শিক্ষানগরী ছাড়াও রাজশাহীর আরও বেশ কয়েকটি পরিচয় রয়েছে। অন্যতম হলো ‘সিল্কসিটি’। নামটির সঙ্গে মিল রেখে উত্তরের এ নগরী থেকে রাজধানী ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনেরও নামকরণ করা হয় ‘সিল্কসিটি এক্সপ্রেস’। বিভাগীয় এই শহরে বর্তমানে চলছে ঈদের জমজমাট বেচাকেনা। প্রতিটি মার্কেটে কেনাকাটার ধুম পড়েছে। তবে ব্যতিক্রম ঐতিহ্যবাহী সিল্কের বাজার।
সিল্কের বিপনীবিতানগুলোতে পুরোপুরি উল্টো চিত্র। ক্রেতাশূন্য অবস্থায় অলস সময় কাটাচ্ছেন শো-রুমের কর্মীরা।
বিজ্ঞাপন
জানা গেছে, নগরীর সপুরা বিসিক এলাকায় সিল্কের বেশিরভাগ শো-রুম অবস্থিত। মূল শহর থেকে কিছুটা ভেতরে হওয়ায় এ মার্কেটে সর্বসাধারণের হয় না বললেই চলে। তবে সারাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে উচ্চশ্রেণির ক্রেতারা এসে এসব শো-রুম থেকে পোশাক কিনে থাকেন। এমনকি বিদেশি পর্যটকরাও রাজশাহীতে এলে শো-রুম থেকে ঐতিহ্যের সিল্কের পোশাক কিনে নিয়ে যান। ঐতিহ্যবাহী সিল্কের শাড়ি, পাঞ্জাবি, শেরওয়ানি, থ্রি-পিস, শার্ট, হিজাব, ওড়না, স্কার্ফসহ বিভিন্ন পোশাক এসব শো-রুমে বিক্রি হয়।
জামদানি শাড়ি, ঢাকাই শাড়ি, কাতান শাড়ি, টাঙ্গাইল শাড়ি, বেনারসি শাড়ি, রাজশাহী রেশম সিল্ক শাড়ি পাওয়া যায় সবসময়।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ৭৩ বছরের পুরনো সিল্কের এসব পোশাক অনেক আগে থেকেই বেশ জনপ্রিয়। ১৯৫২ সালে মহান ভাষা আন্দোলনের সময় রাজশাহীতে সরকারি তত্ত্বাবধানে প্রথম সিল্কের যাত্রা শুরু হয়। এরপর প্রথম রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬১ সালে। পরবর্তীতে ‘গরদ’ নামের ঐতিহ্যবাহী শাড়ি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। আর দাম হিসেবে ‘বলাকা সিল্ক’ এখানে বেশি মূল্যবান। মসলিন সুতাকে টুইস্টিং মেশিনের মাধ্যমে টুইস্ট করে বলাকা সিল্ক তৈরি করা হয়। এটি সম্পূর্ণ হ্যান্ডলুম একটি কাপড়। বলাকা সিল্ক কখনোই মেশিনে বুনন করা যায় না।
তথ্যমতে, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান রাজশাহীর সিল্কের ঐতিহ্য ফেরাতে উদ্যোগ নেন। ১৯৭৭ সালে এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে গঠন করেন রেশম বোর্ড। এরপর ১৯৭৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে রেশম বোর্ডের প্রধান কার্যালয় স্থাপন করা হয়। শুরু হয় হারানো রেশমের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার কাজ।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন—
বাংলাদেশ-সুইস যৌথ এক প্রকল্পে সিল্কের ব্যাপক প্রসার ঘটান বাংলাদেশের এই অবিসংবাদিত নেতা। সর্বশেষ এটি রাজশাহীর জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সিল্কের শাড়ি কোয়ালিটি ভেদে দুই হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। বলাকা, মক্কা, কাতান, ছিপ কাতানসহ বিভিন্ন নামের শাড়ি বিক্রি হচ্ছে এক হাজার থেকে শুরু করে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত দামে। থ্রি-পিসের দাম রয়েছে সাড়ে ৩ হাজার থেকে ১০ হাজারের মধ্যে। বিভিন্ন ডিজাইনের পাঞ্জাবি পাওয়া যাচ্ছে দুই হাজার থেকে ২২ হাজার টাকা পর্যন্ত। আর শেরওয়ানি উঠেছে ৮ থেকে ২৫ হাজার দামের।
ব্যবসায়ীরা জানান, মার্কেটে বাহারি ডিজাইনের সব বাজেটের কালেকশন রয়েছে। কিন্তু এবার বেচাবিক্রি ঢিলেঢালা। কাস্টমার নেই বললেই চলে। অনেকক্ষণ পরপর দুজন-একজন করে আসছেন।
রাজশাহী সিল্কের ম্যানেজার মো. সেলিম রেজা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের এখানে সব আছে। কিন্তু কাস্টমার নাই। এভাবে চললে লস হবে। ঈদের দু-একদিন আগে কিছুটা বাড়বে। কিন্তু তাতে পোষাবে না। অন্যবছর জমজমাট বেচাবিক্রি হয়। এবার তার বিপরীত। আমরা বসে আছি, অনেক সময় পরপর দু-একজন আসছেন। কেউ কেউ দেখে চলে যাচ্ছেন।’
রেশম শিল্প মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদের মুন্না ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের খরচও বেড়েছে। সেই অর্থে ব্যবসার অবস্থা ভালো বলা যাচ্ছে না। যতটুকু হচ্ছে, সামনে কিছুটা বাড়বে বলে আশা করছি। বিভিন্ন দামের পণ্যই রয়েছে। তবে এ বছর মসলিন সিল্কের চাহিদা বেশি।’
ক্রেতারা বলছেন, বছরের যেকোনো সময়ে সিল্কের এসব পোশাক পরা যায়। সেজন্য তাদের পছন্দের পোশাক কিনতে এসেছেন তারা।
রফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যাংক কর্মকর্তা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এবার আমার ঈদের শপিংয়ে পছন্দ তালিকার এক নম্বরে রয়েছে রাজশাহীর সিল্কের পোশাক। একমাত্র মেয়েটা কলেজে পড়ে, সে থ্রি-পিস নিবে। তাকে কিনে দিতে এসেছি। আমার মিসেসও অনলাইনে দেখে শাড়ি পছন্দ করে রেখেছে। ওর জন্যও কিনতে হবে। তাই আসলাম। একটু ঘুরে দেখি, এরপর পছন্দমত কিনব।’
আরও পড়ুন—
নাটোর থেকে সিল্কের পাঞ্জাবি কিনতে এসেছেন কলেজশিক্ষক মো. হাফিজুর রহমান। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সিল্কের পোশাক শীত বা গ্রীষ্ম যেকোনো ঋতুতেই পরিধানের উপযোগী। আগেও এসেছিলাম। এবার এসে পাঞ্জাবি দেখছি। দেখি কোনটা পছন্দ হয়।’
রাজশাহী চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মাসুদুর রহমান রিংকু ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী সিল্কের চাহিদা সারাদেশে রয়েছে। এছাড়া দেশের বাইরেও এটা অনেক জনপ্রিয়। রাজশাহীর সিল্ক নিয়ে সরকারের তরফ থেকে কাজ করা দরকার। এবার ঈদের বাজার ঢিলেঢালা। আশা করা যায়, আগামীতে এ অবস্থা থাকবে না।’
প্রতিনিধি/এমআর