বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে ৪০ থেকে ৭০ দিনের টানা ছুটিতে যাচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এটি নিয়ে ছুটি প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ, সকল স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক এমনকি শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে মনগড়া বিরূপ আলোচনায় মেতে উঠেছে মিডিয়াজগৎ। কলেজ পর্যায়ের একজন শিক্ষক হিসেবে বিষয়টি নিয়ে কিছু মন্তব্য করা প্রয়োজন বলে মনে করছি।
প্রথমেই বলব এ ছুটির মধ্যে বড় একটা ফাঁকি আছে। তথাকথিত ছুটির সময়ে সরকারি-বেসরকারি কলেজের অধিকাংশ শিক্ষককে সদ্য সমাপ্ত দ্বাদশ শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষার শত শত (বহুনির্বাচনী ও সৃজনশীল) উত্তরপত্র মূল্যায়নপূর্বক ফলাফল প্রস্তুত করতে হবে। তাছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং বোর্ডের বিভিন্ন রকম গোপনীয়, সাধারণ কর্ম যেমন ডিগ্রি পাস কোর্স, সদ্যসমাপ্ত বা সমাপ্তপ্রায় অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ এবং চলমান মাস্টার্স পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন, ছুটির পরপরই অনুষ্ঠিতব্য বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও মডারেশনসহ নানা কাজে ব্যস্ত সময় পার করতে হবে।
বিজ্ঞাপন
তদুপরি সবার ছুটি কিন্তু ২ ফেব্রুয়ারি শুরু হচ্ছে না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বর্ষের পরীক্ষা চলমান এবং ছুটির মধ্যে ফরম পূরণ আছে। আগামী ৬ মার্চ মাস্টার্স পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। সরকারি সাত কলেজখ্যাত প্রতিষ্ঠানেও অনার্স দ্বিতীয়, ডিগ্রি ও মাস্টার্স পর্যায়ের পরীক্ষা চলমান রয়েছে। আগামী ১১ মার্চ মাস্টার্স পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
দ্বিতীয়ত, পরীক্ষা চলাকালীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস ছুটি থাকে। কারণ তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরীক্ষা কেন্দ্রে পরিণত হয়। পরীক্ষা চলাকালীন ক্লাস কে নেবে? শিক্ষকরা পরীক্ষা পরিচালনা কমিটিতে কাজ করেন। আগামী ১০ এপ্রিল থেকে শুরু হচ্ছে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। এ সময় কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকবে এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র। কেন্দ্র থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো টানা দুই মাস ১০ দিনের ছুটি কাটাবে। এখানে পরীক্ষা পরিচালনা করবেন কারা আর কারা পরীক্ষা দেবেন। পরীক্ষা চলমান প্রতিষ্ঠানগুলো কি বন্ধ থাকল।
অর্থ কী দাঁড়ালো? আসলে শিক্ষকদের কোনো ছুটি নেই, এমনকি শিক্ষার্থীরাও তো প্রকৃতপক্ষে ছুটি ভোগ করতে পারছে না। তারা তো পরীক্ষার হলে কিংবা ছুটি শেষ হওয়ামাত্র অনুষ্ঠিতব্য পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। তাহলে ছুটি কার? শিক্ষকের? শিক্ষার্থীর? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের? আসলে ছুটি কারও না। প্রকৃতপক্ষে পরীক্ষা সংশ্লিষ্ট কাজের প্রস্তুতির জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাধারণ সিডিউলে মাঝেমধ্যে পরিবর্তন আসে, যেটাকে খালি চোখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি হিসেবে ভ্রম হয় সাধারণ চোখে।
তৃতীয়ত, বিগত সরকারের সময় মার্চ মাসে জাতীয় দিবসের কোনো কমতি ছিল না। বেশিরভাগ দিবসে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি শূন্য হলেও প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন কায়দায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হয়েছে, যেখানে শিক্ষকদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক।
বিজ্ঞাপন
এবার ছুটিতে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস এবং ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসের কর্মসূচি রয়েছে। আরেকটি বিষয় ঢাকাসহ বেশিরভাগ বিভাগীয় শহরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পর্যায়ের ভর্তি এবং নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ছুটি থাকা অবস্থায়ও শিক্ষকদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। যদিও এখানে একটি আর্থিক বিষয় সংশ্লিষ্ট থাকে।
চতুর্থত, শিক্ষা বিভাগ হচ্ছে ভ্যাকেশন ডিপার্টমেন্ট। ফলে এখানে শিক্ষকরা অর্জিত ছুটি পান না, যা অন্যান্য বিভাগের কর্মচারীরা পেয়ে থাকেন। অর্জিত ছুটি মানে প্রত্যেক ১২ দিন কাজ করলে এক দিন তথা বছরে এক মাস পূর্ণগড় বেতনে ছুটি পাওয়া যায়। আর এই ছুটির মারপ্যাঁচে অবসরে যাওয়ার সময় সকল পর্যায়ের শিক্ষক কমবেশি ক্ষতির সম্মুখীন হন।
উদাহরণস্বরূপ, সরকারি কলেজের একজন শিক্ষক প্রায় ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা কম সুবিধা পেয়ে থাকেন। তাহলে এই শিক্ষকরা যে বিভিন্ন সময় তথাকথিত ছুটি ভোগ করে থাকেন, তা তো তাদের আর্থিক মূল্যে কেনা ছুটি। যেহেতু উল্লেখিত বন্ধের মধ্যে একাডেমিক বিষয়ে বিভিন্ন প্রশাসনিক কার্যক্রম চালু থাকবে, সেহেতু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রীয় অফিস এবং বিভাগীয় অফিস খোলা থাকবে।
এ সময় প্রায় সকল প্রতিষ্ঠান প্রধানসহ ছুটিতে থাকা শিক্ষকদের মধ্যে ছুটিকালীন দায়িত্ব বণ্টন করা হয়। তাছাড়া প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই শিক্ষার্থীদের বাসায় পড়ার জন্য বাড়ির কাজ দেবে, শিক্ষকরা নিজেদের মতো করে সেগুলোর খোঁজখবর নেবেন এবং ছুটি পরবর্তী বাড়ির কাজ মূল্যায়ন করবেন।
পত্রিকায় উল্লেখ, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে মাধ্যমিক পরীক্ষা চলাকালীন পরীক্ষার ফাঁকে ফাঁকে ক্লাস নেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। তা যদি করা হয় তাহলে টানা ৭০ দিন কীভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকল। তাহলে টানা ছুটি কথাটার অর্থ কী দাঁড়ালো? তাই বলি, না বুঝে কথা বলা কারও কাম্য নয়।
ছুটির তালিকা দেখে ভাবছেন গেল গেল সব শিক্ষকরা নিয়ে গেল। আসুন সবাই প্রকৃত বাস্তবতায় কথা বলি যাতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সকলে উপকৃত হয়। কোনো গুজব ছড়ানো কারও দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না।
লেখক: শিক্ষক, কলামিস্ট