পাহাড়ি অঞ্চলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হাজংদের ভাষা ও সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে বসেছে। এমন অবস্থায় নিজেদের ভাষা টিকিয়ে রাখতে হাজং শিশু থেকে বয়স্ক সবাইকে ভাষা শিখিয়ে চলেছেন এক শিক্ষার্থী তরুণ।
হাজং ভাষা রক্ষায় লড়াকু এই তরুণের নাম অন্তর হাজং। নেত্রকোনার গারো পাহাড়ি অঞ্চল দুর্গাপুরের কুল্লাগড়া ইউনিয়নের খুজিগড়া গ্রামের দিনমজুর হিন্দুবালা হাজং মায়ের ছেলে অন্তর হাজং। বাবা রহিন্দ্র হাজংও দিনমজুর। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে সবার ছোট অন্তর। ব্যবস্থাপনা বিষয়ে পড়েন এমএ শেষ বর্ষে।
বিজ্ঞাপন
হাজং ভাষা রক্ষায় অন্তর ছুটছেন নেত্রকোনা, শেরপুর ও সুনামগঞ্জের গ্রাম থেকে গ্রামে। শতাধিক গ্রামে তিনি হাজং ভাষা শেখানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। দিনমজুর বাবা-মায়ের এই সন্তান প্রাইভেট পড়ানোর আয়েই ব্যয় নির্বাহ করছেন হাজং ভাষা রক্ষার এই লড়াই। অন্তর হাজংয়ের ভাষা টিকিয়ে রাখার চেষ্টাকে প্রশংসনীয় উদ্যোগ বলছেন, শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা।
হাজংদের পাশাপাশি বসবাস করা আরেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর গারো জনজাতির মানুষেরা নিজেদের ভাষায় লেখাপড়াতেও এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু হাজং জনজাতির সবাই বাংলা ভাষায় নির্ভরশীল হতে হতে মায়ের মুখের ভাষাকেই ভুলতে বসেছে। বিষয়টি প্রায় ৫ বছর আগে তাকে আলোড়িত করে। সেই থেকে প্রতিজ্ঞা করে নেমে পড়েন নিজেদের ভাষার বিস্তারে। প্রথমে দুর্গাপুরের বগাউড়া, গোপালপুর, ছনগড়া ,আড়াপাড়া, বিজয়পুর, লক্ষীপুর, ভবানীপুরসহ সীমান্ত ঘেঁষা গ্রামগুলোতে হাজং ভাষার চর্চা করানো শুরু করেন। কখনও বাড়ির উঠানে, কখনও গাছের নিচে, যখন যেখানে সুবিধা সেখানেই গ্রামের শিশু থেকে সব বয়সীদের হাজং ভাষা রপ্ত করানোর কাজ চালান। এভাবেই তিনি নেত্রকোনা, শেরপুর ও সুনামগঞ্জের ১০১ গ্রামের ২০ হাজার হাজং মানুষের কাছে যেতে থাকেন। হাজং ভাষায় নিজস্ব বর্ণ না থাকায় বয়োবৃদ্ধদের কাছ থেকে ভাষা সংগ্রহ করেই হাজংভাষা রক্ষার সংগ্রাম করে চলেছেন তিনি।
নেত্রকোনার দুর্গাপুর সদর থেকে বিজয়পুর হয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্ত লাগোয়া গারো পাহাড়ের ঢালুতে খুজিগড়া গ্রাম। গত রোববার দুর্গম এলাকার এই গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, হাজং জনজাতির ছেলে, মেয়ে, গৃহিণী থেকে সব বয়সী ২০ থেকে ২২ জন বাড়ির উঠানে বসে হাজং ভাষা চর্চা করছেন। কখনও গল্পচ্ছলে, কখনও কেউ হাজং ভাষায় গীত করছেন, গান করছেন, কেউবা কবিতা পড়ছেন। বাকিরা শুনছেন। শেষে গীত, কবিতা, গান, গল্পে থাকা হাজং ভাষার শব্দগুলো নিয়ে চলছে আলোচনা। এভাবেই নিজেদের ভাষা রপ্ত করে নিচ্ছেন সবাই।
কথা হয় হাজং অধ্যুষিত খুজিগড়া গ্রামের বাসিন্দা গৃহিণী নিত্যমনি হাজংয়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের মায়েরা নিজেরা নিজেরা হাজং ভাষাতেই কথা বলতো। দাদিদের কাছেও শুনেছি। আমরাও কিছু কিছু বলতাম। কিন্তু এখনতো বাংলাতেই কথা বলি। আমাদের সন্তানেরাও বাংলাতেই সব সময় কথা বলে। তারা বাড়িতেও হাজং ভাষায় কথা বলে না, জানেও না বেশি। বেশিরভাগতো হাজং ভাষার কিছুই জানে না। আমাদের ভাষাটাতো মুখে মুখে চলে আসতাছে। অন্তর হাজং ৫ বছর ধরে আমাদের গ্রামে সব বয়সীদেরই বাড়ির উঠানে সবাইকে জড়ো করে হাজং ভাষার চর্চা করিয়ে আসছে। আমরাও শিখতেছি। গ্রামের শিশুরাও শিখতেছে। গল্প, কবিতা, গানে গানে আমরা আমাদের ভাষায় কথা বলা শিখতেছি। এইভাবেই যতটুকু টিকিয়ে রাখা যায়। তবে হাজং ভাষার বর্ণ তৈরির উদ্যোগ নিলে ভবিষ্যতে ভাষাটা সহজে আর হারিয়ে যেত না। সরকারিভাবে হাজং ভাষা রক্ষার উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
বিজ্ঞাপন
একই গ্রামের দিনমজুর রত্না হাজং বলেন, মনের কথা পুরোপুরি বুঝিয়ে বলতে গেলে নিজের মায়ের ভাষাতেই বুঝিয়ে বলা যায়। অন্য ভাষাতে ততটা দরদ দিয়ে বুঝানো যায় না। অন্তর ভালো কাজ করতেছে। আমরা শিখতেছি। শিশুরাও শিখতেছে।
বেসরকারি চাকরিজীবী বেনতা হাজং ভাষা চর্চায় যোগ দেন কলেজ শিক্ষার্থী মেয়ে পুস্পাঞ্জলী হাজংকে নিয়ে।
বেনতা হাজং বলেন, মা ও মেয়ে একসঙ্গে শিখছি। অন্তর এলাকার মুরুব্বীদের কাছ থেকে হাজং ভাষার বিভিন্ন শব্দ সংগ্রহ করেছে। সে আমাদের এই শব্দগুলো গল্পের ছলে বলতে বলতে শেখাচ্ছে। তবে এভাবে কতদিন চলবে। আমাদের ভাষার বর্ণ দরকার। নইলে টিকানো যাবে না। অন্তর নিজে থেকে যে উদ্যোগটা নিয়েছে এটাকে এগিয়ে নিতে হলে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
কলেজ শিক্ষার্থী সুস্মিতা হাজং বলেন, অনেক পাখি, নানান খাবার, খেলা, পশুসহ আমাদের জীবন চলার সংস্কৃতিগত ভাষার অনেক শব্দ শিখতেছি অন্তর হাজংয়ের আয়োজনের ভাষা চর্চা থেকে। তিনি সপ্তাহে আমাদের গ্রামে ২ দিন চর্চা করান। ভালোই লাগে। সবাই একসাথে বসে গল্প করতে করতে শিখি। নিজের মায়ের ভাষাতে কথা বলার আনন্দই আলাদা।
ভবানীপুরের অনিতা হাজং বলেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অন্য জনজাতির মানুষের ভাষা সংরক্ষণে সরকার যেমন উদ্যোগ নিয়ে পাঠ্যপুস্তক করে প্রাক প্রাথমিকে পড়ানোর ব্যবস্থা করেছে, তেমনি আমাদের ভাষার জন্যেও উদ্যোগ নিতে হবে।
এ বিষয়ে অন্তর হাজং বলেন, নিজস্ব ভাষা রক্ষায় পাখি, নানান খাবার, সংস্কৃতির নানা বিষয়ে হাজং ভাষায় বলা শব্দগুলোকে সবার সঙ্গে পরিচিত করার মাধ্যমেই চলছে এই ভাষা চর্চা।
হাজং অধ্যূষিত গ্রামে গ্রামে গিয়ে ভাষা চর্চা করানোর কথা জানিয়ে হাজং যুবক অন্তর বলেন, গত ৫ বছরে তিন জেলার ১০১টি গ্রামেই গিয়েছি। এখনও যাচ্ছি। কিন্তু আমি একা এতো গ্রামে যতটুকু যাওয়া প্রয়োজন তা যেতে পারছি না। বারবার তাদেরকে নিয়ে বসা দরকার। কিন্তু ততোটা পারছি না। আমার পরিবার দরিদ্র, দিনের রোজগারে দিন চলে। এতো টাকা, পয়সাও নাই। তবে আমি আমার সাধ্যমতো ভাবিষ্যতেও এই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবো। তবে গবেষণার মাধ্যমে বর্ণ তৈরি করে হাজং ভাষা রক্ষায় সরকারের উদ্যোগ দাবি করেন অন্তর।
শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, হারাতে বসা ভাষা রক্ষায় অন্তর হাজংয়ের উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান খান বলেন, অন্তর হাজং যে তাদের ভাষাটা ধরে রাখতে কাজ করতেছে এটা প্রশংসনীয়। যদিও তার ভাল ইনকাম সোর্স নাই। একজন শিক্ষার্থী হয়েও নিজ উদ্যোগে কাজ করে যাচ্ছে। এটা আসলে অসাধারণ। অন্তর হাজংকে ধন্যবাদ জানাই।
তিনি আরও বলেন, আশা করছি, তার মাধ্যমে হাজং ভাষাটা একটা পর্যায়ে আসবে। একটা পর্যায়ে হয়তো সরকারও উদ্যোগ নেবে। ইতোমধ্যে কয়েকটি ভাষার স্বরলিপির আলোকে বইও তৈরি করা হয়েছে। তা পাঠ্য বই হিসেবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এলাকায় পাঠদানে ব্যবহৃত হচ্ছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এলাকায় তাদেরই জনজাতির শিক্ষক থাকে। তাদের মাধ্যমেই আপাদত পাঠদান কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। আগামীতে আরো বড় আকারে বেশি ভাষা নিয়ে কাজ হবে। ভাষা হারিয়ে যাওয়া অনেক কষ্টকর বিষয়। ভাষাটা যাতে না হারায় এটাই আশা করি।
প্রতিনিধি/টিবি