বেগম রোকেয়া বলেছেন- ‘যে জাতি নারীকে অবজ্ঞা করে সে জাতি কখনো উন্নতি করতে পারে না।’ বিশ্বখ্যাত মানবাধিকার কর্মী মালালা ইউসুফজাই বলেছেন, ‘আমরা সবাই সফল হতে পারবো না, যদি আমাদের অর্ধেককে পিছিয়ে রাখা হয়।’
এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো- ‘অধিকার, সমতা ও ক্ষমতায়ন- নারী ও কন্যার উন্নয়ন।’ এ দিনটি শুধু উদযাপনের জন্য নয়, বরং নারীদের জীবনমান উন্নত করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ারও সময়।
বিজ্ঞাপন
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সূচনা ১৯০৮ সালে, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ১৫ হাজার নারী শ্রমিক তাদের কর্মস্থলে ন্যায্য মজুরি, কর্মঘণ্টা কমানো এবং ভোটাধিকারের দাবিতে বিক্ষোভ করে। এরপর ১৯০৯ সালে আমেরিকার সোশ্যালিস্ট পার্টি ২৮ ফেব্রুয়ারি ‘জাতীয় নারী দিবস’ পালন করে। তবে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি আসে ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে, যেখানে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেতা ক্লারা জেটকিন নারী দিবস পালনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯১১ সালে প্রথমবার অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ (ইউএনও) এই দিনটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় এবং ১৯৭৭ সালে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে নারী অধিকার ও সমতার লক্ষ্যে এই দিনটি পালনের আহ্বান জানানো হয়।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের তাৎপর্য বহুমাত্রিক। এটি শুধু নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের দিন নয়, বরং নারীদের অধিকার রক্ষা, সমান সুযোগ তৈরি, লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং নারীদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন।
এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়ে ফিরে আসি। এবারের প্রতিপাদ্য হলো-‘অধিকার, সমতা ,ক্ষমতায়ন- সকল নারী ও কন্যার উন্নয়ন।’ এ নিয়ে যদি বলতে হয় তাহলে পুরো সমাজের কাছে ছোট ছোট কয়েকটা প্রশ্ন, কিন্তু অর্থপূর্ণ প্রশ্ন আমি ছুড়ে দিতে চাই। আমাদের গুরুজনেরা, মনীষী-মহীয়সীরা সত্যিই অনেক সুন্দর কথা ও সুযোগ তৈরি করে দিয়ে গেছেন যদিও-
# তবুও আমরা এখনো কেন লড়াই করেই যাচ্ছি?
বিজ্ঞাপন
# এখনো শত শত মেয়েরা শ্বশুরবাড়িতে যৌতুকের জন্য নির্যাতিত। কেন?
# এখনো কেন তাদের পাতে মাছের লেজটাই নিয়ম করে জোটে?
# এখনো কেন পাবলিক প্লেসে হেনস্থার শিকার হতে হয়?
# এখনো মার্জিতভাবে চললেও নোংরা দৃষ্টির ছোবলে সর্বদা কুঁচকে থাকতে হয়। কেন?
# নারী প্রতিষ্ঠিত হলেও শুনতে হয়- ‘ও নিশ্চয়ই কুপথে রোজগার করে।’ কেন?
# এখনো নারী কেন আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভোগে?
# এখনো নারী সমাজের বেশির ভাগই বিষণ্ণতার রোগী। কেন?
# এখনো নারী ‘কোনটা তোমার আসল বাড়ি’- এই প্রশ্নে ঘুরপাক খায়?
# এখনো নারী মানেই রান্নাঘর। কেন?
# এখনো নারী ‘কে আমার আপন’- খুঁজতে খুঁজতে হয়রান?
# এখনো কেন পরিবারের কোনো সিদ্ধান্তের বৈঠকে ঠাঁই হয় না? সিদ্ধান্ত দেওয়ার কণ্ঠ দিতে পারে না? অধিকার তার নেই। কেন?
# এখনো নারী টক্সিক ম্যারাইটাল লাইফেও আতঙ্কগ্রস্ত, আবার ডিভোর্সের পরেও আতঙ্কগ্রস্ত? বিয়ের পর আতঙ্ক, স্বামী যদি ডিভোর্স দিয়ে দেয়! আবার ডিভোর্সের পরেও আতঙ্ক, সমাজ যদি আমাকেই দোষারোপ করে যে, আমিই খারাপ তাই সংসার টেকাতে পারিনি?
# সব ক্ষেত্রেই এখনো কেন নারীর দোষ?
# শিক্ষা ও ক্যারিয়ারের পদে পদে বাধা। কেন?
# কেন বেতন বৈষম্য?
# কেন চাকরির সুযোগের অভাব?
# পারিবারিক ও সামাজিক গোঁড়ামি-কেন?
# মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। কেন?
আমার এ প্রশ্নগুলোর বাইরেও হাজার হাজার প্রশ্ন নিয়ে আজও আমাদের নারীসমাজ যুদ্ধ করছে। এই যুদ্ধের অবসান এখন সময়ের দাবি। অথচ দ্যা ফ্যাক্ট ইজ, নারী কোনো একক পরিচয়ে সীমাবদ্ধ নন-তিনি একাধারে মা, মেয়ে, স্ত্রী, বোন, কর্মী, নেতা, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী ,ইঞ্জিনিয়ার, খেলোয়াড়, স্বপ্নদ্রষ্টা ও সমাজ পরিবর্তনের অগ্রদূত। শিক্ষা, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, রাজনীতি, ব্যবসা, ক্রীড়া সবক্ষেত্রে নারীরা সফলতার গল্প লিখেছেন। বেগম রোকেয়া থেকে মালালা ইউসুফজাই, মেরি কুরি থেকে কাল্পনা চাওলা। তাঁরা প্রমাণ করেছেন যে, নারী এগিয়ে গেলে সমাজও এগিয়ে যায়।
বিশ্বখ্যাত লেখিকা মায়া এঞ্জেলু বলেছেন- ‘প্রতিবার একজন নারী যখন নিজের জন্য দাঁড়ায়, তখন তিনি সকল নারীর জন্যেও দাঁড়ায়। কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’ কবি সুফিয়া কামাল বলেছেন তার ‘আমি নারী’ কবিতায়-
‘আমি সেই নারী-
যে জগতের আলো আঁধারে আপন শক্তিতে জ্বলে,
আমি সেই নারী-
যে প্রেম, সাহস, শক্তি, ভালোবাসায় অনড় ও অমলিন।’
নারী সমাজের ব্যাপারে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের প্রতিষ্ঠাতা হজরত খান বাহাদুর আহসানুল্লাহ (রহ.), যিনি ছিলেন একজন সুবিবেচক এবং বিচক্ষণ মানুষ। তাঁর দৃষ্টি এবং চিন্তাশক্তি খুবই প্রখর ও সুনিপুণ ছিল সেই আমলেও। তিনি বলেছেন, ‘মুসলিম মহিলাগণ কখনো জ্ঞানে ও পাণ্ডিত্যে পুরুষ দিগের পশ্চাতে ছিলেন না। এমনকি বহুবিধ শাস্ত্রে তাঁহারা অধিকতর পারদর্শী ও অগ্রণী ছিলেন। কি অস্ত্রবিদ্যায়, কি রাজনীতি, কি রাজ্য শাসন সর্বত্রই তাঁহাদের প্রতিভা প্রকাশ লাভ করিয়াছিল।’ (রচনাবলী; তৃতীয় খণ্ড; পৃষ্ঠা ৯৫-৯৯)।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এখনো অনেক নারী বৈষম্যের, নির্যাতনের, বেতন বৈষম্য, সুযোগ ও নিরাপত্তাহীনতার শিকার। আজকের এই দিবসে আমরা সকলে মিলে প্রতিজ্ঞা করি-নারীর কণ্ঠকে গুরুত্ব দেব, নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করব, নারী স্বাধীনতা ও মর্যাদাকে সম্মান করব।
সকল নারীকে আমি ডা. রুবাইয়াৎ ফেরদৌস, একটা মেসেজ দিতে চাই- আসুন আমরা কোনো বাধার দেয়ালে থেমে না যাই, বরং সেই দেয়াল ভেঙে নতুন পথ তৈরি করি। কারণ নারী হলো শক্তি, নারী হলো সাহস, নারী হলো আগামী দিনের স্বপ্নদ্রষ্টা। নারী যখন নিজের শক্তি বুঝতে পারে, তখন সে পুরো বিশ্ব বদলে দিতে পারে। ওইদিন খুব তাড়াতাড়িই আসবে যেদিন সমতা, ক্ষমতা আর অধিকারের জন্য লড়াই করতে হবে না। ওই নতুন পথে আলোকিত হয়ে নারী-পুরুষ সকলেই হাঁটবো। দেশ ও জাতিকে উন্নত করব।
পরিশেষে কবি জীবনানন্দ দাসের সাথে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই-
‘আমার ভিতরে রক্তের স্রোত আছে ,
আমার চোখে অগ্নিশিখা
আমি থামবো না
আমি হারবো না।’
লেখক: মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও সহকারী অধ্যাপক, সাইকিয়াট্রি বিভাগ, ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল