প্রাচ্যের ভেনিসখ্যাত বরিশাল বাংলাদেশের মধ্যে অন্যতম সুন্দর শহর। এর সৌন্দর্য্য আরও বাড়িয়েছে নগরী ঘেঁষে বয়ে যাওয়া কীর্তনখোলা নদী। নদীতীরে দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন প্রকৃতিপ্রেমীরা। বিশেষ করে গোধূলির সময় অপরূপ হয়ে ওঠে এ নদীর তীর। বহমান এ নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একাধিক বিনোদন স্পট।
এখানকার পথখাবারের দোকানগুলোতে রকমারি খাবারের সঙ্গে প্রাকৃতিক রূপ বিনোদন প্রেমীদের আনন্দ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। এর বাইরেও নগরীর অভ্যন্তরে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি বিনোদনস্পট। এসব স্থানেও বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত রসনাবিলাসীদের ভিড় থাকে চোখে পড়ার মতো।
বিজ্ঞাপন
মুখরোচক খাবারের পসরা সাজিয়ে বসা ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁকডাকে মুখরিত থাকে পথখাবারের এসব দোকান। তাই শীতের এই বিকেলের অবসরে এসব দোকানে গরম খাবারের স্বাদ নিতে শিক্ষার্থী ও তরুণদের ভিড় বেশি দেখা যায়। তবে সব বয়সীদের কমবেশি দেখা মেলে এখানে।
পথখাবারের এসব দোকানে শুক্রবার বাদে প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত দেড় হাজার টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। আর শুক্রবারসহ অন্যান্য ছুটির দিনে বিক্রি বেড়ে দাঁড়ায় কয়েকগুণ। বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে থাকা এসব বিনোদন স্পটগুলোতে সপ্তাহে শুক্রবার বেশি লোকসমাগম হয়।
৩০ গোডাউন (রিভার ভিউ পার্ক ও বধ্যভূমি)
বরিশাল নগরীর প্রাণকেন্দ্র সদর রোড থেকে মাত্র ৬০ টাকা রিকশাভাড়া দূরত্বে ৩০ গোডাউন বিনোদন স্পট। নগরবাসীর পছন্দের তালিকায় শীর্ষে থাকা এ বিনোদনস্পটে প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে সাধারণত রাত ৯টা পর্যন্ত অনেক ভিড় থাকে। এখানে পথখাবারের প্রায় অর্ধশত দোকান রয়েছে। এসব দোকান শুক্রবার বাদে প্রতিদিন দেড় থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করে থাকেন। তবে শুক্রবার এ বিক্রি বেড়ে কয়েকগুণ হয়ে যায় বলে জানান বিক্রেতারা।
বিজ্ঞাপন
এ বিনোদন কেন্দ্রে বিভিন্ন ধরণের শরবত, ফুচকা, ভেলপুরি, বার্গার, স্যান্ডউইচ, ফ্রান্সফ্রাই, পাস্তা, নুডুলস, পিজ্জা, চটপটি, বিভিন্ন ধরণের চা, শীতকালীন পিঠা, বিভিন্ন ধরণের ঝালমুড়িসহ বশিরের বিখ্যাত সিঙ্গাড়া পাওয়া যায়। এ পার্কে নেই কোনো প্রবেশমূল্য।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বৃষ্টি আক্তার জানান, কমদামে ভালো খাবার মেলে এখানে। তাই সুন্দর পরিবেশে ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি মুখরোচক খাবার খাওয়া যায় এখানে। এছাড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থাও বেশ ভালো। তবে ফিরে যাওয়ার সময় রিকশা পেতে বেশ বেগ পেতে হয়।
সিঙ্গাড়া বিক্রেতা বশির জানান, প্রতিদিন আমার দোকানে অসংখ্য ক্রেতা এসে সিঙ্গাড়া খায়। দিন দিন দোকানের সুনাম ছড়িয়ে পড়ার কারণে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আমার এখানে সিঙ্গাড়া খেতে আসেন। নদী তীরে চেয়ারে বসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের জন্য এ স্থানের বিকল্প নেই বলে জানান তিনি।
চা দোকানদার লোকমান জানান, বিভিন্ন আইটেমের চা দিয়ে ক্রেতাদের মন জয় করেছি। তাই আমার দোকানে সারাক্ষণ ভিড় লেগেই থাকে। শুক্রবার কয়েকগুণ বিক্রি বেড়ে যায়। তখন এ এলাকায় লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়।
শরবতের দোকানদার মেহেদী হাসান জানান, পেঁপে, কলা, আপেল, তরমুজ, আঙ্গুরসহ বিভিন্ন ফল দিয়ে শরবত তৈরি করি। আমাদের এ শরবতের চাহিদাও প্রচুর। দিন দিন শরবতের দোকান বৃদ্ধির পাশাপাশি ক্রেতার সংখ্যাও বাড়ছে।
মুক্তিযোদ্ধা পার্ক
দেশের বীর সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের নামের এ পার্কে কম সময়ে ঘুরে বেড়ানোর ক্ষেত্রে সর্বাধিক জনপ্রিয়। কারণ সদর রোড থেকে পায়ে হেঁটে মাত্র ১৫ মিনিটে পৌঁছানো যায়। সদর রোড থেকে রিকশায় ভাড়া ২০-৩০ টাকা মাত্র। এ বিনোদন কেন্দ্রে বিভিন্ন ধরণের শরবত, ফুচকা, ভেলপুরি, চটপটি, বিভিন্ন ধরণের চা, শীতকালীন পিঠা, বিভিন্ন ধরণের ঝালমুড়ি পাওয়া যায়। ২০টির মত পথখাবারের দোকানে এসব খাবার মিলবে। এ পার্কেও কোনো প্রবেশমূল্য নেই। কীর্তনখোলা নদী তীরে গড়ে ওঠা পার্কের পাশেই বরিশাল নৌবন্দর। এ পার্ক থেকে পড়ন্ত বিকেলে নৌকায় চড়ে কীর্তনখোলা নদীতে ভ্রমণ করেন অনেকে। মন চাইলে তীরে বসে নদীর পানিতে পা ভিজিয়েও নেওয়া যায়। এছাড়া পার্কের পাশেই নোঙর করা বিশাল দানবাকৃতির উদ্ধারকারী জাহাজ নির্ভীক সৌন্দর্য্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই বিকেল থেকে রাত অবধি চোখে পড়বে বাদাম, মুড়িমাখা, চটপটি-ফুচকার দোকান আর অসংখ্য মানুষের আনাগোনা।
কলেজছাত্র আলামিন বলেন, সারাদিন ব্যস্ততা শেষে বিকেলে এ পার্কে ঘুরতে আসি। এ পার্কের পাশে হেঁটে বেড়াতে খুব ভালোলাগে। নদীর পাশের রাস্তায় হেঁটে বেড়ানোর আনন্দই আলাদা। পাশাপাশি এখানকার হরেক রকমের খাবার বাড়তি তৃপ্তি যোগায় বলেও জানান তিনি।
পথখাবার বিক্রেতা জীবন খলিফা জানান, প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন ধরণের খাবার মিলবে এ পার্কে। বর্তমানে শীত বেশি হওয়ায় দর্শনার্থী কিছুটা কমেছে। তবে শুক্রবারসহ অন্যান্য বন্ধের দিনে উপচে পড়া ভিড় থাকে।
আরেক বিক্রেতা আনিচ জানান, বিকেল থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত দোকান খোলা রেখে কয়েক হাজার টাকার ফুচকা ও চটপটি বিক্রি হয়।
বঙ্গবন্ধু উদ্যান
ইতিহাস-ঐতিহ্যের বঙ্গবন্ধু উদ্যানে (সাবেক বেলস্ পার্ক) মিশে আছে ব্রিটিশ উদ্যোগের পাশাপাশি আমাদের জাতীয় জীবনের নানান ঘটনা প্রবাহ। নগরীর সব চেয়ে বড় এ উদ্যানের ওয়াকওয়েতে হেঁটে ভ্রমণ করেন কয়েক হাজার মানুষ। সন্ধ্যায় আলোর ঝলকানিতে উদ্যানের পাশে বসে পথখাবারের হরেক দোকান। এ উদ্যানের পাশে গড়ে উঠেছে ৮০টির মতো পথখাবারের দোকান। দোকানগুলোতে সন্ধ্যার পর ভিড় বাড়তে শুরু করে। এ স্পটটি তরুণ-তরুণীদের পছন্দের জায়গা।
এ বিনোদন কেন্দ্রেও বিভিন্ন ধরণের শরবত, ফুচকা, ভেলপুরি, বার্গার, স্যান্ডউইচ, ফ্রান্সফ্রাই, পাস্তা, নুডুলস, পিজ্জা, চটপটি, বিভিন্ন ধরণের চা, শীতকালীন পিঠা, বিভিন্ন ধরণের ঝালমুড়ি, বাদামসহ অসংখ্য ধরণের খাবার পাওয়া যায়।
তরুণী লিপি হোসাইন জানান, বঙ্গবন্ধু উদ্যানে খাবার খেতে ও ঘুরতে আসি। এখানে পছন্দের অধিকাংশ খাবার পাওয়া যায়। তাই সপ্তাহে কয়েকদিন এখানে ঘুরতে আসি।
চা বিক্রেতা আরমান জানান, এখানের গ্রাহকরা ভিন্ন ধরণের। তারা খাবারের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিকে বেশি নজর দেন। তাই আমরা ব্যবসায়ীরাও সেদিক বিবেচনায় খাবার প্রস্তুত করি। এখানে বিকেল থেকে ভিড় বাড়লেও তা সন্ধ্যার পর আরও কয়েকগুণ হয়ে যায়।
ফাস্টফুড ব্যবসায়ী জিতু জানান, আমরা রাস্তার পাশে দোকান নিয়ে বিভিন্ন ধরণের ফাস্টফুড ক্রেতার সামনেই তৈরি করে পরিবেশন করি। এতে করে ক্রেতাও খুশি হয় আমাদের বিক্রিও বেশি হয়।
বিবির পুকুর পাড়
বরিশাল নগরীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত শতবর্ষের পুরানো ও ঐতিহ্যবাহী কৃত্রিম জলাশয় বিবির পুকুর। এই পুকুরকে কেন্দ্র করে তিন পাশে গড়ে উঠেছে পথখাবারের দোকান। এসব দোকানে বার্গার, গ্রিল, ফ্রেন্স ফ্রাই, বিভিন্ন ধরণের চপ, চটপটি, ফুচকা, বিভিন্ন ধরণের চা, শীতকালীন পিঠা, ডিম কেক, সিঙ্গাড়া, পুড়ি, রোলসহ হরেক খাবার মেলে।
অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক জানান, বিকেলে ঘুরতে এখানে আসি। শহরের মধ্যেই নির্মল বাতাসের দেখা মেলে এখানে। সঙ্গে পছন্দের খাবারও পাওয়া যায়। এর চেয়ে আর কি চাই বলেন।
চটপটি বিক্রেতা শ্যামল চন্দ্র বলেন, নগরীর প্রাণ কেন্দ্রে অবস্থিত এ বিনোদন স্পটে প্রচুর লোকসমাগম হয়। কারণ চলতি পথেই মানুষজন পছন্দের খাবার কম দামে খেতে পারছে। এতে করে টাকা ও সময় কম ব্যয় হচ্ছে।
চা দোকানদার সাইদ জানান, হরেক রকমের চা বিক্রি করি। পুকুর পাড়ে বরিশালের বিখ্যাত চা পাওয়া যায় তা সবাই জানে। তাই সন্ধ্যার পর থেকে রাত পর্যন্ত ব্যাপক লোকসমাগম থাকে।
লেকের পাড়, বটতলা, চৌমাথা
নগরীর সদর রোড থেকে মাত্র ৩০ টাকা রিকশা ভাড়ার দূরত্বে অবস্থিত লেকের পাড়টি। এখানে এ পুকুরের চারপাশেও ঝুলন্ত পার্ক ও বেঞ্চ রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের লাইটিংয়ের মধ্যে গড়ে উঠেছে শ’ খানেক পথখাবারের দোকান। এসব দোকানে বিভিন্ন ধরণের চা, চটপটি, ফুচকা, বার্গার, গ্রিল, ফ্রেন্স ফ্রাই, শীতকালীন পিঠা, কেক, সিঙ্গাড়া, পুড়ি, রোলসহ হরেক ধরণের খাবার পাওয়া যাবে। তাই এ পার্কেও সব বয়সীদের থাকে উপচেপড়া ভিড়। দিন শেষে ক্লান্তি দূর করতে লেক পাড়ের জুড়ি নেই।
ক্রেতা হৃদয় জানান, কম সময়ে এখানে এসে মন চাঙ্গা হয়ে যায়। তাই প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যার পর এখানে ঘুরতে আসি। নিরাপত্তা ব্যবস্থাও বেশ ভালো এখানে।
ব্যবসায়ী দেলোয়ার জানান, বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত এখানে লোকসমাগম থাকে। আগতদের চাহিদা অনুযায়ী সব খাবার মেলে এখানে। তাই লোকসমাগমও বেশি। তাছাড়া খুব কম খরচে আসা যায় এখানে, খাবারের দামও কম।
ব্যবসায়ী সালাম মিয়া জানান, এখানে ভাজা-পোড়া খাবারের চাহিদা বেশি। তাই বুট, মুড়ি, আলুর চপ, বেগুনি, পুরি, কাবাবসহ এসব খাবারের চাহিদা বেশি।