রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫২ সালে পুরো দেশ যখন উত্তাল কিশোর ফজলুল হক তখন নবম শেণির ছাত্র। ২১ ফেব্রুয়ারি রফিক, জব্বারদের রক্তে ঢাকার রাজপথ লাল হয়ে ওঠে— সেই খবরে সারাদেশের মতো উত্তাল হয়ে ওঠে নাটোরের রাজপথও। সেই আন্দোলনে যোগ দেন কিশোর ফজলুল হক। সময়ের পরিক্রমায় সেই ফজলুল হক এখন ৮৫ বছরের বৃদ্ধ। বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শরীরে বাসা বেঁধেছে রোগ। শরীর আর আগের মতো চলে না। বিছানাতেই সময় কাটে তার। স্ত্রীর সহযোগিতায় কোনোরকমে উঠতে-বসতে পারেন। কাউকে আর তেমন চিনতে পারেন না, পারেন না তেমন কথা বলতেও।
ভাষা আন্দোলনের ৭২ বছর চলে গেলেও রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি ফজলুল হক। বছরে একটি দিন ২১ ফেব্রুয়ারি এলেই প্রশাসন থেকে খোঁজ-খবর নিত, এখন আর তেমন কেউ খবর নেয় না।
বিজ্ঞাপন
কখনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি বা সম্মানের আশা করেননি তিনি। মানুষের ভালোবাসা ও সম্মান নিয়ে জীবনের বাকি দিনগুলো বেঁচে থাকতে চান বলে জানিয়েছেন এ ভাষা সৈনিক।
স্ত্রী, তিন মেয়ে ও এক ছেলে সন্তান রয়েছে তার। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন, ছেলে ওষুধ ব্যবসায়ী।
ফজলুল হক (৮৫) ১৯৩৮ সালে নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলার দমদমা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বোর্ডের সেকশন অফিসার হিসেবে সরকারি চাকরি করেছেন। অবসরের পর ফজলুল হক নাটোর শহরে নিচাবাজারে ওষুধ ব্যবসার সাথে সম্পূক্ত হন। সেই ব্যবসা এখন তার ছেলে দেখাশোনা করেন। বর্তমানে তিনি রাজশাহী তার মেঝ মেয়ের বাসায় বসবাস করছেন।
জানা গেছে, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ৫২’র ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রক্তাক্ত হয়ে ওঠে ঢাকার রাজপথ। এ খবর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে মিছিল ও সমাবেশে উত্তাল হয়ে ওঠে নাটোরের রাজপথও। ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন ফজলুল হক। তিনি তখন জিন্নাহ মেমোরিয়াল বয়েজ হাইস্কুলের (বর্তমানে নাটোর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়) নবম শ্রেণির ছাত্র। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সকালে স্কুলে গিয়ে ক্লাস ক্যাপ্টেনদের সঙ্গে ভাষা আন্দোলনের পরিস্থিতি নিয়ে পরামর্শ সভা করেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
সভায় সিদ্ধান্ত অনুয়ায়ী তিনটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে শহরে মিছিল ও সমাবেশ হয়। ফজলুল হকের নেতৃত্বে সব ক্লাস ক্যাপ্টেনকে নিয়ে প্রধান শিক্ষক দেবেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের কাছে মিছিল করার অনুমতি চান। অনুমতি পেয়ে স্কুলের প্রায় দেড়শ শিক্ষার্থীর মিছিলটি অংশ নেয়।
শহরের আলাইপুর হয়ে নাটোর গার্লস হাইস্কুলে (বর্তমানে নাটোর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়) পৌঁছায়। এরপর বাঁধ সাধেন স্কুলসহ দুইটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের ধ্বনিতে ‘রাষ্ট্র্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে শহরের রাজপথ। মিছিলটি শহরের লালবাজার হয়ে মহারাজা জগদিন্দ্র নাথ হাইস্কুলে গিয়ে পৌঁছায়। স্কুলের প্রধান শিক্ষক গিরিজাশংকর চৌধুরীর অনুমতি পেয়ে শিক্ষার্থীদের যৌথ মিছিল বের করে। কাপুড়িয়াপট্টির পথ ধরে মিছিলটি চৌধুরী বাড়ির আম বাগানে পৌঁছায়। আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্র ছিল এ আম বাগান।
হঠ্যৎ সমাবেশ চলাকালীন পুলিশ আসলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। গার্লস স্কুলের ছাত্রীদের বাড়ি পৌঁছে দেন ফজলুল হক। আন্দোলনকারীদের নামে পুলিশ হুলিয়া জারি করে। তাই ফজলুল হকসহ কয়েকজন এক সপ্তাহের জন্য আত্মগোপনে চলে যান। এ খবর গুজব জানতে পেরে তারা ফিরে আসেন। আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতৃত্বে এবং তমদ্দুন মজলিশের সহযোগিতায় শহরে ভাষা আন্দোলন শুরু হলে কর্মসূচির পোস্টার, মাইকিংসহ প্রচারণার মূল দায়িত্ব পালন করেন ফজলুল হকের নেতৃত্বে একদল শিক্ষার্থী।
ভাষা সৈনিক ফজলুল হকের ছেলে ওয়াসিফ-উল-হক ঢাকা মেইলকে বলেন, আমার বাবা ভাষা অন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। যা আমাদের জন্য গৌরব ও অহংকারের বিষয়। আমার বাবা রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি পাননি। তিনি কোনোদিন তেমন আশাও করেননি। বাবা শুধু মানুষের সম্মান ও ভালোবাসাটুকু চেয়েছেন। বাবা এখন অনেক অসুস্থ। হাঁটা-চলা করতে পারেন না। সবসময় বিছানায় থাকেন। বাবার জন্য সবাই দোয়া করবেন।
বড় মেয়ে রেজিনা আক্তার ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা যখন ছোট তখন বাবা আমাদের ভাষা আন্দোলনের গল্প শুনিয়েছেন। কিভাবে তিনি রাস্তায় রাস্তায় মিছিল করেছেন, ভাষার জন্য আন্দোলন করেছেন তা বলেছেন। বাবা গত করোনার সময় স্ট্রোক করার পর থেকে তেমনভাবে চলাচল ও কথা বলতে পারেন না। কথা বলতে গেলে আটকে যায়। বাবাকে মা-ই দেখাশোনা করেন।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি আরও বলেন, বাবার কোনো পুরস্কার বা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির আশা ছিল না। আমাদের কোনোদিন এ ধরনের কথা বলেননি। তিনি সবসময় বলেছেন মানুষের ভালোবাসা আর সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে চান।
২০১০ সালে ভাষা সৈনিক ফজলুল হককে নাটোর সরকারি বালক বিদ্যালয় শতবর্ষ উৎসবে ভাষা আন্দোলনে অনন্য ভূমিকা রাখায় সম্মাননা প্রদান করা হয়।
প্রতিনিধি/একেবি