রোববার, ৩০ মার্চ, ২০২৫, ঢাকা

রাজশাহীর ঈদবাজারে নিম্ন-মধ্যবিত্তের ভরসা ‘ফুটপাত’

আমানুল্লাহ আমান, রাজশাহী
প্রকাশিত: ২৫ মার্চ ২০২৫, ০৮:১৯ পিএম

শেয়ার করুন:

loading/img

ষাটোর্ধ্ব রিকশাচালক বেলায়েত হোসেন। বাসা রাজশাহীর চারঘাটে। প্রতিদিন ভোরবেলায় আসেন শহরে, সারাদিন রিকশা চালিয়ে রাতে ফিরে যান বাসায়। ভাড়া নেওয়া রিকশার উপার্জন দিয়ে প্রায় চার যুগ ধরে সংসার চালিয়ে আসছেন তিনি।

ঈদের সময় বাড়তি পেরেশানি তৈরি হয় বেলায়েতের। স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে কিনে দিতে হবে নতুন পোশাক। এক হাজার টাকার মধ্যেই পরিবারের তিন সদস্যের মার্কেট করতে পেরে বেজায় খুশি তিনি।


বিজ্ঞাপন


মঙ্গলবার তপ্ত দুপুরে নগরীর সাহেববাজার জিরো পয়েন্টে আরডিএ মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে বেলায়েত হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমারে মুতন (মতো) গরিবেরে কেনে (জন্য) ওই মার্কেট না বাবা। ওঠি (ওখানে) বড়লোকেরা যায়। আমারে কেনে (জন্য) ফুটপাতই ভালো। ১৫০ ট্যাকা দিয়্যা ব্যাটার (ছেলে) কেনে (জন্য) রেডিমেট একটা শার্ট কিননু (কিনলাম)। ছওয়ালডা  (ছেলেটা) স্কুলেত পড়ে। নতুন শার্ট গায়ে দিয়্যা (পরিধান করে) নানির বাইত (বাড়ি) যাবে। দুই বিটির (মেয়ের) লাইগ্যা (জন্য) ৪০০ ট্যাকা দিয়্যা দুড্যা (দুইটা) থ্রি-পিস লিয়্যাছি (নিয়েছি)। আর বাড়িআলির (স্ত্রী) কেনে (জন্য) শাড়ি লিনু (নিলাম)। এড্যার দাম ধইরলো ৩০০ ট্যাকা। এই ন‘শোর (৯০০ টাকা) ভিতর আমার বাজার করা শ্যাষ। বড় মার্কেটে গেলে এতগুল্যান পাইতু (পেতাম)?’
নিজের জন্য কিছু কিনলেন কি না এমন প্রশ্নে বেলায়েত বলেন, ‘এখুনও ম্যালা (অনেক) ট্যাক খরচ আছে ঈদে। দুই বিটির (মেয়েকে) বাড়িত চিনি সেমাই এড্যা-ওইড্যা কিন্যা দিত হবি। আগে অগুলা কিনি, তারপর ট্যাকা থাইকলে কিছু কিনলে কিনবো, না হলে লুঙ্গিতে ঈদ হয়ে যাবে রে ব্যাটা।’

শুধু বেলায়েত হোসেনই নন, নগরী ও জেলার হাজারও মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের ভরসা এখন ফুটপাত। অভিজাত মার্কেট ও বিপনীবিতানের চেয়ে বেশি ভিড় হচ্ছে এসব দোকানে। নিম্নআয়ের মানুষের পদচারণায় ফুটপাতে ছড়িয়ে পড়েছে ঈদের বাড়তি আনন্দ।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, নগরীর রানিবাজার, গণকপাড়া, সোনাদিঘির মোড়, সাহেববাজার জিরো পয়েন্ট এলাকায় ফুটপাতের দোকানগুলোতে ভিড় হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি কেনাবেচা হচ্ছে সাহেববাজারের আরডিএ মার্কেটের সামনের ও গণকাপাড়া এলাকার ফুটপাতে। সড়কের দুপাশে শিশুদের জামা, মেয়েদের শাড়ি, থ্রি-পিস, বোরকা, জুতা-স্যান্ডেল, অলংকার, কসমেটিকস থেকে শুরু করে সবকিছুই সহজলভ্য হওয়ায় নারী ক্রেতাদের সমাগম বেশি। নিত্যনতুন ডিজাইনের পাঞ্জাবি, টুপি, জিন্স, টি-শার্ট এবং থান কাপড়ও পাওয়া যাচ্ছে ফুটপাতে। ফুটপাতের দোকানগুলোতে শিশুদের পছন্দের পোশাক কিনে দিচ্ছেন নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির অভিভাবকরা।

Raj-1


বিজ্ঞাপন


নিউমার্কেট ও হকার্স মার্কেট, গণকপাড়াসহ বেশ কয়েকটি মার্কেটে পা ফেলার ঠাঁই নেই। ঘুরে ঘুরে পছন্দের ফ্রক, স্কার্ট, লেহেঙ্গা, টু-পিস, থ্রি-পিস ও বোরকা দেখছেন ক্রেতারা।
ক্রেতারা জিনিসের বাড়তি দাম নেওয়ার অভিযোগ করলেও মার্কেট থেকে কেউ খালি হাতে ফিরছেন না। তাপদাহেও যেন ক্লান্তিহীন ঈদ মার্কেট।

ক্রেতারা বলছেন, বিপনীবিতানের চেয়ে ফুটপাতে সস্তা দামে পছন্দের জিনিস পাওয়া যাচ্ছে। তাই ফুটপাতেই তাদের ভরসা।

ডিউটি শেষ করে শিশুসন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে শপিং করতে আসেন একটি হাসপাতালের নিরাপত্তা প্রহরী সোহেল রানা। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘বড় দুকানে (দোকানে) যায়্যা আমরা কিনতে পারি? অত সামর্থ্য নাই, বেকার ওদিকে যায়্যা লাভও নাই। তাই ফুটপাতে জিনিস দেখছি। এখানেই কিনব। স্ত্রীকে বোরখা কিনে দিবে তাই এসেছি।’
সাইদুল হক নামে গোদাগাড়ীর এক কৃষক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘হামরাকে (আমাদের) তো ঢুকতেই দিবে না বড় মার্কেটে (বিপনীবিতান)। হারা (আমরা) ফুটপাতে থাইক্যাই কিনি। কম টাকাতে পাই, এটা দিয়্যাই হয়।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্কুলশিক্ষক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘২০২০ সাল থেকে আমি ব্রান্ডের শো-রুমে যাইনি। অল্প টাকায় ফুটপাতে ভালো জিনিস পাই। দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতির বাজারে আমাদের মতো মধ্যবিত্তের সংসার চালানো কঠিন। তাই ফুটপাতের দোকানগুলোতে এসেই বাচ্চাদের কিনে দিচ্ছি।’

ক্রেতাসমাগম বেশি হওয়ায় বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন ফুটপাতের বিক্রেতারা। তারা বলেন, আমাদের এখানে সব কালেকশন আছে। দেখে চয়েস করে নিচ্ছে। বেচাবিক্রি খারাপ হয় না।

আব্দুল কাদের নামে সাহেববাজার এলাকার এক কাপড় ব্যবসায়ী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমার এখানে প্রতিদিন ৪০-৫০ হাজার টাকার পোশাক বিক্রি হচ্ছে। রমজানের এই ৩ সপ্তাহে ১২ লাখ টাকার মালামাল বিক্রি করেছি। অন্তত ২০ লাখ টাকার বিক্রি হওয়ার আশা করছি।’

আরেক ব্যবসায়ী ওয়াসিউর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের বেচাকেনা থেমে থাকে না। আমরা সীমিত লাভে বিক্রি করি। কাস্টমার আসে, দেখেশুনে দামদর করে জিনিস কিনে।’

ফুটপাতের ব্যবসায়ী আইয়ুব আলী বলেন, ‘আমরা অল্প পুঁজিতে ঈদের সময় ভালোই বিক্রি করি। এই সময়ে চাপ একটু বেশি। তবে বড় দোকানের ভাড়া লাগে। আমাদের লাগে না, কিন্তু এখানে ওখানে টাকা দিতে হয়।’ তবে বিষয়টি চাঁদা বলতে নারাজ তিনি।

Raj-4পাদুকা ব্যবসায়ী নেতা মো. রিপন বলেন, ‘আমাদের জুতা সেন্ডেলের দোকানে সম সময় ভিড় থাকে। আমার দোকানেও সব কালেকশন আছে। ১০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকার পর্যন্ত বিভিন্ন দামের জুতা সেন্ডেল আছে। যার বাজেট যে রকম সে সেরকম কিনছে। ঈদে আরও বেশি চাহিদা। অন্যদের কী হয় জানি না। কিন্তু আমাদের ব্যবসা ঈদে ভালোই হয়।’

রাজশাহী ব্যবসায়ী সমন্বয়ক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সেকেন্দার আলী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সব মার্কেটেই আলাদা আলাদা ক্রেতা রয়েছে। সবাই তো এক শ্রেণির নয়। যারা উচ্চবিত্ত তারা যেমন অভিজাত মার্কেটে কিনছেন; তেমনই যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো না, তারা বাইরের মার্কেটে বাজার করছেন। কাস্টমার ফিরে যাক এটা কোনো ব্যবসায়ী চায় না। আমরা বাজার তদারকি করছি। সর্বোচ্চ সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করছেন ব্যবসায়ীরা।’

রাজশাহী ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ফরিদ মামুদ হাসান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ফুটপাতের ব্যবসাটাই ভালো হয় প্রতিবছর। সব শ্রেণির কাস্টমার যায়, কম দামে পছন্দের সবকিছু পায়। ফুটপাতে ক্রেতাদের ক্রেতাদের ভিড় হচ্ছে এটা সত্য। কিন্তু বড় মার্কেটগুলো মাইর খেয়ে যাচ্ছে।’

প্রতিনিধি/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর