সালেহা খাতুনের বয়স ৫৫ বছর। ১৫ বছর আগে জীবিকার তাগিদে এসেছিলেন মাগুরা জেলা শহরে। তখন থেকে তিনি গৃহশ্রমিকের কাজ করে যাচ্ছেন। এরকম অসংখ্য সালেহা বেগম মাগুরা শহরে এসে গৃহশ্রমিক হিসেবে পার করে দিয়েছেন গোটা জীবন।
সালেহা খাতুনের বাড়ি মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম টিকেরবিলায়।
বিজ্ঞাপন
ছোট শহর মাগুরা—গড়ে ওঠেনি তেমন কোনো শিল্প-কলকারখানা। বড় কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান না থাকায় কৃষিই এখানকার প্রধান পেশা। গ্রামাঞ্চলে কৃষি প্রধান পেশা হলেও বেশিরভাগ নারীই থাকে কর্মহীন। সংসারের টানাপোড়েনের কারণে তারা কাজের সন্ধানে ছুটে আসেন শহরে। কিন্তু তেমন কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান না থাকায় তারা বেছে নেয় গৃহশ্রমিকের কাজ।
সালেহার মতো অসংখ্য নারী গৃহশ্রমিকের কাজ করেন মাগুরা শহরের বিভিন্ন বাসাবাড়িতে। দুবেলা খাওয়াপড়া আর জীবনের একটার পর একটা দিন পার করা ছাড়া বড় কোনো স্বপ্ন কেউ দেখেন না।
ঢাকা মেইলের সঙ্গে কথা হয় গৃহকর্মী মনোয়ারার। ৩০ বছর আগে গ্রামের ঘরবাড়ি ছেড়ে তিনি পাড়ি জমিয়েছিলো মাগুরা শহরে। তার ছেলেমেয়েরা এখন স্বাবলম্বী। প্রত্যেকেই তার মতো শ্রম বেঁচে। তবে কেউই দেখে না মনোয়ারাকে। বরং মেয়ের পরিবারে কোনো আর্থিক সংকট দেখা দিলে তা দেখতে হয় তাকেই। গ্রামে স্বামী আরেকটা বিয়ে করেছে। মনোয়ারা মাকে নিয়ে শহরের একটি বস্তিতে ঘর ভাড়া করে থাকে।
বিজ্ঞাপন
মনোয়ারা জানায়, আগে এক বাড়িতে বাঁধা কাজ করতাম। ১৫০০ টাকা আর দু-বেলা খাওয়া দিত। কিন্তু নানাদিকে খরচ হয় অনেক বেশি। তাই এখন বিভিন্ন বাড়িতে ছুটা কাজ করি। ৬-৭ হাজার টাকা পাই। কিন্তু এতে ঘর ভাড়া, খাওয়া, পোশাক সবকিছু মেটানো সম্ভব নয়।
গৃহপরিচারিকা রোজিনা বলেন, গ্রামে আমার স্বামী কৃষি শ্রমিক। দুই ছেলে-মেয়ের খরচ সে মেটাতে পারে না, তাই আমাকে শহরে পাঠিয়েছে বাড়িতে কাজ করতে। এরা খাওয়া-থাকা ছাড়াও ৩ হাজার টাকা দেয়। পুরো টাকাই স্বামী এসে প্রতি মাসে নিয়ে যায়। মাঝে মাঝে বাচ্চাদেরকে দেখতে বাড়ি যাই। একদিনের বেশি দুদিন ছুটি কাটালেই আবার বেতন কেটে নেয়।
শহরের কলেজ পাড়ায় একটি বাসার নারী গৃহশ্রমিক নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, স্বামী আরেকটা বিয়ে করেছে তাই অন্যের বাড়ি কাজ করি। এ দিয়ে কোনোরকম দিন চলে যায় বাচ্চাকে নিয়ে। কিন্তু স্যার আর আপার দুর্ব্যবহার সহ্য করা কঠিন হয়ে যায়। বাধ্য হয়েই এই কাজ করি।
নিজনান্দুয়ালী আশ্রয়ণ প্রকল্পে থাকেন আছিয়া বেগম। দুই সন্তানই স্কুলে পড়ে। স্বামী ভ্যান চালায়। আছিয়া বলেন, স্বামীর আয় দিয়ে সংসার চলে না। তাই আমি বাসায় কাজ করি। যা পাই তা দিয়ে কোনোরকম চলে যায়। ছেলে-মেয়ে দুটোকে মানুষ করতে পারলে আর চাওয়ার কিছু নাই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাকোল সম্মিলনী ডিগ্রি কলেজের সমাজবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক জামিউল কদর বলেন, গৃহপরিচারিকার কাজ আমাদের সমাজে হাজার বছর ধরে চলে আসছে। নিম্নবিত্ত নারীদের একটি বড় অংশ এ পেশায় জড়িত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, পেশা হিসেবে গৃহশ্রম এখনো স্বীকৃতি পায়নি। সরকারের কাছে দাবি, গৃহশ্রমকে স্বীকৃত একটি পেশা হিসেবে ঘোষণা করে এদের বেতন, সুযোগ-সুবিধা একটি নীতিমালার আওতায় আনা হোক।