শনিবার, ৪ মে, ২০২৪, ঢাকা

সুঁই-সুতায় ‘অনন্যা আপা’র ভাগ্য বদল, ১০ টাকার পুঁজিতে ৩৫ লাখ টাকা

নাঈম ইসলাম
প্রকাশিত: ০৮ মার্চ ২০২৩, ১০:৪০ পিএম

শেয়ার করুন:

সুঁই-সুতায় ‘অনন্যা আপা’র ভাগ্য বদল, ১০ টাকার পুঁজিতে ৩৫ লাখ টাকা

সুঁই-সুতায় তারা বদলে ফেলেছেন নিজেদের জীবনের গল্প। তাদের আলোর দিশারী শেরপুর শহরের আইরিন পারভীন। শহরে এখন তিনি ‘অনন্যা আপা’ নামেই পরিচিত। তিনি স্বাবলম্বী করে তুলেছেন তার মতো আরও অনেক নারীকে।

২০০২ সালে যুব উন্নয়ন অধিদফতর থেকে সফল আত্মর্কর্মী হিসেবে পুরস্কৃত হন আইরিন পারভীন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন উদ্যোক্তা পুরস্কার পেয়েছেন।


বিজ্ঞাপন


জীবন-জীবিকার তাগিদে কর্মক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি অতুলনীয় ভূমিকা রাখছেন শেরপুরের নারীরা। ইতোমধ্যে অনেক নারী হয়ে উঠেছেন উদ্যোক্তা, ঘুরাচ্ছেন সংসারের অর্থনীতির চাকা, অবদান রাখছেন দেশের অর্থনীতিতেও।

জেলার বেশিরভাগ নারী উদ্যোক্তারা নারীদের ঝরে পড়া চুল দিয়ে হেয়ার ক্যাপ এবং বুটিক ও নকশি কাঁথায় স্বপ্ন বুনছেন।

ঢাকা মেইলকে আইরিন পারভীন বলেন, স্কুল জীবনেই মায়ের কাছে শেখেন সেলাইয়ের কাজ। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াবস্থায় মাফলার সেলাই করে মজুরি পেয়েছিলেন দশ টাকা। আর সেই দশ টাকা উপার্জনের চেষ্টার মূলধন এখন পঁয়ত্রিশ লাখ টাকা। সুঁই সুতোয় স্বপ্ন বুনে শেরপুর পৌর শহরের বাসিন্দা আইরিন পারভীন এখন সফল উদ্যোক্তাদের একজন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজ চেষ্টায় তিনি বাড়ান ব্যবসার পরিধি। শহরের প্রাণকেন্দ্র নিউমার্কেটে ‘অনন্যা বুটিকস’ ও নতুন ভবনের ২য় তলায় ‘অনন্যা এস্কক্লুসিভ বুটিকস’ নামে দুটি শো-রুম রয়েছে তার। শহরেই রয়েছে তার পণ্য তৈরির দুটি কারখানা।

আইরিন পারভীনের দুটি কারখানায় কাজ করছেন প্রায় দুইশতাধিক নারী। শহরের বড় কোনো কল কারখানা না থাকায় এখানকার নারীরা বেশিরভাগই বেকার। আর এমন নারীদের কাজের জায়গা করে দিচ্ছে আইরিন পারভীন। এসব নারীরা বাড়ির কাজের ফাঁকে করেন হস্তশিল্পের কাজ। তার কারখানার কর্মীদের অনেকের মা এখানে কাজ করে সংসারের অবস্থার পরিবর্তন করেছেন, এখন মেয়েও যুক্ত হয়েছেন একই পেশায়। আর এখানে কাজ করে অনেকেই হাল ধরেছেন তাদের সংসারের। কর্মীদের হাতে তৈরি আইরিনের পণ্য রাজধানীর বড় বড় শো-রুমে বিক্রি হচ্ছে। যাচ্ছে ভারত, আমেরিকাসহ মধপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশেও। মেয়েদের পোশাক, বিছানার চাদর, বালিশের কভার, নকশি কাঁথাসহ শিশুদের জন্য তৈরি হচ্ছে বাহারি ডিজাইনের পোশাক।


বিজ্ঞাপন


অনন্যা বুটিকে হস্তশিল্পের কাজ করেন আফরোজা বেগম। তিনি বলেন, ‘বাপু, সংসাওে বহুত খরচ। বেডাইনে (স্বামী) কাম (কাজ) কইরা যে ট্যাহা (টাকা) পায়, তা দিয়ে সংসার চালানো মুশকিল। পুলাপাইনের খরচ এহন খুব বেশি। আমি পরাই (প্রায়) ১০ বছর ধইরা এহানে কাম করি। আমি যে ট্যাহা পাই তা দিয়ে পুলাপাইনের খরচটা কোনমতে চলে।

দিঘারপাড় মহল্লার সুলতানা বেওয়া ২০বছর ধরে কাজ করেন আইরিন পারভীনের সঙ্গে। তিনি বলেন, এহান (এখান) থেকে যে ট্যাহা (টাকা) পাই তা দিয়ে সংসারের খরচ চালাই। বেডাইন (স্বামী) বাইচ্চা থাকতেও এহানে কাম করছি। আমার কোনো চশমা লাগে না, এমনিতেই চোহে  চোখে) দেখি। আপা আমগোরে খুব আদর করে।

শহরের নবীনগর মহল্লার সুমাইয়া পারভীন অঞ্জনা বলেন, আমি বেশিরভাগ বুটিকসের জামা পড়ি। আগে এসব জামা ময়মনসিংহ হতে কিনে আনতাম। এখন হাতের কাছেই পাওয়া যাচ্ছে তাও আবার নিজ শহরেই তৈরি। দেখে শুনে পছন্দের পোশাক নিতে আমি অনন্যা বুটিকসেই আসি। আমার বান্ধবীরাও এখান থেকে পোশাক নেয়।

সজবরখিলা মহল্লার আরিফা আঁখি নকশি কাঁথা কিনতে এসেছেন অনন্যা বুটিকসে। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি আট বছর ধরে আইরিন আপার কাছ থেকে কাঁথা নিই। গত তিনমাস আগেও একটা নিয়েছি, সেটা দেখতে খুব সুন্দর ছিল। এবার আরেকটা নিতে এসেছি আমার বোনের জন্য। শহরে নকশি কাঁথার আরও শো-রুম থাকলে বেশি ক্রেতা আসতো, আর এতে উদ্যোক্তারা আরও আগ্রহী হবে।

অনন্যা বুটিকের স্বত্বাধিকারী ও নারী উদ্যোক্তা আইরিন পারভীন বলেন, ছাত্র জীবনের সেই দশ টাকায় আমাকে উদ্যোক্তা হওয়ার পথ দেখিয়েছে। আমি সরকারি কিংবা বেসরকারি সহযোগিতা পেলে কর্মীদের নিয়ে আরও ভালো কিছু উপহার দিতে পারব। পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে অনেকের। এরই মধ্যে আমার এখানে কাজ করে অনেক নারীই স্বাবলম্বী হয়েছেন। নিয়েছেন অনেকেই প্রশিক্ষণ। আর আমি মায়ের মতো জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেলাইয়ের কাজ করে যেতে চাই। আর নতুনদের প্রতি আমার অনুরোধ, হাল ছাড়া যাবে না। লেগে থাকলে সফলতা আসবেই।’

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ শেরপুর জেলা শাখার সভানেত্রী জয়শ্রী দাস লক্ষী ঢাকা মেইলকে বলেন, শেরপুরের নারী উদ্যোক্তারা বুটিক আর নকশি কাঁথায় স্বপ্ন বুনছেন। এটা ভালো সংবাদ। এতে করে নারীরা জীবন জীবিকার তাগিদে কর্মক্ষেত্রে অতুলনীয় ভূমিকা রাখছেন পুরুষের পাশাপাশি। ফলে অনেক নারীই হয়ে উঠেছেন উদ্যোক্তা। ঘুরাচ্ছেন সংসারের চাকা। অবদান রাখছে দেশের অর্থনীতিতে। আইরিনের পণ্যেও মানও ভালো, আমি নিজেও তার শো-রুমে যায়।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) শেরপুরের সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আতাউর রহমান ফকির ঢাকা মেইলকে বলেন, জেলায় প্রায় ১২শ উদ্যোক্তা রয়েছে। আমরা উদ্যোক্তাদের পাশে থেকে নিয়মিত সহযোগিতা করে যাচ্ছি। যারা নকশী কাঁথা নিয়ে কাজ করছেন, এমন অনেকেই প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। আবার আমরা বেশ কয়েকজনকে ঋণের আওতায় এনেছি। যদি কোনো উদ্যোক্তা বিসিকের কাছে সহযোগিতা চায় তাহলে তাদের সহযোগিতা করা হবে। পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের চাহিদা অনুযায়ী বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ করানো হবে। সম্প্রতি আমরা ৫০জন উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণের আওতায় এনেছি।

জেলা মহিলা ও শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা লুৎফুল কবির বলেন, আমরা নিয়মিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উদ্যোক্তা তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছি। তারা প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেদের সংসারের হাল ধরছেন। পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি ভূমিকা রাখছেন। আইরিন পারভীন একজন ভালো মানের উদ্যোক্তা। অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে তার সেন্টারে।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) শেরপুরের সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আতাউর রহমান ফকির ঢাকামেইলকে বলেন, আমরা উদ্যোক্তাদের পাশে থেকে নিয়মিত সহযোগিতা করে যাচ্ছি। সম্প্রতি আমরা দুদফায় ৫০জনকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। এদের মধ্যে অনেকেরই ঋণের আওতায় আনা হয়েছে। যদি কোনো উদ্যোক্তা বিসিকের কাছে সহযোগিতা চায় তাহলে তাদের পরবর্তীতে সহযোগিতা করা হবে। পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের চাহিদা অনুযায়ী বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ করানো হবে।

প্রতিনিধি/এসএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর