বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি ক্লাসিক হয়ে গেছে শেখ হাসিনার ফ্যাসিজমকালে। সেসময় যখনই ভাষণটা শুনতাম; মনে হতো এই ভাষণটির পাকিস্তানের দখলদার স্বৈরশাসকের বৈষম্য ও গণতন্ত্রহীনতার বিরুদ্ধে উচ্চারিত শব্দগুলো যেন ভারত সমর্থিত দখলদার ফ্যাসিস্ট আওয়ামী শাসকের বৈষম্য ও গণতন্ত্রহীনতার বিরুদ্ধে উচ্চারিত হচ্ছে। উনি যখন বলেন, আপনি আমার কথা রাখলেন না; রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা; আমরা ঠিক অর্ধশতক পরে যেন শুনলাম, আপনি আমার কথা রাখলেন না, রাখলেন মোদি সাহেবের কথা।
পাকিস্তান উপনিবেশের ২৩ বছর আর ভারতের ছায়া উপনিবেশের ১৬ বছর এত আইডেন্টিক্যাল যে, বঙ্গবন্ধুর ঔপনিবেশিক শাসকের বিরুদ্ধে উচ্চারিত বক্তব্য একই রকম প্রাসঙ্গিক হয়ে ধরা দেয়।
বিজ্ঞাপন
পূর্ববঙ্গের কৃষকের উৎপাদিত পাট থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করে; পাঞ্জাবের গম ক্ষেত থেকে উঠে আসা শেয়াল যেভাবে আমাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছিল; বাংলাদেশের মেহনতি মানুষের উপার্জিত রেমিটেন্স ও গার্মেন্টস সেক্টরের বৈদেশিক মুদ্রা ভারত, দুবাই ও অন্যান্য দেশে পাচার করে; বাংলাদেশের ধানক্ষেত থেকে উঠে আসা শেয়াল একইভাবে আমাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে চলেছে। পাকশিয়ালেরা আমাদের মুসলমানের মর্যাদা দিতে চাইত না; আর বাকশিয়ালেরা আমাদের বাঙালির মর্যাদা দিতে চায় না। দুটি যুগক্ষণে ফইন্নি রুলিং এলিটেরা আমাদেরই খেয়ে-পরে আমাদেরই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছিল। সেইখানে বঙ্গবন্ধুর উচ্চারিত ‘আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না’ সেই অমোঘ বাক্য; যা পাকশিয়াল ও বাকশিয়াল উভয়ের মূল উৎপাটন করেছে। ভারতীয় মিডিয়ার খেকশিয়ালদের কাছে গিয়ে বাকশিয়ালেরা যে আপত্তিজনক কথা এখনো আমাদের বিরুদ্ধে বলছে; এর পরিণতি খুবই ভারী হবে। বঙ্গবন্ধুর উচ্চারিত, ‘আমরা তোমাদের ভাতে মারবো, পানিতে মারবো’ এক্ষেত্রে প্রণীধানযোগ্য।
লক্ষ্য করুন, বৈষম্য বিধুর পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানের স্বৈরশাসকের ‘উন্নয়নের যে বেহুদা ঢোলের কথা’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন; বৈষম্য বিধুর বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট শাসকের ‘উন্নয়নের সরকার বারবার দরকার’ শ্লোগান সেই বেহুদা ঢোলের কথা মনে করিয়ে দেয়।
বঙ্গবন্ধু সেই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ যার যা হাতে তা নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলেছিলেন, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে বলেছিলেন। আমাদের পূর্বপুরুষ সেই দুর্গ গড়ে তুলেছিলেন। রক্ত-ত্যাগে তারা বাংলাদেশকে পাকিস্তানের উপনিবেশ মুক্ত করেছিলেন। ২০২৪ সালের ১৬ জুলাইয়ের পর থেকে আরেকবার ঘরে ঘরে দুর্গ তৈরি হয়। ৫ আগস্ট গোটা ঢাকা শহর মানুষের দুর্গ হয়ে ওঠে। এবার আমাদের সন্তানেরা রক্ত-ত্যাগে বাংলাদেশে ভারত সমর্থিত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট শাসককে ভারতের কোলে ফিরে যেতে বাধ্য করে।
আমাদের সমাজের ট্র্যাজেডি হচ্ছে; যারা আওয়ামী ফ্যাসিস্টের দোসর, যারা মানবতাবিরোধী অপরাধের সমর্থক; তারাই ঘটা করে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ প্রচার করে। এই ট্র্যাজেডি আরেকটি রুপে আমরা দেখতে পাই যখন; পাকিস্তানের স্বৈরশাসকের ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের সমর্থকেরা ঘটা করে আমাদের মহানবীর বিদায় হজের বাণী প্রচার করে। দেশপ্রেম ও ধর্মপ্রেমের সোল এজেন্সি নিয়ে বসে আছে দুটি ঘাতক গোষ্ঠী। এই দুটি গোষ্ঠী জমজ ভাইয়ের মতো আমাদের ১৯৭১-এর অর্জন ও ২০২৪-এর অর্জন ম্লান করে দিতে সদাসক্রিয়। বৈষম্যমুক্ত সমাজ, আইনের শাসন ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পথে বাধা এই বকদেশপ্রেমিক ও বকধার্মিক; বিদ্বেষ ও বিভাজন সৃষ্টির মাধ্যমে যারা জীবিকা নির্বাহ করে।
বিজ্ঞাপন
বঙ্গবন্ধুর ছবি ঝুলিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ম্যানেজার হয়ে দেশ লুণ্ঠন কিংবা মহানবীর মর্যাদা রক্ষার দোহাই দিয়ে ইসলামি চেতনার ম্যানেজার হয়ে দেশ লুণ্ঠন; এসবের কারণে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া কিংবা মহানবী ও ইসলামের নৈতিক অঙ্গীকার থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা; অত্যন্ত অযৌক্তিক অনুসিদ্ধান্ত।
ভারত সরকারের মুসলিম নীতি ঘৃণা ও বিদ্বেষের ওপর দাঁড়িয়ে। ফলে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার পর দিল্লির প্রত্যাশা ছিল, ঢাকা মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে কেবল ভারতের অঙ্গুলি হেলনে এর সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় নির্ধারণ করবে। কিন্তু স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধু মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন ও আইসিতে যোগ দেন। হিন্দুত্ববাদী পরিবেষ্টিত দিল্লির ক্ষমতাসীন কংগ্রেস বঙ্গবন্ধুর এই বিদেশনীতি পছন্দ করেনি। ফলে ভারতের বি' টিম বাংলাদেশের সক্রিয় হয়েছে। যুদ্ধাহত দেশ পুনর্গঠনে তারা পদে পদে বাধা দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার নীলনকশা করেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ট্যাংকের ওপর নেচেছে। আবার ২০০৮ সালে ভারতের রাজনীতিক প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশের সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদকে ঘোড়া উপহার দিয়ে; ভারতীয় উপনিবেশের সূচনা করলে; ভারতপন্থী শেখ হাসিনার মহাজোটে এসে নেচেছে ভারতের সেই বি' টিম।
১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে ব্রিটিশ স্থানীয় কোলাবরেটর পূর্ববঙ্গে জমিদারি লাভ করে তরমুজ ক্ষেত থেকে দালানে উঠে আসার পর; ইনফেরিয়রের যে সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স তৈরি হয়েছে; তাতে তারা কিছুতেই পূর্ববঙ্গের জমিদারির অহম ছাড়তে চায় না। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের নামে তারা সেই জমিদারি পুনরুদ্ধারে এসেছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু মুসলিম বিশ্বে বন্ধু খুঁজলে সেই অখণ্ড হিন্দু ভারতের আশা দুরাশা হয়ে যায়। তাই তো বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিলে প্রণব মুখার্জি তার স্থানীয় অভিভাবক হিসেবে আবার পূর্ববঙ্গের জমিদারি উদ্ধার প্রকল্প উদ্ধারে সক্রিয় হন; যা সফল হয় ২০০৮ সালে। কিন্তু একবিংশের মুক্তিপ্রবণ ছাত্রজনতা তা হতে দেয়নি। তারা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গেরুয়া উপনিবেশকে উচ্ছেদ করেছে।
বাংলাদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর দুর্ভাগ্য, তারা ব্রিটিশ কোলাবরেটর হিন্দু জমিদারদের দ্বারা শোষিত হয়ে; ভারতের অধীনস্থ হতে না চাওয়ায় ১৯৪৭ সালের আগে পকিস্তান সংকল্পের মুসলিম লীগকে ভোট দিয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সেই পশ্চিম পাকিস্তানের আধাখ্যাঁচড়া পাঞ্জাবি সামন্ত শেয়ালের রুদ্ররোষে পড়ে তারা; শুরু হয় তাদের শোষণ। বলাবাহুল্য এই পাঞ্জাবের সামন্ত শেয়াল ব্রিটিশদের স্থানীয় কোলাবরেটর ছিল। এদের শ্রেণিচরিত্র ব্রিটিশ কোলাবরেটর পূর্ববঙ্গের জমিদারদের মতোই। বঙ্গবন্ধু এই পাঞ্জাবি সামন্ত শেয়ালদের বিরুদ্ধে সতত সক্রিয় ছিলেন। যেমন ১৯৪৭ সালের আগে সক্রিয় ছিলেন পূর্ববঙ্গের সামন্ত শেয়ালদের বিরুদ্ধে। পূর্ববঙ্গে শেরে বাংলার কৃষক প্রজা আন্দোলন, ভাসানীর রাজনীতি; এসবই ছিল হিন্দু-মুসলমানের কৃত্রিম বিভাজন অস্বীকার করে ধনী-দরিদ্র্যের আসল বিভাজন দূর করতে সংগ্রামশীল হওয়া।
বাংলাদেশে যে ক'জন হিন্দুকে অখণ্ড ভারতের স্বপ্নক্লিষ্ট দেখি আমরা তার চেয়ে অনেক বেশিসংখ্যক মুসলমান অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে। অথচ ৫ আগস্টের পর ভারতীয় মিডিয়ার প্রোপাগান্ডার জবাব দিয়েছে বেশিসংখ্যক হিন্দু নাগরিক। তারা ব্যর্থ করে দিয়েছে দিল্লির ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশ সমাজের এই অন্তর্গত রসায়ন জানতেন বলেই বঙ্গবন্ধু সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকারের বাংলাদেশ চেয়েছিলেন।
ইতিহাসের কোনো চরিত্রই মহামানব নয়। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাস চর্চায় কাউকে হয় মহামানব অথবা মহাদানব প্রমাণের এক রৈখিক প্রচেষ্টা থাকে। ২০২৪-এর ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর অভ্যুত্থানের সুফল কুড়ানোর জন্য ইঁদুর দৌড়, নৈরাজ্য সৃষ্টি করে দ্রুত ধনী হওয়ার কলাকৈবল্য নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছি আমরা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর ঠিক এই ব্যাপারটিই ঘটেছিল। দ্রুত মুক্তিযুদ্ধের সুফল কুড়াতে মরিয়া হয়েছিল অনেকে। ওই যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পূর্ববঙ্গের জমিদার কিংবা পাঞ্জাবের জমিদার আমাদের জনমানসে দেশ লুণ্ঠন ও শোষণ করে জমিদার হবার স্বপ্ন পুঁতে দিয়েছে। এ কারণে আর্থিক দিক থেকে আমরা যতটা গরিব; মনের দিক থেকে তার চেয়ে বড় গরিব হয়ে পড়েছি।
তাইতো ‘আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি…’
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও শিক্ষক