- রাজধানীর প্রায় অর্ধেক মানুষ দিনে একবার স্ট্রিট ফুড খান
- রাস্তার ৯০ শতাংশ খাবারই অনিরাপদ
- ৮৮ ভাগ বিক্রেতার হাতে থাকে অস্বাস্থ্যকর জীবাণু
- অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে স্ট্রিট ফুড
রাজধানীর মতিঝিল থেকে পল্টন যেতে দৈনিক বাংলা মোড়ের কিছু আগে ফুটপাত ঘেঁষেই বসেছে কয়েকটি খাবারের দোকান। এর মধ্যে ফুটপাতের সাথেই চুলার ওপরে ফুঁটছে তেলের কড়াই। কড়াইয়ের তেল পুড়ে গিয়ে অনেকটা কালো বর্ণ ধারণ করেছে। সেই পোড়া তেলেই একটা একটা করে বেগুনি, আলুর চপ, পেঁয়াজু, সিঙাড়া দিচ্ছেন কারিগর। তা নামানোর সাথে সাথে গরম গরম খাওয়ার জন্য উপচে পড়ছেন ক্রেতারা। কিছুক্ষণ পরপর বড় খুন্তি দিয়ে তেলের নিচে থাকা পুড়ে যাওয়া গুড়োগুলি তুলে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। কতদিন ধরে এই তেল পুড়ছে তা জানে না কেউ।
বিজ্ঞাপন
নিজের চোখের সামনে পোড়া তেলে ভাজা হচ্ছে দেখেও তা খেতে দ্বিধাবোধ নেই ক্রেতাদের। সবাই জানে এসব পোড়া তেলের জিনিস খাওয়া কত ক্ষতিকর। তারপরও জেনেশুনেই এসব বিষাক্ত খাবার খাচ্ছে ভোজন রসিক মানুষ।
এসময় কথা প্রসঙ্গে একজন বলেন, ‘জানি এগুলো খাওয়া ক্ষতিকর। তাও খাইতে মজা লাগে। কম দামে পাওয়া যায়। আর ফুটপাতে ছাড়া এগুলো তেমন কোথাও পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও দাম বেশি।’
পাশেই আরেকজন বলেন, ‘ভেজাল খাইতে খাইতে বাঙালির অভ্যাস হইয়া গেছে। তাই এসব জিনিস খাইলেও আর কিছু হয় না।’ তবে বিক্রেতার দাবি পোড়া তেল ব্যবহার করেন না তিনি। কয়েকটি খালি বোতল দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘এই কড়াইতে একেবারে ১২-১৫ কেজি তেল দেওন লাগে। সব তেল নগদে ঢালা হইছে। আমরা পোড়া তেল দেই না।’
আরও পড়ুন
মূল্যস্ফীতির প্রভাব ফুটপাতেও
মূলধন দেড় হাজার, মাসে আয় ৩০ হাজার
হাজার টাকার পিৎজাও মেলে ফুটপাতে
কতটা স্বাস্থ্যকর স্ট্রিট ফুড?
শুধু এই এলাকাতেই নয়। রাজধানীসহ সারাদেশেই রাস্তার ধারে বসে এই ধরনের ভাজা-পোড়া মুখরোচক খাবারের দোকান। সব জায়গাতেই জনপ্রিয় এসব খাবার। সবাই জানে কোন তেলে এসব খাবার তৈরি করা হচ্ছে। তাও এসব খাবার ধুমসে খাচ্ছে মানুষ। বিকেল হলেই রাজধানীর টিএসসি এলাকায় এই ধরনের অনেকগুলো দোকান বসতে দেখা যায়। এখানে যারা খেতে আসে তারা অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থী। সাধারণ মানুষের থেকে তাদের আলাদা সচেতনতা থাকার কথা। কিন্তু তাদের মধ্যে এসব খাওয়ার প্রবণতা আরও বেশি দেখা গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিঃসন্দেহে এসব পোড়া তেলের খাবার স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তারপরও জেনেশুনেই টাকা দিয়ে বিষ কিনে খাচ্ছে মানুষ।
শুধু এসব ভাজাপোড়া খাবারই নয়, রাজধানীর ফুটপাতে আনাচে-কানাচে খোলামেলা পরিবেশে অনায়াসে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের খাবার। গড়ে উঠেছে রেস্টুরেন্ট, ভাতের হোটেল। তুলনামূলক সস্তা হওয়ায় এসব দোকানেই ভিড় করেন নিম্ন আয়ের মানুষ।
জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের খাদ্যদ্রব্যে রাসায়নিক দূষণ ও জীবাণু সংক্রমণ বিষয়ে এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানী ঢাকার ৯০ শতাংশ স্ট্রিট ফুড বা রাস্তার খাবারই অনিরাপদ। এসব খাবারে ই-কোলাই ও সালমোনেলার মতো মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর জীবাণু পাওয়া গেছে। বিশ্ব নিরাপদ খাদ্য দিবস ২০২৩ উপলক্ষে গেল বছরের জুন মাসে এক অনুষ্ঠানে জানানো হয়, মুখরোচক খাবার বলতেই মাথায় আসে ‘স্ট্রিট ফুড’, যা সাধারণত রাস্তার পাশে তৈরি, বিক্রি ও খাওয়া হয়। নগরের প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ (নারী ৬০ শতাংশ এবং পুরুষ ৪০ শতাংশ) দিনে অন্তত একবার স্ট্রিট ফুড খেয়ে থাকেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ৯০ শতাংশ স্ট্রিট ফুডই অনিরাপদ।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৫৫ শতাংশ রাস্তার খাবারে ক্ষতিকর জীবাণু রয়েছে। আর ৮৮ ভাগ বিক্রেতার হাতে অস্বাস্থ্যকর জীবাণু থাকে। এসব তথ্য অনুযায়ী, ভেজাল খাদ্য খাওয়ার ফলে প্রতি বছর তিন লাখ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় এবং ৫০ হাজার লোক ডায়াবেটিসে এবং আরও ২ লাখ লোক কিডনিজনিত রোগে আক্রান্ত হয়। তাই ধারণা করা যেতে পারে, ভেজাল খাদ্যজনিত উদ্ভূত স্বাস্থ্য প্রতিক্রিয়া মোকাবেলায় যে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়ে থাকে তা জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন সহায়ক কর্মকাণ্ডে ব্যয় হতে পারত।
এছাড়াও বিশ্বখাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৪৫ লাখ লোক খাদ্যে বিষক্রিয়ার ফলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। প্রতিদিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগের অন্যতম কারণও হচ্ছে অনিরাপদ খাদ্য ও পানি।
এ বিষয়ে বারডেম হাসপাতালের পুষ্টি বিভাগের প্রধান পুষ্টিবিদ শামসুন্নাহার নাহিদ মহুয়া ঢাকা মেইলকে বলেন, সাধারণত স্ট্রিট খাবারগুলোতে যে তেলটা ব্যবহার করা হয় সেটা মাসের পর মাস, দিনের পর দিন পোড়া তেলের উপরেই আবার তেল ঢেলে ভাজা হয়। পোড়া তেলের সমস্যাটা হচ্ছে, তেলটা ভেঙে গিয়ে তেলের ভালো যে বিষয়টা থাকে সেটা টক্সিক হয়। এটাকে বলে ট্রান্সফ্যাট। এই ট্রান্সফ্যাটের সমস্যাটা হচ্ছে আমাদের শরীরের রক্তনালীতে চর্বি জমতে সাহায্য করে। এখন যদি কারো হার্টের রক্তনালীতে চর্বি জমা শুরু করে তবে হার্টের সমস্যা হবে। এরকম প্রত্যেকটা অর্গানের জন্য ট্রান্সফ্যাট খুবই খারাপ।
তিনি আরও বলেন, আর তেল ছাড়াও অন্য বিষয়গুলো যেমন বাইরের খাবার চিকেন ফ্রাই, চিকেন চাপ ইত্যাদি বাজার দর হিসেবে যদি চিন্তা করা হয় ভালো একটা শপের তুলনায় এসব স্ট্রিট ফুডের দাম অনেক কম। এত কম দামে কিভাবে দেয় তারা। বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকার খবরে দেখা যায়, এসব খাবারে নষ্ট, মরা, অখাদ্য উপাদান ইউজ করা হয়। ডেড মিট স্বাস্থ্যের জন্য অনেক ক্ষতিকর। একটা জিনিস যখন ডেড হয় তার মধ্যে বিভিন্ন রোগ জীবাণু থাকতে পারে। ডেড মিট ব্লাডকে ক্লট করতে হেল্প করে। এই ব্লাড ক্লটের কারণে একটা মানুষের হার্ট এটাক হতে পারে, কিডনি ফেইলিওর হতে পারে, ব্রেইনেও ইফেক্ট করতে পারে। এই হচ্ছে মূল বিষয়। অধিকাংশ স্ট্রিট ফুডের কমন যে সমস্য, বদহজম হতে পারে, অ্যাসিডিটি খুব কমন সমস্যা। ফুড-বর্ন ডিজিজগুলো হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকতে পারে। যেমন- জন্ডিস, টাইফয়েড, লিভারের ওপর ইফেক্ট পড়তে পারে।
বাংলাদেশে স্ট্রিট ফুডের ভালো দিক খুব কম। তবে স্ট্রিটের কিছু খাবার আছে যেগুলোতে কোনো ট্রান্সফ্যাট নাই। সেগুলো খেলে কোনো সমস্য নাই। যেমন- বাদাম, বুট, বিস্কিট টাইপের জিনিস। এই ধরনের অনেক জিনিস আছে যেগুলো খাওয়া যেতে পারে।
রাজধানী ঢাকার প্রায় ৬০ লাখ মানুষ স্ট্রিট ফুড বা রাস্তার খাবার খান। স্বল্পমূল্য ও মুখরোচক বলে এ ধরনের খাবার দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। একই সঙ্গে অর্থনীতির বিকাশে অবদান রাখছে। যেকোনো দেশের পর্যটনের বিকাশে সে দেশের স্ট্রিট ফুড ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। সাশ্রয়ী হওয়ায় বিশ্বজুড়েই পর্যটকরা রকমারি খাবারের স্বাদ নিতে স্ট্রিট ফুড বেছে নেন। জাপানের টোকিও, মরক্কোর মারাকেশ, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি, চীনের বেইজিং, যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামি, মিসরের কায়রো, ইন্দোনেশিয়ার বালি, থাইল্যান্ডের ব্যাংকক, ভিয়েতনামের হো চি মিন সিটি থেকে শুরু করে ভারতের মুম্বাই ও কলকাতার স্ট্রিট ফুড বা পথখাবার এসব দেশের তো বটেই, বাইরে থেকে সেখানে বেড়াতে যাওয়া পর্যটকদেরও অন্যতম আকর্ষণ। উন্নত দেশগুলোর মতো সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি মেনে পরিকল্পিতভাবে এসব স্ট্রিট ফুডের মার্কেট তৈরি করা গেলে তা অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পরে।
টিএই