শনিবার, ৪ মে, ২০২৪, ঢাকা

নারী চা শ্রমিক: বৈষম্যের আড়ালে নিষ্পেষিত জীবন

পুলক পুরকায়স্থ
প্রকাশিত: ০৮ মার্চ ২০২৩, ০১:১৫ পিএম

শেয়ার করুন:

নারী চা শ্রমিক: বৈষম্যের আড়ালে নিষ্পেষিত জীবন
ছবি: ঢাকা মেইল

চা গাছের ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’ তোলার কাজে অধিকাংশ সময় ব্যস্ত থাকেন নারী শ্রমিকরা। তাই চা শিল্পের সঙ্গে নারী শ্রমিকদের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। কারণ এই কুঁড়ি উত্তোলনে পুরুষ শ্রমিকদের থেকে নারী শ্রমিকরা অধিক দক্ষ। মূলত পাহাড়ের টিলায় প্রত্যেক নারী শ্রমিকের জীবনের ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশটি বছর কেটে যায়। চা বাগানের সবুজ বুকে পাতা তোলার ছবি যতটা চোখকে মুগ্ধ করে। কিন্তু বৈষম্যের আড়ালে এই নারীদের জীবন কাটে অবহেলায়। নিষ্পেষিত জীবনের অংক তাদের মেলে না।  

জেলায় দৈনিক ১৭০ টাকা মজুরিতে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে নারী শ্রমিকরা বিশাল বাগানের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে চায়ের কুঁড়ি তোলেন। তারা দলবেধে পাহাড়ের পর পাহাড়ের গাঁ বেয়ে টিলায় টিলায় কাজ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে পর্যাপ্ত খাদ্য, চিকিৎসাসহ মৌলিক অধিকারও ঠিকমতো পান না তারা। অপুষ্টি ও দরিদ্রতায় যেন নতজানু এক একটি চা শ্রমিকের পরিবার।


বিজ্ঞাপন


moulobibazar

জেলার বিভিন্ন চা বাগানের একাধিক নারী শ্রমিক জানান, তারা প্রতিদিন আট ঘণ্টা কাজ করেন। আর পুরুষ শ্রমিকরা কাজ করেন তিন থেকে চার ঘণ্টা। অথচ উভয়ই সমান মজুরি পান। এই মজুরির টাকাও সব সময় তুলতে পারেন না নারী শ্রমিকরা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দিনশেষে বাগান কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নারী শ্রমিকদের পক্ষে তাদের স্বামী বা পরিবারের পুরুষরা মজুরির টাকা উত্তোলন করেন। নিজের পরিশ্রমের টাকা ব্যয়ের ক্ষেত্রেও নারীদের মতামত নেওয়া হয় যত সামান্য।

নারী চা শ্রমিকরা আক্ষেপ করে জানান, চা শিল্পের উন্নতি হলেও বদলাচ্ছে না তাদের জীবন। সারাদিন কাজের পর একজন চা শ্রমিকের আয় হয় ১৭০ টাকা। নেই নিজস্ব জাতিগত পরিচয়, লেখাপড়ার সুযোগ নেই, নেই স্যানিটেশনও, রয়েছে চিকিৎসার অভাব।

moulobibazar


বিজ্ঞাপন


দেওরাছড়া চা বাগানের নারী চা শ্রমিক অলকা মিদা। আলাপকালে ঢাকা মেইলকে বলেন, ছয় সদস্যের পরিবার নিয়ে গবাদি পশুসহ ছোট ভাঙা ঘরে থাকতে হয়। বাগান কর্তৃপক্ষের ঘর মেরামত করে দেওয়ার কথা থাকলেও তা হয় না। বছরের পর বছর এমন করেই চলছে। আমাদের নিজস্ব কোনো জায়গা নেই। বাগানে কাজ না করলে থাকার জায়গাও হারাতে হবে। রুজিও হারাতে হবে। মরতে হবে না খেয়ে।

প্রতিদিনই জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। কিন্তু মজুরি যা পান তা দিয়ে সংসার চালানো এখন কষ্টকর হয়ে গেছে জানিয়ে নারী চা শ্রমিক শান্তনা উরাং বলেন, বাড়িতে শাশুড়ি, ছোট দুই মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। আমার একার রুজি দিয়েই সংসার চালাই। রেশনে তিন কেজি আটা পাই। চাল, ডাল, তেলসহ অন্যান্য পণ্য কিনতে হয়। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ ও অসুখ হলে চিকিৎসা করাতে হয় সেই মজুরির টাকা দিয়ে। প্রায়ই ধারদেনা করে সংসার চালাতে হয়।

100%

উদনা চা বাগানের নারী চা শ্রমিক অনিতা বুনার্জীর বলেন, দেশের সব চা বাগানেই প্রধান শ্রমিক মূলত নারীরা। অন্যদিকে পুরুষরা অনেকসময় কাজে ফাঁকি দিলেও আমরা কিন্তু তা করি না। সে হিসেবে পুরুষদের চেয়ে নারীদের মজুরি বেশি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দু’জনের মজুরিই সমান।

শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা বাগানের নারী চা শ্রমিক শ্যামলী বীন বলেন, প্রায়ই আমাদের মজুরির টাকা স্বামীরা তুলে আনেন। নিজেদের টাকা নিজে ব্যয় করতে পারি না। স্বামীর হাতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়।

স্থানীয় পরিবেশ কর্মী কাজল হাজরা বলেন, পুরুষ শ্রমিকরা পদোন্নতি পেয়ে ‘সরদার’ বা ‘বাবু’ হলেও নারী শ্রমিকদের সাধারণত পদোন্নতি দেওয়া হয় না। এছাড়া মাতৃত্বকালীনও বঞ্চনার শিকার হন চা বাগানের নারী শ্রমিকরা। রয়েছে স্যানিটেশন ও চিকিৎসার অভাব।

moulobibazar

জেলা চা কন্যা নারী সংগঠনের সভাপতি খাইরুন আক্তার বলেন, বাগানে নারীরা বেশি পরিশ্রম করেন, অথচ মজুরি পান পুরুষের সমান।

চা শ্রমিক অধিকারকর্মী মোহন রবিদাস বলেন, অনেক প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে নারী চা শ্রমিকদের কাজ করতে হয়। কর্মক্ষেত্রে পয়ঃনিষ্কাশন ও সুপেয় পানির অভাবে তারা অনেক কঠিন রোগের শিকার হন। চা বাগানগুলোতে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার মানের অবস্থা খুবই নাজুক। এখানে স্বাস্থ্যসেবার নামে চলে রসিকতা।

চা শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করছেন এস এম শুভ। তিনি ঢাকা মেইলকে জানান, বর্তমানে চা বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল। বিশ্বের প্রায় ২৫টি দেশে চা রফতানি হয় বাংলাদেশ থেকে। পাঁচ লক্ষাধিক জনগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শ্রমে সচল হয় দেশের অর্থনীতি। চা শ্রমিকরা যে মজুরি পান এতে তাদের পুষ্টির ন্যূনতম চাহিদাও পূরণ হয় না। কর্মক্ষেত্রে বিশ্রাম, পানীয় জল ও স্বাস্থ্যকর সেনিটেশনের অভাবে শ্রমিকরা আছেন চূড়ান্ত স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। শ্রমিকদের বড় অংশই ভোগেন রক্তশূন্যতায়। চা শ্রমিকদের ৬৪ শতাংশই নারী শ্রমিক। তাদের অবস্থা সত্যিই করুণ।

moulobibazar

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি রামভজন কৈরি নারীদের বঞ্চনার উদাহরণ দিয়ে জানান, মাতৃত্বকালীন ক্ষেত্রে চা বাগানের নারী শ্রমিকদের পূর্ববর্তী তিনমাসের কাজের ওপর ভিত্তি করে ভাতা দেওয়া হয়। ফলে কিছু বেশি ভাতা পাওয়ার জন্য গর্ভাবস্থায় বাগানের নারীরা আরো বাড়তি পরিশ্রম করেন। এতে মা ও সন্তান দুজনেই স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে।

চা-বাগানের মালিকপক্ষের সংগঠন বাংলাদেশ চা সংসদের সিলেট অঞ্চলের চেয়ারম্যান জি এম শিবলী জানান, শ্রমিকদের ইউনিয়ন আছে। ইউনিয়নের সঙ্গে দুই বছর পরপর মালিকপক্ষের আলোচনার মাধ্যমে সবকিছু ঠিক করা হয়। চা বাগানে সব শ্রমিক বিনামূল্যে থাকার সুযোগ পাচ্ছেন। বাড়ির খোলা জায়গায় সবজি চাষ, এমনকি ধানও চাষ করেন অনেকে। বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হয়। হাসপাতাল আছে। সবকিছু হিসাব করলে অন্য যেকোনো ইন্ডাস্ট্রির শ্রমিকের চেয়ে এই শ্রমিকেরা ভালো আছেন।

টিবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর