রেলস্টেশনে ট্রেন প্রবেশের সময় হুইসেল বাজার সঙ্গে সঙ্গে একদল লাল শার্ট পরিহিত মানুষ ট্রলি নিয়ে ছোটাছুটি করতে থাকে। কে কার আগে ট্রেনে উঠতে পারে এ নিয়ে শুরু হয় প্রতিযোগিতা। অনেকে আবার ট্রেন থামার আগেই গেটের হ্যান্ডেল ধরে ট্রেনে উঠে পড়েন। তখন মালামাল বহনের জন্য অনেকে অনুরোধ করতে থাকে। যুগ যুগ ধরে এভাবেই চলে আসছে রেলস্টেশনের কুলিদের জীবন। শুধু রাজধানীতেই নয়, প্রায় সারাদেশেই মাঝারি থেকে বড় রেল স্টেশনগুলোতে একই চিত্র দেখা যায়। ট্রেনের হুইসেলের সঙ্গে যেন তাদের জীবন মিশে গেছে।
কয়েক বছরে দেশে ট্রেনের সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি কুলিদের আয়। নিত্যপণ্যসহ সবকিছুর দাম যখন ঊর্ধ্বমুখী তখন তাদের কমেছে আয়। টিকতে না পেরে তাই অনেকেই এ পেশা বদল করে ছুটছেন অন্য পেশায়। কেউ করছেন হকারি, কেউবা ধরেছেন রিকশার হ্যান্ডেল। যারা এখন পর্যন্ত এই পেশায় টিকে আছেন তাদের দিন কাটছে অতি কষ্টে।
বিজ্ঞাপন
রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে দেখা যায়, বিকেলের দিকে স্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন কয়েকজন কুলি। অপেক্ষা করছেন বিকেলের ট্রেনের। সাধারণত দুপুরের দিকে ট্রেন কম থাকে তাই এই সময়টাতে তারা বিশ্রাম নেন। চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে একটি ট্রেন প্রবেশ করলে ট্রলি কাঁধে নিয়ে সবাই ছুটে যান ওই প্ল্যাটফর্মে।
স্টেশনে বিশ্রাম নেওয়ার সময় ঢাকা মেইলের সঙ্গে কথা হয় কয়েকজন কুলির। ২৬ বছর ধরে কমলাপুর রেলস্টেশনে কুলির কাজ করছেন আবদুল কাইয়ুম। তিনি বলেন, আমাদের অবস্থা ভালো না। আগের মতো আর আয় রোজগার নাই। ট্রেন বাড়লেও আমাদের আয় ইনকাম কমে গেছে। একসময় দিনে ১০০০-১২০০ টাকা আয় রোজগার হত, এখন ৫০০-৭০০ টাকাও কামাই হয় না। সবকিছুর যেভাবে দাম বাড়ছে আমাগোর চলা খুব কঠিন হয়ে গেছে। খুব কষ্টে দিন যাচ্ছে।
মঙ্গল মিয়া নামে আরেকজন বলেন, আয় রোজগার কমে গেছে এই জন্যে অনেকেই এই পেশা ছাড়ছে। অনেকেই গ্রামে চইলা গেছে। একসময় এই স্টেশনে পাঁচশর উপরে কুলি ছিল। অহন রেগুলার দুই-আড়াইশ কুলিও নাই। যে হারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে তাতে আমাদের সংসার চালোনো অনেক কঠিন। আমাদের তো আর দাম বাড়েনি। অনেকে তো অনেকভাবে অবৈধভাবে টাকা-পয়সা, বাড়ি-গাড়ি করে। আমরা বৈধভাবে অল্প-স্বল্প আয়-রোজগার করে থাকি, তা দিয়ে চলতে কষ্ট হলেও তাতেই খুশি।
বিজ্ঞাপন
যাত্রীদের সুবিধার্থে স্টেশনে নিজস্ব ট্রলি চালু করেছে স্টেশন কর্তৃপক্ষ। স্টেশনের গেটের বাইরে থেকে প্রতি ট্রলি ২০ টাকায় ভাড়া নিয়ে নিজের মালামাল নিজে বহন করতে পারেন যাত্রীরা। যার ফলে কমে গেছে কুলিদের আয়। কুলিদের আরেকজন বলেন, আমাদের আয় রোজগারের ঠিক নাই। কোনো দিন কম হয়, কোনো দিন বেশি হয়। একজনের মালামাল নিয়ে গেলে আশি-একশ-দেড়শ টাকা দেয়। আবার একসাথে দুইজনের মালামালও নিয়ে যাই। কোনো দিন চারশ, কোনো দিন পাঁচ-ছয়শ টাকার মতো আয় হয়। অহন অনেক মানুষ বাইরে থেকে ট্রলি নিয়ে নিজে নিজের মালামাল নিয়া যাচ্ছে। যার কারণে আমাদের আয় কমেছে।
অনেকেই হয়তো মনে করেন ঈদের সময় তাদের আয় রোজগার বেশি হয়। কিন্তু বাস্তবে তা ভিন্ন। ঈদের সময় তাদের আয় রোজগার কম হয়ে থাকে। হাসান নামে একজন বলেন, আমাদের বেশি আয় রোজগার হয় ফলের মৌসুমে। বিশেষ করে আম কাঁঠাল লিচুর সময়। এইসময় মানুষ গ্রামের বাড়ি থেকে ফলের ঝুড়ি বস্তা নিয়ে আসে। তারা একা সেগুলো নিয়া যাইতে পারে না। আমরা নিয়া যাই।
ঈদের সময় কেমন ইনকাম হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঈদের সময় খুব একটা কামাই হয় না। সে সময় মানুষ ব্যাগ-ট্যাগ বেশি নেয় না। ভিড়ের কারণে সবাই অল্প-স্বল্প জিনিস নিয়া বাড়িত যায়। তাই ওই সময় আমাদের রোজগার কমে যায়।
একসময় মাথায় করে মালামাল বহন করত কুলিরা। তবে এখন তাদের কষ্ট অনেকটা কমেছে। ট্রলির মাধ্যমে মালামাল বহন করছেন তারা। কমলাপুর রেলস্টেশনে কুলিদের জন্য চার্জ নির্ধারণ করে দিয়েছে রেলওয়ে। যাত্রীদের সুবিধার্থে স্টেশনে লাগেজ বহনকারী কুলিদের আইডি কার্ড, পোশাকের মাধ্যমে কুলি ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নসহ মালামাল বহনে ট্রলি, প্রতিবন্ধী-অসুস্থ, বয়স্ক রোগীদের জন্য হুইলচেয়ার সরবরাহ করা হয়েছে।
একই সঙ্গে চার্জ সংশ্লিষ্ট তথ্যে উল্লেখ করা হয়েছে- ২৮ কেজির একটি ব্যাগ ১৫ টাকা, দুটি ব্যাগ ২০ টাকা, ৩৭ কেজির দুটি ব্যাগ ২৫ টাকা, ৫৬ কেজি পর্যন্ত ব্যাগ ৩৫ টাকা। ট্রলি যাত্রী ব্যবহারে ১৫ টাকা, কুলি ব্যবহারে ২০ টাকা, হুইলচেয়ার কুলি ব্যবহারে ২০ টাকা। এই চার্জে যেতে রাজি না হলে কুলিদের আইডি নম্বরসহ স্টেশন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানাতে বলা হয়েছে।
তবে অধিকাংশ কুলিই সেই নির্ধারিত মূল্যে মালামাল বহন করেন না। কুলিদেরকে কন্টাক্ট করেই মালামাল বহন করতে দেখা গেছে। তাদের ভাষ্য ওই দামে তাদের পোষায় না। তারা সংসার চালাবেন কীভাবে। তাই তারা যাত্রীদেরকে খুশি হয়ে কিছু দাবি করেন। এ বিষয়ে একজন কুলি বলেন, এমনিতেই আমাদের আয় রোজগার অনেক কম। কোনো রকম সংসার চলে। ওই দামে মালামাল বহন করলে তো সংসারই চালাতে পারুম না।
জানা গেছে, কমলাপুর রেলস্টেশনে যে সমস্ত কুলি রয়েছেন তারা অনেকেই কমলাপুরের আশেপাশের বস্তিতেই পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। অনেকেই আবার মেসে থাকেন। সেখানে খাওয়া খরচ বাদ দিয়ে যা থাকে তা পাঠান গ্রামে সংসারের জন্য। কুলির কাজ করতে যে ইচ্ছুক দতাকে দুই তিন মাস পর্যবেক্ষণ করা হয়, এরপর তালিকায় নাম উঠিয়ে স্টেশন অফিস থেকে অনুমতি নিয়ে নম্বর দেওয়া হয়।
এছাড়াও কিছু ভবঘুরেকেও স্টেশনে কুলির কাজ করতে দেখা যায়। যাদের গায়ে লাল শার্ট বা আইডি নাম্বার থাকে না। তারা মাথায় করে চুক্তিতে মালামাল বহন করে থাকে। তাদের থেকে সাবধান থাকতে বলেন মূলধারার কুলিরা।
টিএই/এএস