মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

কালো বলে ৩৪ দিনে ভাঙে সংসার, সেই রুবিনা এখন সমাজের আলো

মো. লিটন হোসেন লিমন
প্রকাশিত: ০৮ মার্চ ২০২৩, ১০:১৯ এএম

শেয়ার করুন:

কালো বলে ৩৪ দিনে ভাঙে সংসার, সেই রুবিনা এখন সমাজের আলো
রুবিনা খাতুন (৩৯)

গায়ের রঙ কালো বলে টিকেনি স্বামীর সংসার। মাত্র ৩৪ দিনে ভেঙে যায় সেই ঘর। এরপর ঠাঁই হয় বাপহারা মা-ভাইয়ের সংসারে। স্বামীর ঘৃণা আর সমাজের মানুষের নিন্দা-অবহেলাকে পায়ে ঠেলে ভাগ্য বদলে গড়ে তোলেন কৃষি খামার। অদম্য ইচ্ছে শক্তি ও মনের জোরেই জীবন-যুদ্ধে লড়ে সফল হয়েছেন নাটোরের রুবিনা খাতুন (৩৯)।

মেধা ও কঠোর পরিশ্রম দিয়ে সফলতাকে জয় করেছেন রুবিনা। সমাজের মানুষের কাছে অবহেলিত সেই মেয়েটি এখন সমাজে আলো ছড়াচ্ছেন। নাটোরের মানুষের কাছে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিত তিনি।


বিজ্ঞাপন


উদ্যোক্তা রুবিনা খাতুন নাটোর সদর উপজেলার একডালা চাঁদপুর গ্রামের মৃত আব্দুর রহমানের মেয়ে। পরিবারে দুই বোন এক ভাই রয়েছে। রুবিনা খাতুন পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান।

সেই ‘কালো মেয়ে’ তকমা দেওয়া নারী উদ্যোক্তা রুবিনা খাতুনের খোঁজে নাটোর সদর উপজেলার চাঁদপুর তার গ্রামের বাড়িতে যান ঢাকা মেইলের প্রতিবেদন মো. লিটন হোসেন লিমন। এসময় রুবিনা খাতুন বাড়িতে গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি ও কবুতরদের খাবার দেওয়া ও পরিচর্যায় ব্যস্ত তিনি। কাজের ফাঁকে কথা হয় তার সংগ্রামী জীবন নিয়ে।

রুবিনা খাতুন বলেন, ২০১২ সালের ২৯ এপ্রিল পারিবারিকভাবে মোবাইলের মাধ্যমে বিয়ে হয়। কিছুদিন পর হুমায়ুন দেশে ফিরে আসে। মাত্র ৩৪ দিন স্বামীর সংসার করি। তারপরই আবারও সৌদি চলে যায় স্বামী হুমায়ুন। এরপরই শুরু হয় শাশুড়ি ও ননদের মানসিক অত্যাচার। আমার বিরুদ্ধে তাদের একটাই অভিযোগ আমার গায়ের রঙ কালো। তারপর শ্বশুর বাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে চলে আসি। কিছুদিন পরই  স্বামীর পাঠানো তালাকনামা পাই। মা আর ছোট ভাইয়ের সংসারে স্থায়ীভাবে ঠাঁই হয়। বসে থেকে তো জীবন চলে না। তাই কিছু করার চেষ্টা করলাম। সর্বপ্রথম কাপড় সেলাইয়ের কাজ শুরু করলাম। তারপর ভাবলাম কাপড় সেলাইয়ের পাশাপাশি কিছু একটা করি। এরপর একটি এনজিও থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ব্রয়লার মুরগির খামার করলাম। প্রথম বার মুরগি পালনে লোকসান গুনতে হয়। দ্বিতীয়বার আবারও ব্রয়লার মুরগি পালন শুরু করি। তারপর ৩০ হাজার টাকা লাভ হয়।  তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি আমাকে। এরপর বাবার রেখে যাওয়া জমিতে কৃষি আবাদ শুরু করি।


বিজ্ঞাপন


জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ১২ বিঘা জমি থেকে প্রথমে দেড় বিঘা জমিতে পেয়ারা বাগান করি। বাড়ির পাশের পুকুরে শুরু করি মাছের চাষ। পরে নিজেদের জমির সঙ্গে ৬ বিঘা জমি লিজ নিয়ে মোট ১৮ বিঘা জমিতে পেয়ারা, লিচু, ড্রাগন, কলা, বরই, আম, নারকেল ও নানান জাতের সবজি চাষ করি। বর্তমানে বাড়ির আঙ্গিনায় গরু-মুরগি ফার্ম রয়েছে। পাশাপাশি ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন করছি। এছাড়া জমিতে ভুট্টা, পেঁয়াজ, ধনিয়া, সরিষা চাষ করছি। বর্তমানে আমি একটি রেস্টুরেন্ট চালাচ্ছি। মহান আল্লাহের রহমতে অনেক সুখে দিন কাটছে আমার।

সংগ্রামী নারী রুবিনা খাতুন আরও বলেন, সমাজের কিছু মানুষ আমাকে অবজ্ঞা ও অবেহলা করেছেন। তারা বলেছেন, আমি জীবনে কিছু করতে পারবে না। এখন সেই মানুষগুলো আমার কাছে সহযোগিতার জন্য আসে। তখন আমার কাছে এতটা ভালো লাগে যারা আমাকে অবহেলা ও অবজ্ঞা করেছেন তারাই আমাকে সহযোগিতার জন্য আসছেন।

আমি তাদের বিপদ-আপদে পাশে থাকার চেষ্টা করছি। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি তাদের কাছে, আর আমার মন মানসিকতা আমার কাছে।

আমি নারী হয়ে কাজ করে দেখিয়েছি, নারীরাও চাইলে সবকিছু জয় করতে পারেন। আমার মতো যারা নারী রয়েছে, তারা ঘরে বসে না থেকে কাজ করে নিজেকে এগিয়ে নিতে হবে। কাজ করার জন্য বেশি টাকার প্রয়োজন হয় না।

সমাজ কি ভাবল, সমাজের মানুষ কি বলল তা না দেখে একজন নারীকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

কৃষিতে অবদান রাখায় নারী উদ্যোক্তা হিসেবে রুবিনা খাতুন পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার-২০২১ পদক। নারী খামারি হিসেবে কেআইবি কৃষি পদক- ২০১৮ রাষ্ট্রপতির হাত থেকে গ্রহণ করেন।

এছাড়াও নারী উদ্যোক্তা হিসেবে পেয়েছেন জয়িতাসহ বেশ কয়েকটি সম্মাননা। ২০১৫ সালে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির এক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে ২ লাখ টাকা পুরস্কারও জিতেন।

প্রতিনিধি/এসএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর