শনিবার, ৪ মে, ২০২৪, ঢাকা

সমাজে নারী সমতা প্রতিষ্ঠায় শিক্ষার্থীদের ভাবনা 

সিয়াম মাহমুদ
প্রকাশিত: ০৮ মার্চ ২০২৩, ০৩:২২ পিএম

শেয়ার করুন:

সমাজে নারী সমতা প্রতিষ্ঠায় শিক্ষার্থীদের ভাবনা 

আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ, নারী-পুরুষের সমঅধিকার নিশ্চিত করা, নারীর কাজের স্বীকৃতি প্রদানের পাশাপাশি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সাফল্য উদযাপনের উদ্দেশ্যে নানা আয়োজনে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় দিনটি।

নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে আজকের পৃথিবী। আধুনিক বিশ্বে নারী-পুরুষ সমান অধিকার নিয়ে প্রতিটি স্তরে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু তাদেরকে নানা বাঁধা বিপত্তি, প্রতিকূলতা আর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ন্যায্য অধিকার নিয়ে কর্মস্থলে সফলভাবে কাজ করে যেতে হচ্ছে।


বিজ্ঞাপন


বাংলাদেশ স্বাধীনতার একান্নটি বছর পার করেছে; সরকারি-বেসরকারি নানাবিধ পদক্ষেপের ফলে নারীরা আজ প্রায় সর্বদিক থেকেই এগিয়ে চলেছে। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অর্থনীতি-অধিকার-মত প্রকাশের স্বাধীনতা-স্বনির্ভরতায় নারীরা দৃষ্টান্তমূলক অবদান রাখলেও আজও নারীর প্রতি সহিংসতা ঘটে হরহামেশায়।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বাংলাদেশেও একজন মেয়েকে ‘নারী’ হয়ে ওঠা পর্যন্ত তার চলাফেরা, মতামত প্রকাশ এমনকি যাবতীয় ইচ্ছা-অনিচ্ছার গাইডলাইন নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে নারী সমতার পেছনে প্রতিবন্ধকতার কারণ তুলে ধরেছেন সিয়াম মাহমুদ।

নিরাপত্তাহীনতা নারী অগ্রগতির অন্তরায়

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ বিজনেস এন্ড টেকনোলজি’র কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী মাহবুবা ইসলাম মীম বলেন, নারী পুরুষের সমতার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো সাধারণত লক্ষ্য করা হয়, তা হলো নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ ও সুযোগ, শিক্ষায় অংশগ্রহণ, স্বাস্থ্য ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অনুকূলে কিছুটা সাফল্য মিলেছে। কিন্তু এই সাফল্যটুকু আশানুরূপ নয়, কেননা এখনো আমরা অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে। এই পিছিয়ে থাকার মূল কারণগুলো- বাল্যবিবাহ, তথাকথিত সামাজিক বিধি-নিষেধ এবং নিরাপত্তাহীনতা। একজন নারী প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেন। আজকের তথাকথিত সমাজ এর জন্য সিংহভাগ দায়ী বলে আমি মনে করি। একদল লোক প্রভাব প্রতিপত্তির জোরে সমাজের একটা উঁচু আসনে জায়গা করে নিজেদের মনগড়া নিয়ম বানিয়ে সেটাকে সামাজিক বিধান বলে চালিয়ে দিচ্ছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে চাইলেই তখন আওয়াজ তোলা যায় না। কারণ, নারীরা তাদের বিরুদ্ধে যে আওয়াজ তুলবে এবং সেটার যে স্বাধীনতা তাতে এই সমাজ হস্তক্ষেপ করবে। এই সমাজ নারীদের নিরাপত্তাহীনতার কারণ।


বিজ্ঞাপন


নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য আগে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা দূর করা প্রয়োজন। নারী দিবসে শুধু লোক দেখানো নারীর প্রতি সম্মান এবং দু-চার লাইন নীতিবাক্য না আওড়ে তাদের প্রতি সম্মান আনুন। অন্য নারীর অসম্মানে তাকে এড়িয়ে না গিয়ে পাশে দাঁড়ান। কারণ, ওই অন্য নারীর জায়গায় আপনার মা, বোন কিংবা মেয়ে হতে পারে। এই অন্যের মা, অন্যের বোন এই কথাগুলোর মধ্য থেকে যখন ‘অন্য’ কথাটা বাদ দিতে শিখে যাবো, তখনই সামাজিক পরিবর্তন সম্ভব। শুধু নারী দিবস নয়, প্রতিটি দিন নারীকে সম্মান করতে শিখুন।

নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ রোধ করা প্রয়োজন

সরকারি তিতুমীর কলেজের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী নৌরিন জাহান প্রিয়া বলেন, আধুনিক রাষ্ট্রে অনেক ক্ষেত্রেই নারীর সাফল্য দেখা যায়। নারী পুরুষ সমতা লক্ষ্যে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সাফল্যের স্বীকৃতি মিলেছে। ডব্লিউইএফ যে বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে থাকে তার মধ্যে রয়েছে নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ ও সুযোগ, শিক্ষায় অংশগ্রহণ, স্বাস্থ্য ও আয়ু এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। বাংলাদেশে নারীদের অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রিত্ব স্থলে নারীর অবস্থান রয়েছে। তাছাড়া জাতীয় সংসদের স্পিকার, বিরোধী দলের নেতার আসনও নারীর দখলে।

কিন্তু এত সব সাফল্যের সত্বেও সামাজিক ও ধর্মীয় বিধি-নিষেধের পাশাপাশি নিরাপত্তাহীনতার কারণে অনেক ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সরকারের শীর্ষ পদে নারী থাকলেও সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব আশানুরূপ নয়। দ্বিতীয়ত শিক্ষায় নারী-পুরুষের সমতার দেখা পেলেও কর্মক্ষেত্রে রয়েছে বৈষম্য। কিছু কিছু অঞ্চলে এখনো বাল্যবিবাহ প্রবণতা রয়েছে। এটি কোনোভাবেই সমতার লক্ষণ নয়। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রতি পূর্ণরূপে বিশ্বস্ত থাকলে নারীর প্রতি কোনো রকম বৈষম্য বা বৈষম্যমূলক আচরণ করার সুযোগ নেই।

সাম্য ছাড়া উন্নত সমাজ বা রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব নয়

সরকারি ইডেন মহিলা কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী মুন্নি আক্তার বলেন, একটি পৃথিবীকে সঠিকভাবে ভাবতে গেলে, সৌন্দর্যমণ্ডিত করতে গেলে মানবসভ্যতায় ‘নর’ শব্দটির পাশাপাশি চলে আসে নারীরা। পৃথিবীর জনসংখ্যার অর্ধেকটা জুড়ে আছে নারী। নারীকে বাদ দিয়ে, নারীকে ব্যাহত করে কোনো সভ্য, সুন্দর পৃথিবী গঠন সম্ভব নয়। কিন্তু যুগ যুগ ধরে নারীরা অবহেলিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িত। সাম্য অধিকার ছাড়া উন্নত সমাজ বা রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব নয়। নারী ও পুরুষের মধ্যে প্রতিযোগিতা বা বৈরি থাকলে চলবে না; একে অন্যের সহযোগী হতে হবে। পুরুষকে নারীর প্রতি সংবেদনশীল ও শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। নারীকে পুরুষের চেয়ে ‘দুর্বল ও অধম’ ভাবার একটি চর্চা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে রয়েছে; এর পরিবর্তন দরকার।

নারী পুরুষ একে অপরের সহচর 

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সুরাইয়া খাতুন সিনথিয়া বলেন, নারী পুরুষের সমতা বলতে আমি বুঝি, বিষয়টি আসলে সমতা নিয়ে নয়। সমাজকে সুন্দর ভাবে গঠন করতে হলে নারীদের বেশি অধিকার দিতে হয়, এটি অনৈতিক কোনো ব্যাপার নয়। যেখানে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা পুরুষ নারী ভেদাভেদ করে তৈরি করেছেন, তাই তাদের চাহিদারও ভেদাভেদ আছে। পুরুষ বলবান, নারী সূক্ষ্ম চিন্তাশীল। তাই, যেখানে দৈহিক কাজে পুরুষকে বেশি কন্ট্রিবিউট করতে হবে আর মেন্টাল এ চাইলে মেয়েরা বেশি কন্ট্রিবিউট করতে পারে। তাই নারী পুরুষ অধিকার বা অন্য যে কোনো জিনিস কে সমতা আকারে ভাগ না করে যেখানে যেটা প্রয়োজন সে আকারে ভাগ করা উচিত। কেনো নারী বা পুরুষ কোনো প্রতিযোগিতা থাকা উচিত নয়। তারা একে পরের সহচর। এক বাহনের ২ টা চাকা। 

দেশে বাস্তবে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জেন্ডার এন্ড ডেপলাপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী নাজমিন নাহার সাথী বলেন, নারী এবং পুরুষ প্রতিটা, সমাজ, রাষ্ট্র দেশের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমার কাছে নারী পুরুষের সমতা বলতে মানবজীবনের প্রতিটি পর্যায়ে যেমন রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সম্মান সুযোগ সুবিধা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, তারা সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করলেও উন্নয়নশীল দেশ যেমন বাংলাদেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আজও নারীরা পিছিয়ে। সবক্ষেত্রে আজও সমতা নেই।

নারী হওয়ার কারণে সমাজে প্রত্যেকটা মেয়েই কোন না কোনভাবে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়। হোক সেটা পরিবার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রেই এই প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান থাকে।

উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে নারীরা এগিয়ে যেতে পারেনি

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি'র সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের শিক্ষার্থী ঐশ্বর্য্য ইকা বলেন, নারী পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। কেউ কাউকে ছাড়া চলতে পারে না। সংসার থেকে সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে উভয়ের অংশগ্রহণে কাজ সুন্দর হয়। কিন্তু আমাদের সমাজে নারীদেরকে এখনও নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে চলতে হয়।

নারীরা তার কর্মক্ষেত্রে অবহেলিত হয়। নির্যাতন ও ধর্ষণ যেন, নিত্যদিনের ঘটনা। সময়ের প্রেক্ষাপটে নারীর ওপর নির্যাতনের ধরন পাল্টেছে, বেড়েছে নারী-শিশু ধর্ষণের সংখ্যা। কখনও পাচার, কখনও এসিড সন্ত্রাস, কখনও বা যৌতুকের কারণে নির্যাতিত হচ্ছে নারী। উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে নারীরা এগিয়ে যেতে পারেনি। নারীরা এখনও পিছিয়ে আছে। নারীদেরকে পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। নারীদের প্রতি সুন্দর মানসিকতা তৈরি করতে পারলে, সমাজে নারী সমতা প্রতিষ্ঠিত হবে।

জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ-বর্ণ-নির্বিশেষে জেন্ডার সহিংসতা নির্মূল করতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রত্যেকে জেন্ডার সংবেদনশীল হতে হবে। বন্ধ করতে হবে নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা। তাহলেই, নারী সমতা ও ক্ষমতায়নের মাধ্যমে উন্নত সমৃদ্ধ আধুনিক সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব। 

এনএম/এমএইচটি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর