চট্টগ্রাম শহরের অন্যতম বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদ। এখানে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও আঞ্চলিক কার্যালয় রয়েছে। যেখানে কর্মব্যস্ত সময় কাটান লাখো চাকরিজীবী। কাজের এই সময়ে যখন পেটে ক্ষুধার টান, তখন শত শত কর্মজীবী ছুটে যান রাস্তার পাশের স্ট্রিট ফুডের দোকানে। যেখানে ৫০-৬০ টাকায় পাওয়া যায় চিকেন ফ্রাই, চিকেন স্টিক, চাপ, গ্রিল, বার্গার ও বিরিয়ানিসহ বিভিন্ন রকমের রিচ ফুড।
বুধবার (৩১ জানুয়ারি) দুপুরে দেখা যায়, আগ্রাবাদের বাদামতলি মোড়ে বাঙালিয়ানায় মজাদার স্ট্রিট ফুড খেতে ভিড় করেছেন অনেকে। তাদের দু’চারজন দোকানে রাখা কয়েকটি টেবিলে বসে খাওয়ার সুযোগ পেলেও অন্যরা খাচ্ছেন দাঁড়িয়ে। আবার কেউ কেউ খাবার নিয়ে দোকান থেকে একটু দূরে ফুটপাতের কিনারে দাঁড়িয়েও খাচ্ছেন এই খাবার।
বিজ্ঞাপন
খাবার খেতে আসা ওয়ান ব্যাংকের আগ্রাবাদ আঞ্চলিক কার্যালয়ের কর্মী জিন্নাত জাহান বলেন, আগ্রাবাদে চার তারকা-পাঁচ তারকা মানের অনেক বড় বড় হোটেল আছে। যেখানে মজাদার খাবার মিলে। অবশ্যই তার জন্য গুণতে হয় সেরকম মোটা অঙ্কের টাকাও। যেগুলো মধ্যবিত্ত শ্রেণির কপালে জুটে না। অবশ্যই একই মানের না হলেও একই পদের স্বল্প খাবার স্বল্প মূল্যে জুটে রাস্তার ভ্যান, টং অথবা ছোট ছোট দোকানে। তাই ক্ষুধা লাগলে ছুটে আসি এসব দোকানে। আমার মতো মধ্যবিত্ত শ্রেণির শত শত কাস্টমার সর্বক্ষণ এসব দোকানে ভিড় জমায়। আগ্রাবাদ এলাকায় এমন তিন শতাধিক দোকান রয়েছে বলে জানান তিনি।
একইভাবে আগ্রাবাদে অবিস্থত প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুল খালেক বলেন, এক সময় চিকেন ফ্রাই, চিকেন স্টিক, চাপ, গ্রিল, বার্গারসহ বিভিন্ন ধরনের রিচ ফুড নামিদামি রেস্তোরাঁর বাইরে চিন্তাই করা যেত না। এক দশকের ব্যবধানে এখন এসব খাবার স্ট্রিট ফুডে পরিণত হয়েছে। এসব স্ট্রিট ফুডকে কেন্দ্র করে বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রামের ফুটপাতের পাশে গড়ে উঠেছে কাস্টমাইজড ফুডকোর্ট। রোজ বিকালের পর থেকে সেখানে বসে বাহারি পদের খাবারের মেলা।
গত কয়েক বছরে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় স্ট্রিট ফুডের অঘোষিত জংশন তৈরি হয়েছে। নগরীর ষোলশহর ২ নম্বর গেট এলাকায় ফিনলে শপিং মল স্কয়ার এবং রেল জংশনকে কেন্দ্র করে অর্ধশতাধিক কাস্টমাইজ ফুডকোর্ট গড়ে উঠেছে। পাশেই বিপ্লব উদ্যোনেও গড়ে উঠেছে ছোট ছোট রেস্তোরাঁ। এখানে বিরিয়ানি, বার্গার, কাবাব, পাস্তা, চিকেন-বিফ আইটেম থেকে শুরু করে জুস, স্যুপ, মিক্স ফ্রুটস, কফিও পাওয়া যায়। বিকাল থেকে রাত অবধি মানুষের আড্ডায় জমজমাট থাকে স্থানটি।
