মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৪, ঢাকা

প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম ও ভাষা আন্দোলন

বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১০:২৯ এএম

শেয়ার করুন:

প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম ও ভাষা আন্দোলন

আমাদের ভাষা আন্দোলন গড়ে উঠেছিল নতুন প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানের সূচনালগ্নে। ব্রিটিশদের কাছ থেকে ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের জনগণ ভারত ও পাকিস্তান নামে নতুন দুটো স্বাধীন রাষ্ট্র লাভ করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান আন্দোলনে বাঙালিদের ভূমিকা ছিল মুখ্য। বাংলা-ভাষী বিপুল সংখ্যক মানুষ নতুন রাষ্ট্রে তাদের সব ধরনের অধিকার ভোগ করার বাসনা করেছিল।

কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই বাঙালিদের মনে নানান রকম সন্দেহ দেখা দেয়। বাঙালিরা এ অঞ্চলে বঞ্চিত ছিল। তাদের জীবনমান ছিল অনুন্নত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিল্প— সব ক্ষেত্রে তারা বঞ্চিত ও উপেক্ষিত ছিল। নতুন প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে উর্দুর একাধিপত্য প্রসারিত হয়। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান চলত পশ্চিম পাকিস্তানের আমলা ও শাসক শ্রেণির দ্বারা। রাজনীতিতেও তাদের দাপট ছিল। ফলে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বাঙালিরা তাদের বঞ্চনা ও উপেক্ষা অনুধাবন করতে থাকে।


বিজ্ঞাপন


পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, উর্দু না বাংলা— এ প্রশ্ন ওঠে। স্পষ্টতই দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পাকিস্তানে নাগরিকদের মন-মানসিকতায় ধর্মের প্রভাব বিদ্যমান ছিল। উর্দু ও বাংলার এই দ্বৈরথে বেশিরভাগ বাঙালি মুসলমান মাতৃভাষার পক্ষে অবস্থান নেয়। পক্ষান্তরে, পশ্চিম-পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী উর্দুর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় মরিয়া হয়ে ওঠে। বাঙালি মুসলমানরা এতে হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়। সেই সন্ধিক্ষণে পূর্ব বঙ্গের বাঙালি মুসলমানদের ভাষার প্রশ্নে নবজাগরণে প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম অনন্য ভূমিকা পালন করেন।

একথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট— বাংলা ভাষা আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন ছাত্র-যুবকরা। ভাষা আন্দোলনে তরুণদের এ নেতৃত্বে বলতে গেলে সমগ্র পূর্ব বাংলার মানুষের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। আর এ আন্দোলনের সূচনা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ভাষা আন্দোলনকে পরবর্তীকালে খন্ডিত করার চেষ্টা চললেও তা খুব বেশি সফল হয়নি। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন সূচিত ও পরিণতি লাভ করে। বাংলা ভাষার যে প্রসার ও শ্রেষ্ঠত্ব, তা বিকশিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশেই। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলা ভাষার যে পরিচিতি কালক্রমে গড়ে উঠেছে, তার সবটাই স্বাধীনতার সূচনাকাল থেকেই আজ পর্যন্ত এসেছে।

প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম ১৯২০ সালের ২৮ জুন চট্টগ্রামের পটিয়া থানার বরমা ইউনিয়নের দেবন্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে বিএসসি (অনার্স) উত্তীর্ণ হন। ১৯৪৫ সালে এমএসসি পাস করার পর ১৯৪৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তরুণ আবুল কাশেম ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ১৫ দিন পরই ১ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিস প্রতিষ্ঠা করেন। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের কৃষ্টি-কালচার, বাঙালি সংস্কৃতি এবং এর স্বাতন্ত্র্য রক্ষার ব্রত নিয়ে তরুণ সমাজকে সংগঠিত করেন তিনি। ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শিরোনামে তিনি একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। সেখানে উর্দুর সাথে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানানো হয়।

১৯৪৭ সালের ১৭ নভেম্বর বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবিতে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনকে ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে একটি স্মারকলিপি পেশ করা হয়। এরও নেতৃত্ব দেন প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম। ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক ছাত্রসভা ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সভাপতিত্ব করেন প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম। ১৯৪৮ সালে ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রদেশজুড়ে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ছাত্র-তরুণদের এ আন্দোলনের মুখে ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ খাজা নাজিমউদ্দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে ৮ দফা চুক্তি করতে বাধ্য হন। চুক্তিতে সংগ্রাম পরিষদের বাংলা ভাষার দাবি দৃশ্যত মেনে নেওয়া হয়। ১৯৪৮ সালের ১৪ নভেম্বর ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। সাপ্তাহিক সৈনিকই পরবর্তীকালে ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে পরিচিত লাভ করে।


বিজ্ঞাপন


১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রজনতার ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যে নির্বিচার গুলিবর্ষণ করে তা ছাত্রসমাজের সাথে সম্পাদিত ৮ দফা চুক্তি ভঙ্গ করার প্রেক্ষাপটেই ঘটেছিল। ১৯৪৮ সালে ১৯ মার্চ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন। ঢাকায় কার্জন হলে এক ছাত্রসমাবেশে ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’— এই বক্তব্য দিলে ছাত্রজনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর অপরিণামদর্শী কার্যকলাপের ফলেই সংগঠিত হয়েছিল।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর