রাজধানীসহ সারাদেশে দিন দিন বাড়ছে স্ট্রিট ফুডের চাহিদা। পুরি, সিঙাড়া, ফুচকার মতো প্রথাগত স্ট্রিট ফুডের পাশাপাশি গড়ে উঠেছে বার্গার, পিৎজা, ফ্রাইয়ের মতো নানাবিধ ফাস্ট ফুডের দোকান। এমনকি ফ্রাইড রাইসের মতো মেইন ডিস হিসেবে পরিচিত খাবারগুলোও পাওয়া যাচ্ছে সড়কের পাশে ভাসমান খাবার দোকানগুলোতে।
রাজধানীর অলিগলিতে বিচ্ছিন্ন দোকানের পাশাপাশি খিলগাঁও, ধানমন্ডি, বেইলি রোড ও পরিবাগের মতো ব্যস্ত ও অভিজাত এলাকাতে গড়ে উঠেছে গুচ্ছ স্ট্রিট ফুডের দোকান। যেসব দোকানে বার্গার, পিৎজা, চিকেন ও ফিস ফ্রাইসহ বাহারি খাবারের পসরা দেখা যায়। সড়কের ওপরেই গ্রাহকের সামনে পছন্দ করা উপাদান দিয়ে তৈরি হচ্ছে এসব খাবার৷ রাস্তার ওপরেই বসার স্থান তৈরি করে গ্রাহকদের এসব খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
ভোজনরসিকদের কাছে এসব খাবার মুখরোচক হলেও এর পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্যকর দিক নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। বিশেষত সড়কের পাশে উন্মুক্ত স্থানে তৈরি এসব খাবার আমাদের শরীরের জন্য কতটা উপকারী তা বলা কঠিন। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, মুখরোচক খাবার বেশিরভাগই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এসব খাবার প্রস্তুতের পদ্ধতিই এর ক্ষতিকর দিকের কারণ।
স্ট্রিট ফুডের দোকান ও পরিবেশ
রাজধানীর ব্যস্ততম মোড়ের একটি পান্থপথ সিগনাল। কারওয়ান বাজার মোড় থেকে পান্থপথে যাওয়ার পথে বসুন্ধরা শপিংমল ও পানিভবনের বিপরীতে চোখে পড়ে সড়ক ঘেষে অসংখ্য খাবারের দোকান। পুরি, সিঙাড়া থেকে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, চিকেন ফ্রাই, জিলাপিসহ প্রায় সব ধরনের খাবারই তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে এখানে। প্রায় প্রতিটি দোকানের সামনেই গ্রাহকদের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে।
তেমনই একটি দোকানে সড়কের পাশে খোলা স্থানে পড়ে আছে গোলানো বেসনের বাটি। তার পাশেই দুই হাতে ময়দা মাখছেন পঞ্চাশোর্ধ আব্দুল জলিল (ছদ্মনাম)। খোলা স্থানে বেসনের পাত্র ও ময়দা মাখা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এই বিক্রেতা ঢাকা মেইলকে বলেন, আমার দুই হাতই ধোয়া। পুরো সময় তো রান্নাই করছি। আর আমার ছেলে এখনই আলুর চপ ভাজবে, তাই ওইটা ঢাকিনি।
বিজ্ঞাপন
অপরদিকে পরিবাগে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, খোলা আকাশের নিচে বার্গার, পিৎজা, ফ্রাইড রাইস, দোসা, চিকেন, সামুদ্রিক মাছ ফ্রাই, হালিমসহ নানা ধরনের খাবার বিক্রি হচ্ছে। সড়কটিতে যান চলাচল বন্ধ থাকায় অনেকটা স্বাচ্ছন্দ্যেই চলছে বেচাকেনা। সড়কের পাশেই ভোক্তারা তাদের পছন্দের খাবার গ্রহণ করছেন।
আরও পড়ুন
মূল্যস্ফীতির প্রভাব ফুটপাতেও
মূলধন দেড় হাজার, মাসে আয় ৩০ হাজার
হাজার টাকার পিৎজাও মেলে ফুটপাতে
জেনেশুনেই ‘বিষ’ খাচ্ছে সবাই!
উপাদান নয়, উৎপাদন ও পরিবেশন স্বাস্থ্যকর কিনা তা মূল প্রশ্ন
বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে দেশে স্ট্রিট ফুডের জনপ্রিয়তা বাড়ায় এর স্বাস্থ্যগত দিকটি নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে। এসব বিষয়ে ঢাকা মেইলের সাথে কথা বলেছেন জাতীয় পুষ্টি ইনস্টিটিউটের একজন চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদ। তবে সরকারি চাকরিবিধি, প্রাতিষ্ঠানিক বিধিনিষেধ ও অনুমতির কথা জানিয়ে নাম প্রকাশে আপত্তি জানিয়েছেন।
এই পুষ্টিবিদ ঢাকা মেইলকে বলেন, সাধারণত স্ট্রিট ফুড হিসেবে আমরা যেসব খাবার গ্রহণ করি, স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনায় সরাসরি খারাপ বা ভালো বলা যাবে না। আমরা যদি ফুচকার কথা ধরি, ফুচকার ভেতরে যে উপাদান থাকে তা খুবই হেলদি। সেখানে ডিম, বুটসহ অনেক কিছু থাকে। কিন্তু উপাদানগুলো নিরাপদ কিনা তা বড় প্রশ্ন। অর্থাৎ উপাদানটি স্বাস্থ্যকর কিন্তু সামগ্রিকভাবে খাবারটা স্বাস্থ্যকর না। এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে। সেটা অনেক সময় জীবাণুযুক্ত হাতে তৈরি করা হয়। যে পানিটা ব্যবহার করা হয়, তাতে নানা রকম জীবাণু থাকে। যে টক ব্যবহার করা হয় তার উপাদানের কথা চিন্তা করলে সেখানে তেঁতুলসহ অনেক উপাদান থাকে যা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। কিন্তু আমরা যেটা খাই তার বানানোর প্রক্রিয়া ও পরিবেশন স্বাস্থ্যকর নয়।
ফাস্টফুড প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্ট্রিট ফুড হিসেব আমরা বার্গার, পিৎজাসহ বিভিন্ন ধরনের ফাস্টফুড খেয়ে থাকি। এর মধ্যে ভেজিটেবল খাবারগুলো ঠিক আছে। কিন্তু যেখানে অনেক অনেক বেশি মেয়নিজ, সসেজ ব্যবহার করা হয় তা আমাদের জন্য স্বাস্থ্যকর না। বেইলি রোডে লুচিসহ অনেক খাবার বিক্রয় করা হয়। লুচিটা হেলদি খাবার, সাথে যে সবজি বা সালাদ দেয় তাও স্বাস্থ্যকর। সাথে মাংসও থাকে, যা স্বাভাবিকভাবে স্বাস্থ্যকর। তবে সেটা যে তেলে ডুবিয়ে করা হয় সেটা কতটা স্বাস্থ্যকর তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অর্থাৎ আমাদের প্রসেসিং করার মাধ্যমগুলো ভালো না।
ফ্রুট আইটেম বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে এই পুষ্টিবিদ বলেন, বিশ্বের অনেক দেশে স্ট্রিট ফুড পাওয়া যায়। অনেক ফ্রুট আইটেমও থাকে। এগুলো স্বাস্থ্যকর। আমাদের দেশে এখন ফলের আইটেমও পাওয়া যায়। যেমন আনারস, পেপে বিক্রি হয়। এগুলো খাবার হিসেবে ভালো কিন্তু প্রসেসিংয়ের প্রক্রিয়াটা ঠিকভাবে করলে তা আমাদের জন্য উপকারী। সার্বিকভাবে আমাদের প্রসেসিং পদ্ধতি বিবেচনায় স্ট্রিট ফুড আমাদের জন্য উপকারী নয় বরং ক্ষতিকর।
কি ধরনের ক্ষতি হতে পারে?
জানতে চাইলে জাতীয় পুষ্টি ইন্সটিটিউটের এই পুষ্টিবিদ বলেন, অনিরাপদ স্ট্রিট ফুড গ্রহণের মাধ্যমে আমাদের ডায়রিয়ার মতো সংক্রামক ও পানিবাহিত রোগ হতে পারে। এমনকি হেপাটাইটিস সি-ও হতে পারে। আমরা বার্গার, লুচির মতো তেলে ভাজা খাবার খাই, তা কোলেস্টেরল বাড়িয়ে দিতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে এসব খাবার গ্রহণে আমরা নানা ধরনের অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হতে পারি। এর মধ্যে হার্টের রোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও ক্যানসারের সম্ভাবনাও থাকে। বিশেষ করে যে তেলটা ব্যবহার করা হয়, বারবার ব্যবহারের ফলে এর উপাদানগুলো পরিবর্তন হয়ে যায়। এতে আমাদের শরীরের ভালো ফ্যাট কমে খারাপ ফ্যাট বেড়ে যায়।
সচেতন হওয়ার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে অবশ্যই গ্রাহকদের সচেতন হতে হবে। তবে তার চেয়ে খাবার প্রস্তুতকারীদের সচেতন করা অধিক জরুরি। তাদের বলতে হবে, তারা যেন ফ্রেশ তেল ব্যবহার করে। অথবা তেল ছাড়া যেসব খাদ্য রয়েছে তা তৈরি করে। এক্ষেত্রে মমো, ফ্রুট সালাদ আইটেম বাড়ানো যায়। আমরা নিজেরাও তেলে ভাজা খাবার পছন্দ করি। এক্ষেত্রে উৎপাদকদের আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। বাইরের বিভিন্ন দেশে সালাদের আইটেম করা হয়, যা ইদানিং আমাদের এখানেও করা হচ্ছে। এটা স্ট্রিট ফুড হিসেবে আসতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পানি, তেলসহ যেসব উপাদান ব্যবহার করে সেগুলো যেন স্বাস্থ্যসম্মত হয়। মানুষের জন্য পরামর্শ, বাসায় তৈরি খাবারটাই সর্বোত্তম। না পারলে একটু ভালো কোনো জায়গায় খাবার গ্রহণের পরামর্শ থাকবে। যেন সেটা স্বাস্থ্যকর হয়।
সরকার ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের তদারকি জরুরি
স্ট্রিট ফুডের বাজার বাড়ার পাশাপাশি এ সংক্রান্ত স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ছে উল্লেখ করে এ বিষয়ে সরকার ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন বলে জানান জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ডা. লেলিন চৌধুরী।
ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, স্ট্রিট ফুডগুলো তৈরির বিষয়টি স্বাস্থ্যসম্মত হতে হবে। একই তেল দিয়ে কোনো কিছু ভাজা যাবে না। এখানে যে পানিটা ব্যবহার করা হয় তা সুপেয় পানি হতে হবে। এটি খোলা অবস্থায় রাখা যাবে না। খোলা রাখলে বাতাসের যে দূষণ রয়েছে তা খাবারের ওপর জমা হয়। যারা এটি পরিবেশন করবে তাদের হাতে গ্লাভস থাকতে হবে, খালি হাতে কোনো কিছু ছোঁয়া যাবে না। এই বিষয়গুলো সরকার ও তদারকি কর্তৃপক্ষের দেখা উচিত। এটি করা না হলে, একদল মানুষ দায়িত্বহীন হয়ে যায়। খাবারের ক্ষেত্রে দায়িত্বহীন হওয়া মানে, মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনহানীর ঝুঁকি তৈরি হওয়া। সুতরাং অবশ্যই বিষয়টাকে নজরদারির মধ্যে আনা উচিৎ।
ভোক্তাদের সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, যারা খাবারগুলো খাচ্ছেন তাদের প্রতি পরামর্শ, খোলা খাবার ও যে খাবারগুলো খালি হাতে পরিবেশন করা হয় তা খাবেন না। খাবার খাওয়ার সময় এর রঙ ও গন্ধ দেখবেন। খাবারের যদি আর্টিফিসিয়াল কালার দেওয়া থাকে তা বর্জন করতে হবে। খাবারের গন্ধে যদি সেটা নষ্ট ও খারাপ মনে হয়, তাহলে তারা তা খাবে না। এমন হলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নজরে এনে আইনি প্রদক্ষেপ নিতে হবে।
এমএইচ