প্রত্যন্ত দুর্গম এলাকা থংপং পাড়া প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের জাতীয় পাঠ্যক্রমের পাশাপাশি ম্রো ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হয়। স্কুলের পাশে একটি ছাত্রাবাস আছে তার নাম রুংলেন থারবা হোস্টেল। এটা সম্পূর্ণ অভিভাবকদের অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে।
জেলা শহর থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে লামা উপজেলা রুপসী পাড়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় ক্রাউডং পাহাড়ের (ডিম পাহাড়) থংপং পাড়ায় রুটিন অনুসারে নিজেদের বর্ণমালার ভাষায় লেখাপড়া করতে হয় শুক্রবার ও শনিবার। প্রতিদিন ৩ ঘণ্টা করে পড়ানো হয়। অন্যান্য সরকারি ছুটির দিনেও তার ব্যতিক্রম হয় না।
বিজ্ঞাপন
ম্রো ভাষার শিক্ষক মেন নং ম্রো (৬২) জানান, ২০০৯ সাল থেকেই রুংলে থারবা হোস্টেলে ম্রো বর্ণমালার মাধ্যমে ম্রো ভাষায় শিশু শিক্ষার্থীদের পড়ানো শুরু করা হয়। ম্রো বর্ণমালার স্বরবর্ণ, ব্যাঞ্জন বর্ণ থেকে শুরু করে ইয়াং ঙান ম্রো লিখিত ম্রো ভাষায় রুপ কথার গল্পসহ বিভিন্ন লেখার বই শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয় এবং নিজের ভাষার ওপর কতটুকু দক্ষতা অর্জন করলো তা পরীক্ষা করা হয় বলে জানান তিনি। এছাড়াও রুংলে থারবা হোস্টেলের পাশেই একটি থংপং পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় পাড়াবাসীর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এখানে ২০১১ সাল থেকেই পড়ানো হচ্ছে জাতীয় পাঠ্যক্রমের পাশাপাশি ম্রো ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা। হোস্টেলে যে সব শিক্ষার্থীরা থাকে তাদের থেকে প্রতিজনে বাৎসরিক ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা নেওয়া হয়। মূলত সেই অর্থ থেকে কিছু অংশ ম্রো ভাষা লেখা শেখার জন্য শিক্ষককে প্রতি মাসে মাত্র তিন হাজার টাকা দেওয়া হয়। বর্তমানে রুংলে থারবা হোস্টেলে ১০৭ জন ছাত্র থাকে।
শিক্ষক মেন নং ম্রো বলেন, এই দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তিন হাজার টাকা খুবই সামান্য। কোনো সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সহযোগিতা দেওয়া হয় না। তিনি নিজেদের ভাষাকে টিকিয়ে রাখা, চর্চা অব্যাহত রাখার জন্য সরকারি সহযোগিতা কামনা করেন।
থংপং পাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী ২০২২ সালে এসএসসিতে জিপিএ ফাইভ পাওয়া সং নং ম্রো বলেন, ম্রো শিশুরা যখন প্রথম স্কুলে যায় তারা বাংলা ভাষা মোটেই বুঝতে পারে না। সেখানে যদি ম্রো ভাষার শিক্ষক থাকে এবং ম্রো লেখা দিয়ে যদি স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জন বর্ণ পড়ানো শুরু হয়। তাহলে একজন ম্রো শিশুর প্রাথমিক শিক্ষাটা অনেক আনন্দের হয়।
বিজ্ঞাপন
সংনং ম্রো আরও বলেন, প্রাথমিকে নিজের ভাষায় লেখাপড়াটা মজবুত হওয়ার কারণে তিনি এসএসসিতে ভালো ফলাফল করেছেন। এটা চলমান রাখলে নিজের ভাষাটাও ভালোভাবে আয়ত্বে আনা হলো আর জাতীয় শিক্ষাক্রমে লেখাপড়াটাও সহজ হয়ে যায় বলে জানান এই মেধাবী শিক্ষার্থী।
২০২২ সালে থানছি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় প্রথমবারের মতো জিপিএ ফাইভ প্রাপ্ত ছাত্রী সং নং ম্রো বলেন, প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষকেরা ম্রো ভাষায় পড়া বুঝিয়ে দেওয়ার কারণে দ্রুত পড়া বুঝতে পারতো এবং পরীক্ষায় ভালো হতো। তার ধারণা প্রাথমিকে নিজের ভাষায় লেখা পড়া করার কারণে প্রাথমিক শিক্ষায় ভিত্তি মজবুত হয়েছে। উপরের ক্লাসে আর সমস্যা হয়নি। সেজন্য এসএসসিতে ভালো করেছে বলে সে জানায়।
সং নং ম্রো আরও বলেন, কষ্ট করে অভাব অনটনের মধ্য মানুষের আশ্রয়ে, মানুষের বাড়িতে থেকে লেখা পড়া করেছি। তিনি সবার আর্শীবাদ ও সহযোগিতা কামনা করেন।
বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-অভিভাবক সমাবেশ ও প্রাক্তন শিক্ষার্থী থানছি উচ্চবিদ্যালয় থেকে প্রথম বারের মতো এসএসসি-২২ জিপিএ ৫ প্রাপ্ত সং নং ম্রো ও জিপিএ ৪ দশমিক ৩৩ প্রাপ্ত লেং রুং ম্রোকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়েছিল।
রুংলেং থারবা হোস্টেল পরিচালনা কমিটি ও থংপং পাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মেনরন ম্রোর বলেন, এই বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিশেষত্ব হচ্ছে জাতীয় শিক্ষাক্রম পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি ম্রো ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান করা হয়। শিক্ষক-অভিভাবকসহ এলাকার সচেতন মহল মনে করছেন প্রাথমিক শিক্ষা ম্রো ভাষায় লেখা পড়ার কারণে এই বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পিইসি ও এসএসসি তে ম্রো শিক্ষার্থীরা ভালো ফলাফল করছে বলে জানান তিনি।
থংপং পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তুমরুই ম্রো বলেন, একজন ম্রো শিক্ষার্থী যখন বিদ্যালয়ে যায় প্রথমে সে ভাষা নিয়ে মহা সমস্যায় পড়ে, কারণ শিক্ষার্থী ম্রো সম্প্রদায়ের হয়তোবা শিক্ষক অন্য সম্প্রদায়ের। তখন শিক্ষার্থী ও শিক্ষক একে অপরের ভাষা কেউই বুঝে না, যদি সে বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিজের সম্প্রদায়ের হলে মন খুলে কথা বলতে পারে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগ নিবিড় হয়। শিশুর প্রাথমিক শিক্ষালাভ আনন্দের হয়। আর যদি বিপরীত হয় তাহলে একজন ম্রো শিশুর শিক্ষালাভ করা স্বপ্নই থেকে যায় বলে মনে করেন এই দুর্গম এলাকার শিক্ষাগুরু।
২০২২ সালের জয় বাংলা ইয়ুথ পথ প্রদর্শক পুরস্কার জয়ী লেখক, গবেষক ও রুংলেং থারবা হোস্টেলের প্রধান উদ্যােক্তা ইয়াং ঙান ম্রো বলেন, তিনি যখন গ্রাম ছেড়ে ম্রো আবাসিক উচ্চবিদ্যালয়ে প্রথমে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন তখন নিজের ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা জানতেন না। যার কারণে অন্য সম্প্রদায়ের শিক্ষকেরা কি পড়াচ্ছেন বা কি বুঝাচ্ছেন তিনি কিছুই বুঝতেন না। তার অভিজ্ঞতা থেকে চিন্তা করলেন প্রাথমিক শিক্ষায় যদি নিজের ভাষায়, নিজের সম্প্রদায়ের শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পড়াতেন বা বুঝাতেন, তাহলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করাটা অনেক আনন্দের হতো। সেই চিন্তা থেকেই কোনো সরকারি সহযোগিতা ছাড়া ২০০৯ সালে রুংলেং থারবা হোস্টেলটি মাত্র পনের জন ছাত্র দিয়ে শুরু করা হলেও বর্তমানে ১০৭ ছাত্র রয়েছে। অভিভাবকদের থেকে দেওয়া সামান্য অর্থ দিয়ে ম্রো ভাষা শিক্ষার জন্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় বলে জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, ২০০৯ সালে থংপং পাড়ায় রুংলেং থারবা ছাত্রাবাসটি প্রথমে বাঁশের বেড়া দিয়ে শুরু করা হলেও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ থেকে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে একতলা বিশিষ্ট বিল্ডিং নির্মাণ করে দেওয়া হয়। এই ছাত্রাবাসে বর্তমানে ১০৭জন শিক্ষার্থী বাৎসরিক স্বল্পমূল্যে থাকা খাওয়াসহ লেখাপড়া করে।
বান্দরবান পার্বত্যজেলা পরিষদের সদস্য ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের কনভেইনার লেখক, কবি ও গবেষক সিং ইয়ং ম্রো বলেন, ম্রো অধ্যুষিত এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষায় নিজেদের বর্ণমালায় ম্রো ভাষাও লেখা ব্যবহার করার কারণে ম্রোদের শিক্ষার হার বাড়ছে। বান্দরবান জেলায় বর্তমানে ৫০ হাজারের অধিক ম্রো জনসংখ্যার মধ্যে সাধারণ শিক্ষার হার ৩০ শতাংশ। আর নিজেদের ম্রো বর্ণমালা ভাষায় শিক্ষার হার প্রায় ৭০ শতাংশ। এখন ম্রো গ্রামে কোনো মিটিং হলে কেউ আর টিপসই দেয় না। সবাই নিজেদের বর্ণমালা লেখায় স্বাক্ষর করে বলে জানান তিনি।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের গবেষণা সেল আছে। সেখান থেকে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ণমালা শেখা ও বই প্রকাশনার কাজ করে। কিন্তু কাউকে বর্ণমালা শেখার জন্য শিক্ষক নিয়োগ দেয় না । তবে আগামীতে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ থেকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ণমালার ভাষা-লেখা শেখার জন্য শিক্ষকদেরকে সহায়তা করার বিষয়ে বিবেচনাধীন আছে বলে জানান তিনি।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আব্দুল মান্নান জানান, ২০১৭ সাল থেকে পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ণমালার তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত প্রথমিক শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ম্রো জনগোষ্ঠীর বর্ণ মালায় এখনও জাতীয় শিক্ষাক্রম পাঠ্যপুস্তক বই বের করেনি। আর ম্রো বর্ণমালার শিক্ষককে আলাদা করে বেতন দেওয়ার মতো প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ থেকে বরাদ্ধ নেই। আগামাীতে ম্রো বর্ণমালায় বই বের করা ও ম্রোভাষার শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার ব্যাপারে বান্দরবান পার্বত্য জেলাপরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনা করা হবে বলে জানান তিনি।
প্রতিনিধি/এসএস