বুধবার, ১ মে, ২০২৪, ঢাকা

কাজের চাপে শেষ চাতাল শ্রমিকদের জীবন, শোধ হয় না দাদনের টাকা

আশিকুর রহমান মিঠু
প্রকাশিত: ০১ মে ২০২৩, ১২:৪২ পিএম

শেয়ার করুন:

কাজের চাপে শেষ চাতাল শ্রমিকদের জীবন, শোধ হয় না দাদনের টাকা
ছবি : ঢাকা মেইল

৭ বছর ধরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলায় চাতাল শ্রমিকের কাজ করছেন আনোয়ারা বেগম। তার বাড়ি কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার পূর্বগাঁও এলাকায়। ঋণগ্রস্ত হয়ে এক সর্দারের মাধ্যমে এখানে আসেন চাতালকলে কাজ করার জন্য। চাতালকল মালিকের কাছ থেকে দাদন (অগ্রিম শ্রম বিক্রি বাবদ সুদমুক্ত ঋণ) নিয়ে সেই ঋণ শোধ করেছেন তিনি। বর্তমানে তিনি আশুগঞ্জ উপজেলার সোনারামপুর এলাকার সানমুন রাইস মিলে কাজ করেন। 

গত এক বছর আগে মিতালী রাইস মিল নামে একটি চাতালকলে কাজ করার সময় আনোয়ারার মাধ্যমে তার গ্রামের আরেক বাসিন্দা ইদ্রিস মিয়া আসেন চাতালকলে কাজ করতে। ইদ্রিসও চাতালকল মালিকের কাছ থেকে ৭৫ হাজার টাকা দাদন নিয়েছেন। কিন্তু তিন দিন কাজ করার পর ইদ্রিস চাতালকল থেকে পালিয়ে যাওয়ায় তার নেওয়া দাদনের টাকা শোধের দায়ভার বর্তায় আনোয়ারার ঘাড়ে। পরবর্তীতে সানমুন রাইস মিল মালিকের কাছ থেকে দাদন নিয়ে মিতালী রাইস মিল মালিকের টাকা শোধ দেন তিনি। প্রতিদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর মজুরি পান নামেমাত্র। কত মাস বা কত বছর শ্রম দিলে দাদন নেওয়া টাকার শোধ হবে সেই চিন্তায় ঘুম আসে না তার। আর টাকা শোধ না হওয়া পর্যন্ত বাড়িও যেতে পারবেন না তিনি।  


বিজ্ঞাপন


এদিকে, নারী হওয়ায় পুরুষের তুলনায় মজুরি কম পান তিনি।  

may day

সানমুন রাইস মিলের শ্রমিকদের সর্দার আলম মিয়া চাতাল শ্রমিকের কাজ করছেন প্রায় ১৪ বছর ধরে। তিনিও ঋণগ্রস্ত হয়ে এক সর্দারের মাধ্যমে আসেন চাতালকলে কাজ করার জন্য। এখন পর্যন্ত বিভিন্নজনের কাছে তার প্রায় পাঁচ লাখ টাকা ঋণ আছে। কিন্তু সেই টাকা শোধ করতে পারছেন না তিনি।
 
জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্জ, সিলেট ও হবিগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলার হাওরাঞ্চলের উৎপাদিত ধানের সবচেয়ে বড় হাট বসে আশুগঞ্জ উপজেলার মেঘনা নদীর ভিওসি ঘাটে। এই হাটকে বলা হয় দেশের পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড় ধানের মোকাম। আর এই মোকামকে কেন্দ্র করে জেলায় সাড়ে ৩শ চাতালকল গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে আশুগঞ্জেই রয়েছে তিন শতাধিক চাতালকল। বিওসি ঘাটের ধানের মোকামই এসব চাতালকলে ধানের যোগান দেয়। চাতালকলগুলোতে নারী-পুরুষ মিলিয়ে কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করেন। এসব শ্রমিকরা বছর (বৈশাখ-চৈত্র) চুক্তিতে দাদান নিয়ে থাকেন। মূলত দাদন হলো শ্রমিক আটকানোর কৌশল। আর দাদন নেওয়ার ফলে শ্রমিকরা অন্য কোথাও যেতে পারেন না। চাতালকলেই রয়েছে শ্রমিকদের থাকার ব্যবস্থা।

কথা হয় হবিগঞ্জের লাখাই থেকে আসা চাতাল শ্রমিক শফিক মিয়ার সাথে। তিনি বলেন, মিলে আসার সময় মালিক আমাদের ৫০ হাজার থেকে শুরু করে ১ লক্ষ টাকা দাদন দেন। আমাদের সম্পূর্ণ কাজ প্রোডাকশনের উপরে। প্রতি বস্তা ধান শুকানো থেকে শুরু করে ডেলিভারি পর্যন্ত ১৮ টাকা দেয়া হয় আমাদের। আমরা ১০-১৫ জন শ্রমিক একটি মাঠগেইলে কাজ করতে দুই/তিন দিন সময় লাগে।  তাতে দৈনিক জন প্রতি তিনশত টাকা পাই। এই টাকা দিয়ে আমাদের বউ-বাচ্চা নিয়ে সংসার চালানো কষ্ট হয়ে পড়ে। এছাড়াও আমরা পরিবারের কাছে ইচ্ছা করলেও যেতে পারি না, কারণ তাদের কাছ থেকে অগ্রিম দাদন নেওয়ার জন্য। দাদন পরিশোধ না করা পর্যন্ত তাদের কাছে বন্দি থাকতে হয়।


বিজ্ঞাপন


may day

শাহী রাইস মিলের শ্রমিক দিলু মিয়া গত আড়াই বছর আগে চাতালকল মালিকের কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা দাদন নিয়েছেন। এই চাতালকলে কাজ করে একটু একটু টাকা শোধ হচ্ছে তার দাদনের টাকা। এর আগে রিজিয়া হক রাইস মিল নামে আরেকটি চাতালকলে কাজ করতে তিনি। সেই চাতালকল মালিকের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা দাদন নিয়েছিলেন। এরপর শাহী রাইস মিল মালিকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে রিজিয়া হক রাইস মিল মালিকের টাকা শোধ দিয়ে এখানে চলে আসেন তিনি।

এভাবে দাদন নিয়ে এক মিল থেকে আরেক মিল যেতে যেতেই জীবন কেটে যাচ্ছে চাতাল শ্রমিকদের। কিন্তু মুক্তি মিলছে না তাদের। এমন বন্দিদশা চাতালকলগুলোতে কাজ করা বেশিরভাগ শ্রমিকদের। অভাব-অনটন তাদের বের হতে দিচ্ছে না দাদনের বেড়াজাল থেকে। তাই তাদের মুক্তির পথটাও যেন আটকে আছে। তাই নীরবে মুক্তির আর্তনাদ ছাড়া আর কিছুই করার নেই তাদের।

আশুগঞ্জ চাতাল শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি হরমোজ আলী বলেন, আমরা চার বছর আগে সকল শ্রমিকদের নিয়ে দাবি দাওয়া, বেতন মজুরি বাড়ানো জন্য আন্দোলন করেছিলাম। তারপরে ২/৩ টাকা বাড়ানো হয়েছিল। তবে মিলের মালিকরা হুঁশিয়ারি করে দিয়ে বলেন, আমাদের দাদন দিয়ে দাও। কারণ অল্প বেতনে দাদন পরিশোধ করা সম্ভব না। তাই সরকারের কাছে আমাদের দাবি আমাদের মজুরি যেন বাড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আশুগঞ্জ উপজেলা চাতালকল মালিক সমিতির অন্যতম সদস্য হাসান ইমরান ঢাকা মেইলকে বলেন, শ্রমিকদের বারবার বলা হচ্ছে দাদন না নিতে, তাদের বেতন বৃদ্ধি করা হবে। কিন্তু তারা দাদন নিচ্ছে। একজন মালিক শ্রমিকদের ১৫-২০ লাখ টাকা দাদন দিয়ে থাকে। দাদনের এই টাকাটা তো আর ফেরত আসে না। অনেকে টাকা নিয়ে বাড়ি চলে যায়। আগে শ্রমিকদের মজুরি অনেক কম ছিল। এখন বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া শ্রমিকরা মিলের বাইরেও কাজ করার সুযোগ পান।

প্রতিনিধি/এইচই

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর