‘কাজ করলে টাকা পাই, না করলে পাই না। আমাদের আবার কিসের দিবস ভাই। সারাদিন খাটলেও তো কেও ১০ টাকা বেশি দেয় না।’
প্রচণ্ড রোদে দাঁড়িয়ে ইটভাটায় কাজ করার ফাঁকে কথাগুলো মিঠুন মল্লিক নামের এক শ্রমিক। তার পাশে দাঁড়িয়ে তখন প্রচণ্ড দাবদাহে হাঁসফাঁস করছিলেন আরও কয়েকজন শ্রমিক। শরীর থেকে ঘাম ঝরছে তাদের। সারা গা চিকচিক করছে ধুলো ও ইটের কনায়। তবুও ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করেই চলছেন।
বিজ্ঞাপন
পহেলা মে দিবস—আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস। এদিন ঢাকার ধামরাইয়ে একটি ইটভাটায় গিয়ে কথা হয় মিঠুনের সঙ্গে। তিনি জানেন না মে দিবস কি। মিঠুনের মতো এসব ইটভাটায় কাজ করা বেশিরভাগ শ্রমিকই মে দিবস আর শ্রম দিবস কাকে বলে তা বোঝে না। এসব শ্রমিকের কাছে ‘মে দিবস’ শব্দটাও অচেনা। তারা বোঝে একদিন কাজ না করলেই না খেয়ে থাকতে হবে।
জীবন-জীবিকার টানে কেউ মাটি কাটছেন, কেও সেই মাটি ঠেলাগাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছেন, কেও ওই মাটি দলা পাকিয়ে এগিয়ে দিচ্ছেন কারিগরের হাতে আর কারিগর তা ফর্মায় ফেলে তৈরি করছেন বিত্তবানদের উচ্চ অট্টালিকা তৈরির ইট। আবার কেউ ইটভাটার আগুনের সঙ্গে সংগ্রাম করে সেসব ইট গরম চুল্লি থেকে নামিয়ে সাজিয়ে রাখছেন। তাদের সবার লক্ষ্য একটাই—সারা দিন রোদে পুড়ে হাড়ভাঙা খাটুনির পর এক মুঠো চাল-ডাল নিয়ে বাড়ি ফেরা। এদের কাছে মে দিবস আসে-যায়, কিন্তু তাদের কাজের বিরাম নেই—মুক্তি মিলছে না মজুরি বৈষম্য থেকেও।
ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে ধামরাইয়ের ডাউটিয়া এলাকায় বেশ কয়েকটি ইটভাটা। এখানে রয়েছে প্রায় পাঁচ শতাধিক শ্রমিক। পুরুষের পাশাপাশি এসব ইটভাটায় নারীরাও কাঠফাটা রোদে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে চলেছেন প্রতিদিন। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবিরাম কাজ করছেন তারা।
বিজ্ঞাপন
কথা হয় ইউএসএ ব্রিকসের শ্রমিক হোসেন আলী, আব্দুল কাদের, আব্দুল্লাহ, পিউর ব্রিকসের লীমা, খোদেজা, নয়া মিয়ার মতো বেশ কয়েকজন ভাটা শ্রমিকের সাথে। তবে তারা কারোই মে দিবসের তাৎপর্য সম্পর্কে জানা নেই। শ্রমিকদের সুন্দর কাজের পরিবেশ, নির্ধারিত ৮ ঘণ্টা কাজের সময় ও উপযুক্ত মজুরি তাদের চিন্তার বাহিরে। দিবসটি নিয়ে তাদের মাঝে নেই কোনো উচ্ছ্বাসও।
ডাউটিয়া এলাকার ইউএসএ ব্রিকসের ইট বানানোর কারিগর হোসেন আলী জানেননা মে দিবসের তাৎপর্য। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, মে দিবস এইটা তো আজই শুনলাম। এই দিবস সম্পর্কে আমার জানা নেই। আমাদের কোন ছুটি নাই। আমরা তো কাজ শুরু করছি রাত দুইটা থিকা। মাগরিবের আজান দিলে ছুটি। সকাল ৭টায় নাস্তা খাইছি৷ আর ১ টায় দেড় ঘণ্টার জন্য খাওয়ার ছুটি। এ সময়ে প্রতি হাজার ইট বানানোর জন্য ২৮০ টাকা মজুরি পাই।
এরপর কথা হয় নান্নার এলাকার পিউর ব্রিকস ইটভাটার নারী শ্রমিক লিমা আক্তারের সাথে তিনি ঢাকা মেইলকে জানান, ইটভাটায় কাজ করা আর জাহান্নামের আগুনে পোড়া সমান কথা। সন্তানদের মুখের দিকে তাকাইয়া আগুনে পুড়ে কাজ করতে হয়। মে দিবস কী এ সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। শুধু জানালেন, একদিন কাজ বন্ধ থাকলে সেদিনের খাবার টাকাও থাকে না তার।
এদিকে ইটভাটা মালিকপক্ষের মাঝেও মে দিবসের কোনো প্রভাব নেই। তাদের সাথে কথা বলে মনে হলো দিবসটি নিয়ে তাদের মাঝে কোনো গুরুত্ব নেই।
এ ব্যাপারে ইউএসএ ব্রিকসের ম্যানেজার হায়দার আলী ঢাকা মেইলকে বলেন, ইটভাটার কাজ মাসের প্রতিদিনই চলে ভাই। আমাদের এখানে সিজনে ঈদ ছাড়া কোনো বন্ধ নাই।
ভাই ভাই ব্রিকসের ম্যানেজার তোফাজ্জল হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ইটভাটায় মাসের ৩০ দিন ২৪ ঘন্টাই কাজ চলে। এখানে বন্ধের কোনো সিস্টেম নাই। তাই মে দিবসেও আমাদের কাজ চলমান থাকে।
ধামরাই উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি নজরুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ইটভাটার মালিকেরা ইট বানানোর জন্য সর্দারের সঙ্গে চুক্তি করেন। সর্দার প্রয়োজন অনুযায়ী শ্রমিক নিয়োগ করে৷ শ্রমিকদের নিয়োগ, মজুরি, ছুটি সব তিনিই দেখেন। তবে ইট বানানো শেষে শ্রমিকদের সঙ্গে ভাটার মালিক কথা বলে নিশ্চিত হন শ্রমিকরা ন্যায্য অধিকার পেয়েছেন কিনা।
প্রতিনিধি/এইচই