২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস। ওডিআই ও টেস্ট ফরম্যাটের দাপটের মাঝেই নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে বসলো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম আসর। নতুন সংস্করণে আয়োজিত ১২ দেশের ‘মিনি বিশ্বকাপের’ ফাইনালে মুখোমুখি পুরো টুর্নামেন্টেই দারুণ ছন্দে থাকা দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও পাকিস্তান।
জোহানেসবার্গের সেই ফাইনালে ক্ষণে ক্ষণে বদলে যেতে থাকলো ম্যাচের রং— কখনো নীল, কখনোবা সবুজ। শেষ ওভারে এসে পাকিস্তানের সামনে সমীকরণ দাঁড়ালো ৬ বলে ১৩ রান, ক্রিজে তখন মিসবাহ- আসিফ, পাকদের শেষ উইকেট জুটি। সবাইকে চমকে দিয়ে ভারতীয় অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি বল তুলে দিলেন পার্টটাইম পেসার যোগিন্দর শর্মার হাতে, যিনি কিনা ফাইনালের আগে পুরো টুর্নামেন্টে দলে সুযোগ পাননি!
বিজ্ঞাপন
যোগিন্দরের করা ওভারের দ্বিতীয় বলে ছক্কা মেরে ম্যাচটিকে অনেকটাই হাতের নাগালে নিয়ে আসেন উইকেটের এক প্রান্ত আগলে পাকিস্তানের ভরসার প্রতীক হয়ে থাকা মিসবাহ। কিন্তু ক্রিকেট বিধাতা তো সেদিন তাকিয়েছিলেন যোগিন্দর এবং ভারতের দিকে। ছক্কা মারার পরের বলটিতেই স্কুপ খেলতে গিয়ে ভুল করে বসলেন মিসবাহ, ক্যাচ তুলে দিলেন শর্ট ফাইন লেগে দাঁড়িয়ে থাকা ফিল্ডার শ্রীশান্তের হাতে। বিশ ওভারের ক্রিকেটের প্রথম বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল টিম ইন্ডিয়া।
সতেরো বছর আগের সেই ঐতিহাসিক ফাইনালের কথা উঠলে নিশ্চয়ই আপনার চোখে ভেসে উঠে যোগিন্দর শর্মার করা সেই ওভারের কথা বা নায়ক হতে হতে মিসবাহর খলনায়ক হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ভারতের করা ১৫৭ রানের মধ্যম পুঁজিকে পাকিস্তানের জন্য চ্যালেঞ্জিং করে দেওয়ার নেপথ্যে যিনি ছিলেন, তার কথা কি মনে আছে? পার্টটাইম পেসার যোগিন্দর শর্মা নয়, বলছি ভারতের বাঁহাতি পেস অলরাউন্ডার ইরফান পাঠানের কথা।
হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সেই ফাইনালে ইরফান পাঠান যখন বোলিংয়ে আসলেন, তখন ক্রিজে আছেন পাকিস্তানের দুই ইনফর্ম ব্যাটসম্যান— সেই মিসবাহ, সাথে শোয়েব মালিক। ৭০ রানে পাকদের ৪ উইকেট হারালেও গেলেও ১৫৭ রানের লক্ষ্য তখনও দৃষ্টিসীমার মধ্যে। সেই লক্ষ্যে পাকিস্তানের ওভার প্রতি প্রয়োজনীয় রানরেট ৮ এর একটু উপরে!
বিজ্ঞাপন
ইরফান পাঠান যখন তার টানা চার ওভারের স্পেল শেষ করলেন, তখন ওভার প্রতি পাকিস্তানের প্রয়োজন ১৩ এর বেশি রান। ৪ ওভারে ১৬ রানের আঁটসাঁট স্পেলে জুনিয়র পাঠান তুলে নিয়েছেন পাকদের তিন তিনটি উইকেট— ‘ইনফর্ম’ শোয়েব মালিক, ‘বুম বুম’ শহীদ আফ্রিদি আর পেসার ইয়াসির আরাফাত। দুর্দান্ত সেই স্পেলে ইরফান বাউন্ডারি দিয়েছেন মাত্র একটি!
সেই দুর্দান্ত বোলিং পারফরম্যান্সে ম্যাচসেরার স্বীকৃতি পাওয়া ইরফান খুব দ্রুতই যেন হারিয়ে গেলেন দৃশ্যপট থেকে। আইপিএল-রঞ্জি ট্রফিতে নিয়মিত মুখ থাকলেও আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার লম্বা করতে পারেননি, খেলেছেন মাত্র ২৪টি ম্যাচ। ২২.০৭ বোলিং এভারেজে ২৮টি উইকেট, টি-টোয়েন্টিতে নামের পাশে এমন সাদামাটা পরিসংখ্যান নিশ্চয় আজও হতাশায় ডোবায় প্রতিভাবান এই বাঁহাতি পেসারকে। একসময় ভারতীয় কিংবদন্তি কপিল দেবের সাথে তুলনীয় এই পেস অলরাউন্ডার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর ঘোষণা করেন ২০২০ সালে।
২০০৭ থেকে ২০১০— সাউথ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ থেকে এবার চলে আসি ইংল্যান্ডের ব্রিজটাউনে। প্রোটিয়াদের মতোই তখন ইংল্যান্ডের গায়েও সেঁটে আছে 'চোকার্স' তকমা। সেই তকমা ঝেড়ে ফেলতেই কিনা নিজেদের ডেরায় অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দারুণ পারফর্ম করলো ইংলিশরা, উঠে গেল ফাইনালে। সেখানে পিটারসেন-কলিংউডদের প্রতিপক্ষ চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রেলিয়া।
ওভালের মাঠে সেদিন দ্যুতি ছড়াতে পারেননি অজি টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানরা, মাত্র ৪৫ রানেই পড়েছে চার চারটি উইকেট। তবে হাসি ভাতৃদ্বয় এবং ক্যামেরুন হোয়াইটের ইনিংসের সুবাদে ১৪৭ রানের লড়াকু পুঁজি পায় অস্ট্রেলিয়া। লক্ষ্য অত বড় না হলেও ইংলিশ সমর্থকদের মাঝে ছিল চিন্তার ছাপ, কারণ প্রতিপক্ষ দলটির নাম যে অস্ট্রেলিয়া।
সেই চিন্তাকেই আরেকটু বাড়িয়ে দিলেন অজি স্পিডস্টার শন টেইট, ইংলিশদের ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারেই মাত্র ৭ রানের মাথায় ফেরালেন ওপেনার মাইকেল ল্যাম্বকে। ক্রিজে এলেন পুরো টুর্নামেন্টেই দারুণ ছন্দে থাকা কেভিন পিটারসন। আর অপর প্রান্তে? ইরফান পাঠানের মতোই আরেক ধূসর নক্ষত্র— উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান ক্রেগ কাইজওয়েটার।
বলে রাখা ভালো— পিটারসেন এবং কাইজওয়েটার দুজনেরই জন্ম সাউথ আফ্রিকায়, ক্রিকেটে ক্যারিয়ার গড়তে এসেছেন ইংল্যান্ডে। জন্মসূত্রে সাউথ আফ্রিকান এই দুই ব্যাটসম্যান ধরলেন দলের হাল, দারুণ ব্যাটিংয়ে ধীরে ধীরে ম্যাচ থেকে ছিটকে দিলেন অজিদের। একদিকে আগ্ৰাসী পিটাসেন, অন্যদিকে কাইজওয়েটারের বুদ্ধিদীপ্ত স্থিতধী ব্যাটিংয়ে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি নিজেদের হাতে নিয়ে আসলো ইংল্যান্ডে।
হাফ সেঞ্চুরি থেকে তিন রান দূরে থাকতে পিটারসন যখন ‘লেগ স্পিনার’ স্টিভেন স্মিথের শিকার হলেন, তখন এই দুই সাউথ আফ্রিকানের পার্টনারশিপ দাঁড়িয়ে আছে ১১১ রানের নেলসন ফিগারে। প্রথম কোনো বৈশ্বিক শিরোপা জয়ে ইংল্যান্ডের প্রয়োজন আর মোটে ৩০ রান, হাতে আছে ৪১ বল এবং ৭ উইকেট।
এবার কাইজওয়েটারে ফেরা যাক। সাতটি চার এবং জোড়া ছক্কায় কাইজওয়েটার সে ম্যাচে করেছিলেন ৪৯ বলে ৬৩ রান, যা ইংল্যান্ডের ইনিংসে সর্বোচ্চ। দারুণ এই ইনিংস খেলার ফলস্বরূপ এই ওপেনার হয়েছিলেন ম্যান অফ দ্য ফাইনাল। বলে রাখা ভালো, পুরো টুর্নামেন্টেই দাপুটে ফর্মে ছিলেন তিনি, ২২২ রান করে হয়েছিলেন আসরের চতুর্থ সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক।
কিন্তু এরপরে আর নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে পারলেন না কাইজওয়েটার। অধারাবাহিক পারফরম্যান্সের কারণে কোনো ফরম্যাটেই দলে হতে পারেননি নিয়মিত মুখ, ২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটিই ছিল তার শেষ আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। পরের বছরই শেষবারের মতো ইংল্যান্ডের জার্সিতে দেখা যায় তাকে, রাঁচিতে ভারতের বিপক্ষে ওডিআই সিরিজে। ২৫টি টি-টোয়েন্টিতে ২১.৯৬ গড়ে ৫২৬ রান করা কাইজওয়েটার ইনজুরির ধকল কাটাতে না পারে, ২০১৫-তে সব ধরণের ক্রিকেট থেকে অবসর ঘোষণা।
বল পেটানোর অভ্যাস এখনো ছাড়তে পারেননি কাইজেটওয়ার, ক্যারিয়ার গড়েছেন গলফে। আর ক্রিকেট বিশ্লেষক হিসেবে ইরফান পাঠানের দেখা মেলে নিয়মিতই। ক্রিকেট বোধহয় এমনই, ধূসর হয়ে যাওয়া তারকাদের চিন্তাচর্চাতেও হয়ে থাকে নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল।