খালেদা জিয়ার জীবনে সবচেয়ে বড় ট্রাজেডিটা কী জানেন? সবচেয়ে বড় ট্রাজেডিটা হচ্ছে, তাঁকে সব সময় হাসিনার সাথে তুলনা করা। তিনি জন্মেছিলেন হাসিনার কাছাকাছি সময়ে, রাজনীতিতে অভিষেকও বলতে গেলে একই সময়ে। সাজুয্য মাত্র এতটুকু। আর এইটুকু বাদ দিলে আর কোনোভাবেই খালেদা জিয়ার সাথে হাসিনার তুলনা চলে না। খালেদা জিয়ার বিধিলিপি হচ্ছে, তিনি তৃতীয় বিশ্বের একটি দরিদ্র দেশের রাজনীতিক। উন্নত দেশে জন্ম নিলে কিম্বা রাজনীতি করলে তিনি হতেন বিশ্বসভার প্রথম বেঞ্চের একজন নেতা।
প্রায় সাড়ে ছয় বছর পর বৃহস্পতিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) তিনি কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বক্তৃতা দিলেন। তার বক্তব্যের কোথাও কি আমরা পেলাম, তার ব্যক্তিগত দুঃখ, শোক, প্রতিহিংসার কথা। অথচ ভাবুন তো, গত পনের বছরে তাঁর ওপর দিয়ে কী চলেছিল। কত জুলুম, কত মিথ্যাচার, কত নির্যাতন, কত অপমান তাকে সয়ে যেতে হয়েছিল। অথচ তাঁর বক্তৃতায় তার কোনো লেশমাত্র আমরা খুঁজে পেলাম না। বরং তিনি ব্যক্তিগত দুঃখ, তাপ, গ্লানিকে উপেক্ষা করে, কী শান্ত ধীরস্থিরভাবে শুধু দেশের মানুষের কল্যাণের কথাই তুলে ধরলেন নিজের বক্তৃতায়।
বিজ্ঞাপন
এখানেই একজন খালেদা জিয়া সবার চেয়ে আলাদা, সবার চেয়ে ব্যতিক্রম, সবার চেয়ে অনন্য।
দুই.
হাসিনার প্রতিহিংসায় কথিত দুর্নীতির অভিযোগে জেলে যাবার আগে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেছিলেন- আমার জন্য হরতাল-ধর্মঘটের মতো কোনো কর্মসূচি নয়। এর আগে তিনি সংবাদ সম্মেলনে রিকন্সিলিয়েশনের কথা বলেছিলেন। প্রতিহিংসার রাজনীতি তিনি করবেন না বলেছিলেন।
আরও পড়ুন
কিন্তু সে সময় আর আজকের প্রেক্ষাপটটা সর্ম্পূর্ণ ভিন্ন। আজ তিনি ইচ্ছে করলে বলতে পারতেন- তার ওপর হাসিনার অন্যায়-অবিচার জুলুমের কথা। ছেলে হারানোর বিয়োগান্তক স্মৃতিচারণও করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেদিকে যাননি, তিনি তার বক্তৃতায় ছিলেন সংযত, বিনয়ী, দেশের সত্যিকার কল্যাণকামী অভিভাবকের মতো কিছুটা উদ্বিগ্নও। আর এখানেই বাংলাদেশের অন্য সকল রাজনীতিকের সাথে তাঁর মোটা দাগের পার্থক্য।
তিন.
জিয়াউর রহমান বিএনপি নামক একটি রাজনৈতিক দলের বীজ রোপন করে গিয়েছিলেন, বেগম জিয়ার নেতৃত্বে সেই দল পল্লবিত বৃক্ষে পরিণত এখন, দেশের সবচেয়ে বৃহৎ রাজনৈতিক দল বললে ভুল হবে না। দেশের সকল জাতীয়তাবাদী মানুষের ভরসাস্থল দলটির নামও এখন বিএনপি।

অথচ সেই দলের কান্ডারি, প্রাণভোমরা কিম্বা জিয়নকাঠি, যে বিশেষণে বেগম জিয়াকে ভূষিত করেনন না কেন, তিনি গত পনের বছর ছিলেন সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত, সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত, সবচেয়ে বেশি মজলুম।
দিনের পর দিন উপযুক্ত চিকিৎসা না পেয়ে তাঁকে থাকতে হয়েছিল জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। হাসিনা তাঁকে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ দিতে বিদেশে না পাঠানোর চরম এক নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেছিল। অথচ রাজনীতিবিদ হতে হলে প্রথম শর্তই হচ্ছে তাঁকে দেশপ্রেমিক হতে হবে। খালেদা জিয়ার দেশপ্রেম ঈর্ষণীয়। সকল প্রশ্নের ঊর্ধ্বে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়া নিজেই একটা কাল্ট, নিজেই একটা ন্যারেটিভ। দুষ্টু অযুত জটিল কমপ্লেক্সে ভরা রাজনীতিকদের মধ্যে তিনি একজন সোজাসাপ্টা নিরেট দেশপ্রেমিক রাজনীতিক। এরশাদবিরোধী মুভমেন্টে গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর আপসহীনতার কারণে একানব্বই সালে অপ্রস্তুত অগোছালো একটি দল বিএনপিকে জনগণ ভালোবেসে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী করেছিল। দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হয়ে শপথ নিয়ে দেশটাকে ভালোভাবেই পরিচালনা করেছিলেন। কিন্ত শেষ পর্যন্ত বিজয়ের বন্দরে পৌঁছতে তিনি পারেননি। আওয়ামী লীগ-জামায়াত জুটির অপরিণামদর্শী দেশবিরোধী কার্যক্রম। আওয়ামী লীগের ১৭৩ দিন হরতাল অবরোধ। আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দীন আহমেদের লাগাতার চট্টগ্রাম বন্দর অচল করে দেবার পরেও নিজ শত প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে দেশকে ‘ইমাজিন টাইগারে’ পরিণত করেছিলেন। সাইফুর রহমানের মতো ভিশনারি সংস্কারবাদী ব্যক্তিকে অর্থমন্ত্রীর পদে বসিয়ে দেশের অর্থনৈতিক খাতে ব্যাপক সংস্কার এনেছিলেন। খেলাপি ঋণ এরশাদের আমলে যা ছিল তার থেকে আরও নামিয়ে আনতে পেরেছিলেন। দলীয় এবং স্বজনপ্রীতি কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেননি তিনি। তার প্রথম আমলে কোনো বেসরকারি ব্যাংকের অনুমোদনও পায়নি।
২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পরও তার অর্থনৈতিক খাতে সংস্কার চালু ছিল, শেয়ার বাজারও ছিল সাউন্ড। কোনো ধস নামেনি। বাজার সিন্ডিকেট, প্রকল্প গ্রহণের নামে কোনে ধরনের দীর্ঘ সূত্রিতাকে প্রশ্রয় দেননি খালেদা জিয়া। সাইফুর রহমান তাঁর আত্মজীবনীমূলক বইতে লিখেছেন, একবার একটি প্রকল্পের পরিচালককে ডেকে পাঠিয়ে বেগম জিয়া ধমকের সুরে বলেছিলেন- নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারলে আপনাকে প্রকল্প থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে। সরকারই প্রকল্পের বাকি কাজ শেষ করবে। মেয়াদ বাড়িয়ে প্রকল্পের অর্থ তসরুপের কোনো সুযোগ আমি দেব না।
এমন ইস্পাত কঠিন ছিলেন খালেদা জিয়া। সরকারি টাকা খরচের ব্যাপারে ভাবতেন তিনবার। যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের আগে এক্সপার্ট, বিনিয়োগ সংস্থার প্রতিনিধি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী এবং মন্ত্রণালয় কর্মকর্তাদের সাথে বসতেন। সরকারি টাকা অপচয় কোনোভাবেই সমর্থন করতেন না। লিখেছেন সাইফুর রহমান।
ব্যক্তি জীবনেও খালেদা জিয়া মিতব্যায়ী। আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপন তাঁর পছন্দ না। সম্ভবত এই বৈশিষ্ট্যটা তিনি পেয়েছিলেন তাঁর প্রয়াত স্বামী সাবেক প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে।
একটা ছোট ঘটনার বর্ণনা দিলে বেগম জিয়ার মিতব্যয়িতার পরিচয় পাওয়া যাবে। স্মৃতিচারণটা করেছিলেন আমার দৈনিক বাংলার সিনিয়র সহকর্মী শ্রদ্ধাভাজন মনজুর আহমদ। এখন তিনি নিউইয়র্ক প্রবাসী।
তিনি তখন দৈনিক বাংলার স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, একবার প্রেসিডেন্ট জিয়ার ইন্টারভিউ নেবেন বলে তার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া পরদিন সকাল সাতটায় সময় দিলেন। মর্নিংওয়ার্ক শেষে কথা বলবেন। সেই মতো পরদিন সাতটায় মঞ্জু ভাই যথারীতি হাজির। প্রেসিডেন্ট তাঁকে স্বাগত জানিয়ে পাশের চেয়ারে বসালেন। এক ফাঁকে একজন গৃহপরিচারিকাকে ডেকে মঞ্জু ভাইয়ের জন্য চা দিতে নির্দেশ করলেন। কিছুক্ষণ পর শুধু এক কাপ চা হাতেই ফিরে এলো গৃহপরিচারিকা। সেটা দেখে প্রেসিডেন্ট একটু উষ্মা প্রকাশ করে বললেন-এই সকালে ব্রেকফাস্টের সময় শুধু চা...!
মঞ্জু ভাই, বললেন, দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েও এমন সাধাসিধে, অনাড়ম্বর, জৌলুসবিহীন জীবনযাপন করতেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। আর তার পত্নী হিসেবে খালেদা জিয়ারও ছিল না তেমন কোনো চাওয়া পাওয়া।
অথচ সেই খালেদা জিয়াকে টেনে হিচড়ে নিচে নামাতে কী কসরতটাই করেছে হাসিনা সরকার। কোনো দোষ না পেয়ে মাত্র দুই কোটি টাকা আত্মসাতের কথিত দুর্নীতি মামলায় তাকে সাজা দিয়ে চরম প্রতিহিংসা চরিতার্থের এমন নজির পৃথিবীর কোথাও নেই। অথচ যে টাকা তসরুপের অভিযোগ করা হয়েছিল, সেটা অন্য ব্যাংকে স্থানান্তর করে এখন দুই কোটি টাকা দশ কোটি হয়েছে।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, নিম্ন আদালত যে সাজা দিক না কেন, উচ্চ আদালত সেটা সবসময় কমিয়ে দেয় অথবা যেমন আছে তেমন রাখে। একমাত্র ব্যতিক্রম খালেদা জিয়া। যাকে উচ্চ আদালত সাজা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। এসবই করেছিল হাসিনার নির্দেশে তার বশংবদ বিচার বিভাগ।

খালেদা জিয়া মৃদুভাষি। হাসিনার মতো মুখরা রমনী তিনি নন। তাঁকে হাসিনা রেজিমের পনের বছরে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে যেভাবে যা ইচ্ছে তাই অশ্রাব্য ভাষায় নিন্দা মন্দ। তাঁর ব্যক্তিজীবন নিয়ে নানা শ্লেষ, ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলা হয়েছিল। তখন তিনি জেলে। যখন মুক্ত ছিলেন কখনো তার পাল্টা জবাব দেননি। সব সময় নীরব থেকেছেন। নীরবতাই ছিল খালেদা জিয়ার জবাব।
বেগম জিয়া শুধু একটা নাম নয়, তিনি স্বয়ং একটা ইতিহাস! একজন প্রধানমন্ত্রীর কী গুণাবলি থাকতে হয়, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশে সেটা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একদিন ঠিকই অনুধাবন করবে। ৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফেরা থেকে শুরু করে তার কী ভূমিকা সেটা কদিন ধরে পড়ছি। মাহফুজ উল্লাহ ভাই আজ নেই, তিনি যে বেগম জিয়ার ওপর কত বড় কাজ করে গেছেন, আজ বুঝছি। কত বড় নেতা আমরা পেয়েছি! মাহফুজুল্লাহ ভাইও আমাকে ‘বেগম জিয়া’ এবং ‘একজন জিয়া’ নামে তার দুটি বই উপহার দিয়ে বলেছিলেন- পড়িস! তাঁরা কেমন ছিল। আমি পড়ে তাঁকে আর রিপ্লাই দিতে পারিনি। তিনি গত হয়েছেন আমাদের মাঝ থেকে বহুদিন হলো। আজ আবার তার কথা মনে পড়ছে…
মাহফুজ উল্লাহ ভাই লিখেছেন, আমাদের এই বামন রাজনীতিকদের মধ্যে সত্যিকারের প্রমাণ সাইজ মানুষ একজনই আছেন, তিনিই বেগম খালেদা জিয়া। এই মানুষটাকে বাঁচানো না গেলে আমরা সবাই অপরাধী হয়েই থাকবো।
ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর, খালেদা জিয়া উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডন যান। সেখানে উন্নত চিকিৎসার পর এখন স্বজন-সান্নিধ্যে বেশ সুস্থই আছেন বোধ করি। অনেক দিন পর তাঁর বক্তৃতা শুনলাম। আল্লাহ বেগম খালেদা জিয়াকে আরও বহুদিন সুস্থ রেখে দেশের মানুষের সেবা করার সুযোগ দেবেন- প্রার্থনা শুধু এটুকুই।
আমি বিশ্বাস করি, দেশের মানুষ খালেদা জিয়ার জন্য দোয়া করেন। কারণ তিনি তো একমাত্র রাজনীতিক যিনি সব সময় দেশের মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করেছেন, উৎসর্গও করেছেন অনেক কিছু। ইস্পাত কঠিন দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী খালেদা জিয়াকে দেশি-বিদেশি বহু শক্তি পরাজিত করতে চেয়েছে, কিন্তু পারেনি। তিনি অপরাজিতা। তাঁকে আমার কুর্নিশ।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট