ঢাকায় তিনি একাই থাকেন। তার ভাষ্য, পরিবার নিয়া থাইক্যা কি করুম, পোষাইতে পারি না। হের লাইগ্যা একা থাকি।
অন্যদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিন সকাল ছয়টার আগে তারা মোহাম্মদপুর টাউন হল এলাকায় আসেন। এরপর তারা সেখানে তিন রাস্তার মোড়ের মসজিদের বিপরীত পাশের ফুটপাতে জড়ো হন। ভোরের আলো ফুটলেই লোকজন আসেন এবং তাদের ডেকে দরদাম করে কাজের জন্য নিয়ে যান। তবে সম্প্রতি বেশিরভাগ সময়ই দরদামে মিলে না।
গত ১০ বছর থেকে মোহাম্মদপুর এলাকায় রঙমিস্ত্রি হিসেবে কাজ করেন শরিফ। তিনি জানান, দুই বছর থেকে রঙের কাজ কমেছে। আগের মতো কাজ পাওয়া যায় না। বিশেষ করে রমজানে তেমন কাজই করতে পারেনি।
বরিশাল থেকে আসা এই দিনমজুর বলেন, মজুরি হয় হাজার টাকা, কিন্তু অনেকেই দিতে চায় না। আমরাও বেশি তর্কে যাই না। কারণ, সংসার তো চালাইতে হবে। একেবারে কিছু না পেলে তো চলবে না।
সেখানে অবস্থান করা অন্যদেরও ভাষ্য একইরকম। তারা জানান, ঢাকায় আগে রঙের কাজ জানা লোকের সংখ্যা কম ছিল। কিন্তু ইদানীং গ্রাম থেকে বেকার লোকজন এসে ভিড় করায় সেই কাজ কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এখন গ্রাম থেকে বেকার যুবকদের ধরে এনে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা বেতন দিয়ে রঙের কাজ করাচ্ছে। তাও সেটা চুক্তিতে।
এ কারণে তাদের চাহিদা কমছে বলে মনে করছেন তারা। সকালে বাসা থেকে বের হন কাজ পাবেন কিনা, সেই চিন্তা মাথায় নিয়ে। তাই তাদের হাড়িতে চাল চড়ানো কঠিন হয়ে উঠেছে। আর জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় তাদের ঝুঁকি আরও বেড়েই চলেছে।
ভাসমান এই শ্রমিকরা কোনো শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত নেই। তাই তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলার কেউ নেই বলেও মনে করেন তারা। এই শ্রমিকদের চোখেমুখে সেই উৎকণ্ঠা দেখা যায়। প্রতিদিন শতাধিক লোক কাজের আশায় এই জায়গাগুলোতে ভিড় জমান। কিন্তু তাদের মধ্যে অল্প কয়েকজন কাজের সন্ধান পান, বাকিরা ফেরত যান হতাশা নিয়ে।
এমআইকে/এমএইচটি