দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছরেরও কম সময় বাকি। ২০২৪ সালের প্রথম সপ্তাহে ভোট হওয়ার কথা। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হবে চলতি বছরের নভেম্বরে। তবে এরইমধ্যে ভোটের হাওয়া বইতে শুরু করেছে দেশজুড়ে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করতে চায়। দলটি ইতিমধ্যে তাদের নির্বাচনী প্রচারণাও শুরু করেছে। অপরদিকে সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে আন্দোলনে মাঠে আছে বিএনপি। আর পারিবারিক কলহের মধ্যদিয়ে গেলেও ভোটের বিষয়ে চোখ-কান খোলা জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের।
দেশের ৩০০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ২০টি ঢাকায়। তার একটি ঢাকা-৭। সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ঢাকা-৭ জাতীয় সংসদের ১৮০নং আসন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ঢাকা মহানগরের বংশালের একাংশ, কোতয়ালী থানার একাংশ, চকবাজার, লালবাগ নিয়ে গঠিত৷ পুরান ঢাকার চামড়ার আড়ৎ, কেমিকেল গোডাউন/কারখানা ঢাকা-৭ আসনের অন্তর্ভুক্ত।
বিজ্ঞাপন
আসনটির বর্তমান সংসদ সদস্য হাজী মো. সেলিম। ২০১৪ সালে স্বতন্ত্র এবং ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য হন তিনি।
দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ এই সংসদ সদস্য। পুরান ঢাকায় প্রচলিত আছে, সংসদ সদস্য হাজী সেলিম হলেও স্থানীয়ভাবে দায়িত্ব পালন করেন তার ছেলে ইরফান সেলিম। তবে ২০২০ সালের ২৫ অক্টোবর রাজধানীর কলাবাগান বাসস্ট্যান্ড এলাকায় নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তাকে মারধর করেন ইরফান সেলিম। সে ঘটনায় সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম হন তিতনি। পরদিন তার বাসায় অভিযান চালায় র্যাব। গ্রেপ্তার হন হাজী সেলিমপুত্র। এক বছরের জন্য দণ্ডিত হন তিনি। সাময়িক বরখাস্ত হন সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর পদ থেকে।
এদিকে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে করা দুদকের মামলায় ২০২২ সালে গ্রেপ্তার হন হাজী সেলিম। এ মামলায় ২০০৮ সালের এপ্রিলে ১৩ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল সেলিমের। পরে আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ২০১১ সালে ওই দণ্ড বাতিল করলে দুদক আবার উচ্চ আদালতে আপিল করে। শুনানি শেষে ২০১৫ সালে হাইকোর্টের রায় বাতিল করে আপিল বিভাগ আবারো হাইকোর্টে শুনানির নির্দেশ দেয়। শুনানি শেষে ২০২১ সালের ৯ মার্চ হাইকোর্ট সাজা বহাল রাখে। পরে হাজী সেলিমকে আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন আদালত। নির্দেশ অনুযায়ী আত্মসমর্পণ করলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: জেল খেটে বের হয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সরব তারা
এই আসনে আওয়ামী লীগের কয়েকজনের নাম আলোচনায় আছে। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মহলে আলোচনা- ঢাকা-৭ আসনে এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে পারেন সংগঠনটির আইন বিষয়ক সম্পাদক নজিবুল্লাহ হিরু। পেশায় আইনজীবী নজিবুল্লাহ হিরু আদালতপাড়া ও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নিজেকে ভালোভাবেই মেলে ধরতে পেরেছেন। একই সঙ্গে ঢাকা-৭ আসনের ভোটারদের সঙ্গেও তার ভালো যোগাযোগ গড়ে উঠেছে।
আবার কেউ ভরসা রাখছেন পুরনো মুখের দিকে। হাজী সেলিমের আগে আসনটির সংসদ সদস্য ছিলেন ড. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। নবম জাতীয় সংসদে ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য থাকা মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। তিনি তৃণমূল থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে আজকের অবস্থানে এসেছেন। পাশাপাশি ঢাকা-৭ আসনে তার অবদানও কম নয়।
শহিদনগরের বাসিন্দা জুয়েল শেখ ঢাকা মেইলকে বলেন, মোস্তফা জালাল সাহেবকে দল থেকে মনোনয়ন দেওয়া হলে আর কিছু হোক বা না হোক, একটা হাসপাতাল অন্তত হবে। আমাদের কষ্ট কিছুটা কমবে।
লালবাগ এলাকার বাসিন্দা শমশের খান ঢাকা মেইলকে বলেন, রাস্তাঘাটের কী অবস্থা দেখেন। এগুলো তো ঠিক করা লাগে। কেউ তাকায় না।
এদিকে এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কে হবেন তা নিয়ে কিছুটা সংশয় আছে দলটির স্থানীয় নেতাকর্মীদের মাঝে। কারণ ঢাকা-৭ আসনে আওয়ামী লীগের তিনটি আলাদা গ্রুপ রয়েছে- হাজী সেলিম গ্রুপ, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন গ্রুপ এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির গ্রুপ।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের অভিমত, এই গ্রুপ ছেড়ে বের হতে হবে ঢাকা-৭ আসনের নেতাদের।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোকাদ্দেস হোসেন জাহিদ ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের এখানে গ্রুপিং আছে। এই গ্রুপিং ছেড়ে বের হতে হবে। যদি গ্রুপিং না থাকে, সবাই যদি মিলে থাকে, তাহলে নৌকা নিয়ে যে দাঁড়াবে সেই পাস করবে।
আরও পড়ুন: আওয়ামী লীগের চার সংগঠনের পূর্ণাঙ্গ কমিটি কবে?
সংসদীয় আসনটিতে বিএনপির অবস্থান শক্তিশালী নয় বলে দাবি করেন তিনি। আগামী নির্বাচনে ঢাকা-৭ আসনে বিএনপির প্রার্থী হতে পারেন নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুর স্ত্রী নাসিমা আক্তার কল্পনা।
বর্তমান সংসদ সদস্যের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা-৭ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি দল করি। আমি আওয়ামী লীগের সদস্য থেকে আজকে এত বড় হইছি। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হওয়ার প্রত্যাশা অবশ্যই করি। আজকে যিনি (হাজী মো. সেলিম) আছেন, তার কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। তার অবস্থান, কি করছেন, কত বছর সাজাপ্রাপ্ত, পার্লামেন্টে যায়, মানুষ হাসে না?
সংসদীয় আসনটির বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, আমি ছিলাম একবার দায়িত্বে। আমাদের এলাকার লোকজন তাদের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করায় না। বয়স হলেই বিয়ে দিয়ে দেয়। আমি আজিমপুর গার্লস স্কুল সরকারি করেছি। আমি মনে করি, আমাদের পুরাতন ঢাকার মানুষ, যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল, এখন সেটা নেই। তাদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ কৃষিবিদ হয়।
আরও পড়ুন: সংগঠন শক্তিশালী করার দিকে মনোযোগ আওয়ামী লীগের
মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, আপনি জানেন কি না আমি জানি না, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে অনেক টাকা দিয়েছিলেন, ১৫ কোটির অধিক। তিনি বলেছিলেন, তুমি এই টাকা নিয়ে তোমার এলাকায় কিছু একটা করো। আমি একটা হাসপাতাল করেছিলাম। হাসপাতালের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে, পরে ঘটনাচক্রে অন্যজন দায়িত্ব পাওয়ার পর কাজ শেষ করে নাই। এখন সেটা র্যাবের অফিস হয়েছে। ওখানে একটা সরকারি হাসপাতাল হলে এসব এলাকার লোকজন ভালো চিকিৎসা পেত, বিনামূল্যে ওষুধ পেত।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির ঢাকা মেইলকে বলেন, নেতাকর্মীরা জানে আমি ন্যায়নিষ্ঠাভাবে জীবনযাপন করি, রাজনীতিও করি। এই কারণে আমার উপর তাদের বিশ্বাস আছে। যদি আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়, আমি তাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারব। তারা জান-প্রাণ দিয়ে মাঠে থাকবে। চেষ্টা করবে আমাকে বিজয়ী করার জন্য। তিনি বলেন, যারা আমার প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছে এবং আমার হয়ে কাজ করছেন তাদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই।
হুমায়ুন কবীর বলেন, ঢাকা-৭ আসনের মানুষের দীর্ঘদিনের আশা একজন ভালো, নিষ্ঠাবান, কমিটেড নেতা দরকার। স্বাভাবিকভাবে দেখেন, যারা এখানে ছিলেন বা আছেন জনগণ তাদের আকাঙ্ক্ষিত লোক পায়নি।
এ বিষয়ে জানতে ঢাকা-৭ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য হাজী মো. সেলিমের ছেলে ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩০নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইরফান সেলিমের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, জনপ্রিয়তার দিক থেকে বর্তমানে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে তার বাবা এক নম্বরে আছেন।
কারই/জেএম