দরিদ্র পরিবারের শ্রীমতি ঊষারাণী (৬১)। তরণী বয়সে হারিয়েছেন স্বামীকে। আলোকিত জীবনে নেমে আসে অন্ধকারের ছায়া। জীবনযুদ্ধে ছুটছিলেন জীবিকার সন্ধানে। এরই মধ্যে যোগ দেন একটি মিষ্টির দোকানে। ফুটপাতের এ দোকানেই কয়েক যুগ ধরে গুড়ের জিলাপির কারিগর হিসেবে কাজ করছেন। সেখানে টানা ১৪ ঘণ্টা কাজ করে মজুরী পাচ্ছেন ১৭০ টাকা।
বুধবার (৮ মার্চ ) নারী দিবসের এইদিনে দেখা যায়, ঊষারাণীর জিলাপির তৈরীর চিত্র। গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর বাজারস্থ ভাই ভাই জিলাপী স্টোরে চুলায় লাকড়ি জ্বালিয়ে আপন খেয়াল আর হস্তের তালে গুড়ের জিলাপি বানাচ্ছিলেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
আরো পড়ুন: পুরুষের মতই পাথর ভাঙে হাজারো নারী, মজুরিতে বৈষম্য
জানা যায়, গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার কামারপাড়া ইউনিয়নের খামার বাগচি গ্রামের মৃত জগনাথ চন্দ্রের মেয়ে শ্রীমতি ঊষারাণী। তার বয়স যখন ১৯ বছর, তখন বিয়ে হয় সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হাতিয়া গ্রামের সুবল চন্দ্রের সঙ্গে। এ বিয়ের এক বছর পরই কোলজুড়ে জন্ম নেয় ফুটফুটে একটি কন্যাসন্তান। ভালোই চলছিল সংসার। এরই মধ্যে মারা যায় স্বামী সুবল চন্দ্র। কোলের শিশু সন্তান নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়তে হয় তাকে। নেই স্বামীর আর্থিক স্বচ্ছলতা।
একেবারই থমকে যায় জীবন-জীবিকা। বাধ্য হয়ে আবারও বসবাস শুরু করে পিতার বাড়িতে। বাবা জগনাথ চন্দ্রও দিন আনে দিন খায়। এমতাবস্থায় জীকার সন্ধানে কোলের শিশুকে নিয়ে ছুটতে হয় এদিক-সেদিক। ধীরে ধীরে বড়ো হতে থাকে সন্তানটি। একপর্যায়ে সাদুল্লাপুর বাজারের ভাই ভাই জিলাপী স্টোরে আশরাফুল ইসলামের একটি ফুটপাতের মিষ্টির দোকানে কাজ নেয়। সেখানে তৈরী করে দেয় গুড়ের জিলাপি। সেই সময়ে মজুরী ছিল তার ৩ টাকা। প্রায় ৪১ বছর ধরে একই দোকানে কাজ করে চলেছেন তিনি। বর্তমানের মজুরী পান ১৭০ টাকা। এর আগে তার একমাত্র মেয়ে শিল্পী রাণীকে অনেক কষ্টে বিয়ে দিয়েছে। থাকার টিনসেড ঘরটিও জরাজীর্ণ অবস্থায়। সারাদিন পরিশ্রম করে ঘরে ভালোভাবে ঘুমাবেন, সেটিও সম্ভব হয় না তার। ঝুঁকিপূর্ণ ঘরে ঝড়-বৃষ্টির আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাতে হচ্ছে। এভাবে তরুণী বয়স থেকে স্বামীহারা হয়ে এখন বৃদ্ধা বয়স পর্যন্ত জীবন সংগ্রামে অব্যাহত রয়েছে ঊষারাণীর।

বিজ্ঞাপন
ওই মিষ্টির দোকানের বর্তমান মালিক আশরাফুল ইসলাম বলেন, আমাদের দোকানে জিলাপির কারগির হিসেবে ৪১ বছর ধরে কাজ করে চলেছে ঊষারাণী। দিনমজুরী হিসেবে আগে পেয়েছিলেন ৩ টাকা, এখন বেতন দেয়া হয় ১৭০ টাকা। এদিয়ে জীবনযাপন চলছে তার।
অসহায় শ্রীমতি ঊষারাণী বলেন, একটি সন্তান রেখে আমার স্বামী মারা গেছেন ৪১ বছর আগে। সেই থেকে একই দোকানে জিলাপি বানানো কাজ করছি। এখান সকাল ৮ থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত কাজ করে দৈনিক মজুরী পাই ১৭০ টাকা। অথচ পুরুষ শ্রমিকের কাজের মজুরী দেওয়া হয় ৪০০ টাকা।
আরো পড়ুন: কালো বলে ৩৪ দিনে সংসার ভাঙ্গা রুবিনা এখন সমাজের আলো
তিনি আরও বলেন, আমার বাপে ৫ শতক জমি দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ৩ শকত জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। বাকি ২ শতক জমিতে একটি টিনের ঘর তুলে কোনমতে বসবাস করছি। আমাকে যদি সরকারিভাবে একটি পাকা ঘর দিতেন, হয়তো শেষ বয়সে আরাম-আয়েশে রাতযাপন করতে পারতাম।
কামারপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান মাহফুজার রহমান রাশেদ বলেন, ঊষারাণীর ব্যাপারটি জানা নেই। খোঁজ নিয়ে তাকে সহযোগিতা করা যেতে পারে।

গাইবান্ধা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি অ্যাভোকেট শাহাদৎ হোসেন লাকু বলেন, দরিদ্রপীড়িত এলাকা গাইবান্ধা। এ জেলার অর্ধেক দিনমজুর হিসেবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। আর চরাঞ্চলে কৃষি জমিতে কাজ করছেন অধিকাংশ নারী শ্রমিক। তবে শুরু থেকে তারা মজুরি বৈষম্যের শিকার। তার মধ্যে ঊষারানীও একজন। এই বৈষম্য দূর করা দরকার।
প্রতিনিধি/একেবি



