চট্টগ্রামের সিআরবি এলাকায়ও সন্ধ্যার পর বসে ফুডকোর্ট। সেখানে ফুচকা-চটপটি, ভাজাপোড়ার পাশাপাশি ঝটপট তৈরি নুডলসও পাওয়া যায়। চীন থেকে নুডলসের খাদ্যাভাস ভারত হয়ে বাংলাদেশে আসে। এই নুডলস ভারতে চাউমিন নামে খুব জনপ্রিয়। দেশটির করপোরেট অফিসগুলোতে খুবই কম সময়ের ব্রেক দেওয়া হয়। তখন চাকরিজীবীরা দ্রুত ও ঝামেলাবিহীন খাবার হিসেবে চাউমিন খেয়ে থাকে।
বিজ্ঞাপন
নগরীর জিইসি এলাকার সানমার ওসান সিটিকে কেন্দ্র করেও রয়েছে অর্ধ শতাধিক স্ট্রিট ফুডের দোকান। এখানের ছোলা-মুড়ির সঙ্গে ভাজাপোড়া পেঁয়াজুর মিক্সার জনপ্রিয় আইটেম। এছাড়া এখানে আলুপুরি, আলুর দম, ভেলপুড়ি, হালিম ও বিরিয়ানিও পাওয়া যায়।
নগরীর অভিজাত এলাকা কাজীর দেউড়ির স্টেডিয়াম পাড়ায়ও স্ট্রিট ফুডের আসর বসে। এখানে ৫০-৮০ টাকায় চিকেন চাপ, ঝাল ফ্রাই, চিকেন ফ্রাই পাওয়া যায়। এছাড়া দুপুরে বিরিয়ানি বিক্রি হয় ভ্যানে। বনরুটির ভেতর ভাজা ডিম পুরে মরিচের চাটনি দিয়ে পরিবেশন করা হয় ডিম বন। এমন নতুন নতুন স্ট্রিট ফুডের আইটেম সম্বলিত ফুডকোর্টগুলো সন্ধ্যার পর জমে উঠে। এছাড়া নগরীর হালিশহর, অলংকার, নিউ মার্কেট, আন্দরকিল্লা শিল্পকলা, পতেঙ্গা, ইপিজেড, চকবাজার, বহাদ্দারহাট, শাহ আমানত নতুন ব্রিজ, জামালখানসহ পাড়া-মহল্লায় স্ট্রিট ফুডের বিকাশ ঘটেছে।
প্রতিদিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত ভ্যানে অস্থায়ী বিরিয়ানির দোকান বসে শহরের বিভিন্ন সড়কের পাশে। রাতে যানবাহনের চালকেরাই এর মূল ভোক্তা। বিকেলের দিকে নগরীর বিভিন্ন পার্কে ঘুরতে আসা তরুণ-তরুণীরাও ছুটে যান রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে মজাদার এই স্ট্রিট ফুড খেতে। ছোট প্লেটে ২০ টাকা থেকে শুরু করে প্রতি প্লেট ৭০ টাকায় বিক্রি হয়।
আকৃষ্ট হচ্ছেন বিদেশিরাও
শুধু দেশের তরুণ-তরুণী বা চাকরিজীবীরা নয় স্ট্রিট ফুডের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন চট্টগ্রামে বেড়াতে আসা বিদেশি নাগরিকরাও। এর মধ্যে বুধবার বিকেলে চট্টগ্রামের রেডিসন ব্লু-বে হোটেলের সামনে রাস্তার পাশে গড়ে উঠা ঝালমুড়ি নামক একটি দোকানে কাচ্চি বিরিয়ানি খাচ্ছিলেন মার্কস ট্রেন্ডার নামে এক বিদেশি। আর তাকে ঘিরে একরকম ভিড় জমে যায়। এর কারণ তার খাওয়া নয়, তার কথা।
দোকানে ঢুকেই ট্রেন্ডার অর্ডার করেন কাচ্চি বিরিয়ানি। কিন্তু তার উচ্চারণ জটিলতায় কাচ্চি বিরিয়ানি হয়ে গেল ক্যাচি বিরিয়ানি। খাবারটা যে তার কাছে আক্ষরিক অর্থেই সুস্বাদু হয়েছে, সেটা তার কথাতেই বোঝা যায়। এসময় দোকানে থাকা অনেকে তার ভিডিও করেন।
একইভাবে নগরীর জামালখান এলাকায় সাদা পাঞ্জাবি পরা একজন বিদেশি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ঝালমুড়ি খাচ্ছিলেন। অতি আগ্রহী একজন এসময় মজা করার জন্যই ওই বিদেশির হাতে একটা কাঁচা মরিচ তুলে দেন। কিন্তু নানা দেশ ঘোরা ওই বিদেশিও পিছু হটার পাত্র নন, ঝালমুড়ির সঙ্গে কচকচ করে কাঁচা মরিচ খেতে গিয়ে চোখ ছলছল করে উঠে তার। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, বাংগালাডেশ (বাংলাদেশ) ইজ অ্যামেজিং!
বিক্রেতারা যা বলছেন
জামাল খান ভিআইপি টাওয়ারের নিচে ছোট্ট একটি দোকানে স্ট্রিট ফুড বিক্রি করেন মোজাহের। তার বাড়ি কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দিতে। স্ট্রিট ফুড বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত ৫-৬ বছর ধরে আমি এই দোকানে এই খাবার বিক্রি করছি।
খাবারের মধ্যে রয়েছে- ডিম চপ, আলুর চপ, পেঁয়াজু, সিঙাড়া, অন্থন, ছোলা ভাজা, চিকেন স্টিক, চিকেন ফ্রাই, চিকেন চাপ, গ্রিল চিকেন, বার্গার, বিরিয়ানিসহ বিভিন্ন ধরনের রিচ ফুড। বিক্রিও হয় বেশ ভালো। এসব খাবার খেতে প্রতিদিন কাস্টমারের ভিড় জমে। আর এই ব্যবসা করে আমি স্বাবলম্বী ইনশাল্লাহ।
তিনি বলেন, ৬-৭ বছর আগে আমি বেকার ছিলাম। কাজের সন্ধানে চট্টগ্রামে ছুটে আসি। পুঁজিও ছিল না তেমন। তখন ভ্যান গাড়িতে খাবার বানিয়ে বিক্রি করা শুরু করি। সেখান থেকে আমার এই দোকান। দোকানের ভাড়া এখন দিন হিসেবে ১ হাজার ৫০০ টাকা দিতে হয়। দিনে আমার এক লাখ টাকার কাছাকাছি বিক্রি হয়।
একইভাবে স্ট্রিট ফুড বিক্রি থেকে স্বাবলম্বী হওয়ার গল্প শোনান নগরীর ষোলশহর রেল জংশনে অস্থায়ী ঝুপড়ি দোকানে স্ট্রিট ফুড বিক্রেতা শাহ আলম, সিআরবি এলাকায় স্ট্রিট ফুড বিক্রেতা আমির হোসেন, আগ্রাবাদ বাদামতল মোড়ে ভ্যান গাড়িতে স্ট্রিট ফুড বিক্রেতা আনোয়ার হোসেন। তারা সবাই মোজাহেরের মতো এই ব্যবসায় সফল বলে জানান।
চট্টগ্রামে যেভাবে এলো স্ট্রিট ফুডের ধারা
স্ট্রিট ফুড বিক্রেতাদের অধিকাংশের মতে, প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত থেকেই মূলত এসেছে স্ট্রিট ফুডের এই ধারা। দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে বড় বড় স্ট্রিট ফুড মার্কেট গড়ে উঠেছে। কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলকে কেন্দ্র করে আড়াই শতাধিক ফুডকোর্ট নিয়ে বিশাল স্ট্রিট ফুডের মার্কেট গড়ে উঠেছে। এছাড়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি, শিলিগুড়ি শপিং মলসহ বেশ কয়েকটি বড় বড় স্ট্রিট ফুড মার্কেট গড়ে উঠেছে। আর মুম্বাইয়ের পথে-ঘাটে, অলি-গলিতে নানারকম ভাজাপোড়ার দোকান তো রয়েছেই।
খাবার বিক্রির এই সংস্কৃতি ঢাকা হয়ে চট্টগ্রামেও এসেছে। ইন্টারনেট-প্রযুক্তির সহজলভ্যতা এবং ভারতীয় সিনেমা দেখতে দেখতে দেশে খুব দ্রুত বিকাশ ঘটে স্ট্রিট ফুড সংস্কৃতির। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ফুড ব্লগিংয়ের প্রভাবও রয়েছে এখানে।
আবার চট্টগ্রামে স্ট্রিট ফুডের বিকাশে ভূমিকা রয়েছে নগরীর ঝাউতলা এলাকার বিহারি সম্প্রদায়েরও। সেখানে অল্প টাকায় বিভিন্ন ধরনের স্ট্রিট ফুড পাওয়া যায়। ৪০-৯০ টাকায় চিকেন চাপ, গ্রিল চিকেন, ঝাল ফ্রাই, বিফ স্টিক, গরুর বট বিক্রি হয়। ৭০-১০০ টাকায় গরুর নলার হালিম, বিফ হালিম পাওয়া যায়। এক দশক আগ থেকে তাদের অনেকে স্ট্রিট ফুড বিক্রির ব্যবসা শুরু করে। অল্প টাকায় এসব মুখরোচক খাবারের ধারণা এখান থেকেই এসেছে বলে মনে করছেন এই ব্যবসায় যুক্ত অনেকে।
স্ট্রিট ফুডের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ওপেন কিচেন
গ্রাহকদের আকর্ষণ করতে ঝটপট খাবার তৈরির পর গরম গরম পরিবেশন করা হয়। এই বৈশিষ্ট্যের কারণে গ্রাহকদের দ্রুত টানতে পারে ফুডকোর্টগুলো। এই ধারণা এখন বড় বড় হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোও অনুসরণ করছে। হোটেল রেস্তোরাঁগুলোর রান্নাঘর এক সময় লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখা হতো। গত এক দশকে তা পরিবর্তন হয়ে স্ট্রিট ফুডের বৈশিষ্ট্যকে গ্রহণ করেছে।
গ্রিল চিকেন-কাবাবের স্ট্যান্ড, রুটি-পরটার স্ট্যান্ড, বিরিয়ানির বড় পাতিল এখন রেস্তারাঁগুলোর বাইরেই পরিবেশন করা হয়। থাইল্যান্ড, ইস্তাম্বুল, ভারতেও এই ওপেন কিচেন দেখা যায়। তবে আমাদের দেশের ওপেন কিচেনের পরিবেশ পরিচ্ছন্নতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। রয়েছে নিম্নমানের খাবার বিক্রির অভিযোগও।
নগরীর ষোলশহর রেল জংশনে নিয়মিত স্ট্রিট ফুড খান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞানের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নওশের আমান। তিনি বলেন, স্ট্রিট ফুডের ব্যবসা লাভজনক দেখে এবং এর সুনামের সুযোগ নিয়ে অনেক ব্যবসায়ী নানারকম কারসাজির আশ্রয় নিচ্ছে। চিকেনের নামে অনেকে উচ্ছিষ্ট দিয়ে স্টিক, চপসহ নানারকম খাবার তৈরি করে বিক্রি করছে। যা খেয়ে অনেকেই অনেক সময় অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এসব দোকানের দিকে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের তেমন কোনো নজর নেই।
এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক ফয়েজ উল্লাহ বলেন, বিষয়টির ওপর নজর নেই এটা ঠিক নয়। তবে স্ট্রিট ফুডের ওপর নজরদারি আরও বাড়ানো হবে।