শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

ব্যাংক ব্যবস্থার মধ্যে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য আছে

হাবীব ইমন
প্রকাশিত: ৩০ মে ২০২৩, ০৮:০৬ পিএম

শেয়ার করুন:

ব্যাংক ব্যবস্থার মধ্যে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য আছে

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহানের পেশাজীবন শুরু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে। এরপর কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ দায়িত্ব পালন করেছেন নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে। সংস্থাটির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের মূল লেখক টিমের অন্যতম সদস্য তিনি। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। স্বাধীনতার ৫২ বছরে এসে বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতিসহ নানা বিষয় নিয়ে ঢাকা মেইলের সঙ্গে কথা বলেছেন বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাবীব ইমন। আজ প্রকাশিত হলো সাক্ষাৎকারের চতুর্থ ও শেষ পর্ব।

ঢাকা মেইল : করোনা মহামারির তিন বছর ও ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের এক বছর পেরোল। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এ দুইয়ের প্রভাব কতটা?


বিজ্ঞাপন


সেলিম জাহান : একটা কথা প্রথমে বলা দরকার। ইতিবাচকভাবে বলি, যে কারণেই হোক, কোভিড উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতিকে যেভাবে প্রভাবিত করেছে- মানুষের মৃত্যুর কারণে, কর্মনিয়োজনের কারণে- বাংলাদেশে কিন্তু সেভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। মৃত্যুর সংখ্যা যদি বলি, তাহলে বিষয়টা দেখা যায়। আমাদের খুব আশঙ্কা ছিল যে এত জনবহুল একটি দেশে কোভিডের মতো এত বড় মহামারি ছড়িয়ে পড়লে কি অবস্থা হবে। আরেকটি কথা বলা দরকার, সে সময় প্রতিষেধক টিকা দেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার কিন্তু অত্যন্ত সফল হয়েছে। এখানে দ্বিমত প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই।

এটা বলার পরে আমার মনে হয় যে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ, কোভিডের যে ব্যাপারগুলো, সেটা অন্তত পাঁচটি দিক থেকে বাংলাদেশের দেখা দরকার। একটি দিক হচ্ছে, বিভিন্ন দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বৈশ্বিক দিক থেকে প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে পড়েছে, সেটা বাংলাদেশকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবে। এটা হয়তো এ বছর, আগামী বছর, তার পরের বছর একটা প্রভাব ফেলবে। এ ব্যাপারে আমাদেরকে নজরদারি রাখতে হবে।

প্রথম পর্ব: শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বৈষম্য বাড়ছে

এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলি, বিভিন্ন দেশে আমরা দেখতে পাচ্ছি খাদ্যের সংকট রয়েছে। তা কিছুটা অতিমারির কারণে, কিছুটা ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে। সুতরাং এ খাদ্য সংকট আগামীতে আমাদের অর্থনীতি, কৃষি, খাদ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সতর্ক করে দিয়েছেন।


বিজ্ঞাপন


দ্বিতীয়ত, আমরা জ্বালানি আমদানি করে থাকি। যেহেতু যুদ্ধের পর থেকে রাশিয়া থেকে গ্যাস ইউরোপে যাওয়ার ব্যাপারে নানারকম প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সুতরাং জ্বালানির বাজারে একটা সংকট আমরা এখনই দেখতে পাচ্ছি। জ্বালানি তেলের মূল্য ইতিমধ্যে বেড়ে গেছে। বাংলাদেশে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ কারণে হয়তো বিভিন্ন জায়গায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। কলকারখানায় বিদ্যুৎ সরবরাহ অনেকটা বিনষ্ট হয়েছে। এ জ্বালানি সংকট বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আমাদেরকে এ ব্যাপারে এখনই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।

তৃতীয়ত, মধ্যপ্রাচ্যেও ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ এবং অতিমারির প্রভাব পড়বে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি অনেকটা স্থবির হয়ে পড়বে। সেই জায়গায় আমার নিজের একটা শঙ্কা, কোনো একটা সময় এর প্রভাব বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানিতে পড়বে। আমাদের শ্রমিকরা যদি দেশে ফিরে আসতে শুরু করে তাহলে তা আমাদের অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলবে। একইসঙ্গে বিশ্বের অনেক দেশে প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। সেক্ষেত্রে পোশাক শিল্পের রফতানির ব্যাপারটিও খতিয়ে দেখা দরকার। কারণ পোশাক শিল্প এরইমধ্যে ব্যাহত হয়েছে, আরও ব্যাহত হতে পারে।

চতুর্থত, শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলতে হয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তো কোভিডের মধ্যে নানাভাবে ব্যাহত হয়েছে। বিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে কম্পিউটারের মাধ্যমে, তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বোঝা গেছে যে একেবারে গ্রামাঞ্চলে, একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিশু-কিশোরদের কাছে আমরা পৌঁছতে পারিনি। এই যে ফাঁকা জায়গায় আমি দাঁড়িয়ে আছি, ভবিষ্যতে শিক্ষাব্যবস্থা আমরা কি করে করব? যদি তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে করতে হয়, তাহলে কেমন করে করব বা গত তিন বছরে শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষতি হয়েছে, সেটা কিভাবে পুষিয়ে নেব, আমাদেরকে সে ব্যাপারে চিন্তা করা দরকার।

দ্বিতীয় পর্ব: পুরো একটা প্রজন্মকে ভুল শিক্ষা দিয়ে বিভ্রান্ত করা হয়েছে

শেষ এবং পঞ্চম কথা হচ্ছে, আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এ জাতীয় মহামারি কিভাবে মোকাবিলা করবে, সেটা তারা ঠিক বুঝতে পারেনি। আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় নানা রকমের ফাঁক রয়ে গেছে, নানা রকমের দুর্বলতা রয়ে গেছে। অন্তর্নিহিত বহু দুর্বলতা রয়েছে। এখন একটা সুযোগ আছে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মূল্যায়ন করে এটাকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর যাতে শুধুমাত্র অতিমারি-মহামারি মোকাবিলা করতে পারি। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্যব্যবস্থ্যায় একধরনের গতিময়তা, একধরনের টেকসই ব্যবস্থা নেওয়া, যাতে আমাদের স্বাস্থ্য চাহিদা, সুবিধাগুলোকে আরও শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পারি।

সুতরাং এ পাঁচটি দিক থেকে আমি মনে করি আমাদের অর্থনীতি ও জনজীবনে প্রভাব পড়েছে, আগামীতে আরও প্রভাব পড়বে।

ঢাকা মেইল : বাংলাদেশের অর্থনীতি একটা সংকটকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ সংকটের পেছনে এ দুইয়ের প্রভাব, নাকি অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাপনার দায় দেখছেন?

সেলিম জাহান : আমি বলব না যে বাংলাদেশের অর্থনীতি সংকটের মধ্যে আছে। এ মুহূর্তে বাংলাদেশ কিছু অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্যে আছে। অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে শ্রীলঙ্কা আছে। আমি মনে করি না যে বাংলাদেশ সে জায়গায় যাচ্ছে। যদি বৈদেশিক মুদ্রার কথাও বলি, অনেকে বলছে, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ক্ষেত্রে নানারকম সমস্যা দেখা দিচ্ছে, এটা সঠিক। কেননা আমদানির ক্ষেত্রে, তেল রফতানির ক্ষেত্রে খরচ করা হচ্ছে, সেখানে আমাদের একটা টান রয়ে গেছে। এটা মানে এই নয় যে, একটা সংকট রয়ে গেছে।

এখন আমরা যদি বলি যে, অর্থনৈতিক সমস্যা যেগুলো আছে, এগুলোর কারণ কি শুধুমাত্র মহামারি, শুধুমাত্র ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের সংকট? আমি বলব, না। আমি মনে করি, বাংলাদেশের অর্থনীতির মধ্যে নানা রকম সংস্কার প্রয়োজন। যেমন আমাদের রাজস্ব ব্যবস্থায়, কর ব্যবস্থায় সংস্কার প্রয়োজন। আমাদের রাজস্ব ব্যবস্থা খুব দুর্বল। আমাদের মোট রাজস্ব আয় অনেক দেশের তুলনায় কম। এখন রাজস্ব ব্যবস্থায় একটা সংস্কার করতে গেলে নানা গোষ্ঠী আছে, সেখানে তারা বাধা দেবে। তারা সুবিধাভোগী গোষ্ঠী। রাজস্ব ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত যে সমস্যা-সংকট রয়েছে, সেগুলো দূর করা দরকার।

তৃতীয় পর্ব: টেকসই ও সুষম উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্র প্রয়োজন

দ্বিতীয়ত, আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় অনেক রকমের সমস্যা রয়েছে। এখন পর্যন্ত যে উপাত্ত রয়েছে সেগুলোকে ঠিকভাবে ব্যবহার করে অর্থনৈতিক নীতিমালা গ্রহণ করা দরকার। অনেক সময় অর্থনৈতিক পরিকল্পনার নীতিমালা, আর যে জাতীয় পরিকল্পনা আমরা গ্রহণ করছি, তার মধ্যে বিরাট ফাঁক থেকে যায়। সেক্ষেত্রে আমাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় একটা সংস্কার দরকার। এটা আরও বেশি প্রয়োজন, কারণ, আমরা দেখতে পাচ্ছি যুক্তরাষ্ট্রের তিনটা ব্যাংকে ধস নেমেছে। যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করছে এগুলোকে প্রাণপণে টিকিয়ে রাখার জন্য। একটা পর্যায়ে বৈশ্বিকভাবে অর্থনৈতিক দিক থেকে নেতিবাচক প্রভাব দেখা দেয়। তখন আমাদের দেশেও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সে প্রভাব দেখা দেবে। কাজেই আর্থিক সংস্কার আমাদের প্রয়োজন।

একটা কথা বলি, এ জাতীয় সংস্কার যখন দাতাগোষ্ঠী, আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী এসে চাপ দেয়, তখন আমরা নিতে চেষ্টা করি। আমরা আগে থেকে কেন নেব না? আমরা আগে থেকে যদি নজরদারি করে, খবরদারি করে এ জাতীয় সংস্কারের উদ্যোগ নিই, তাহলে দাতাগোষ্ঠীর সদয় উপদেশ থেকে আমরা বাঁচতে পারি। বাংলাদেশ আজ যেখানে পৌঁছেছে, সেখানে তার নিজের অর্থায়নে, নিজের সম্পদে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালাতে পারে। সত্যিকার অর্থে বিভিন্নভাবে দাতাগোষ্ঠী আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে। আমার মনে হয় এটা বন্ধ করা দরকার। তারা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ না করলেও অন্তত তারা প্রত্যক্ষভাবে উপদেশ বিলানোর ক্ষেত্রে পিছপা নয়। দাতাগোষ্ঠীকে মনে রাখা দরকার, তারা আমাদের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সহায়ক মাত্র। উন্নয়ন প্রক্রিয়ার চালক তারা নয়। বাংলাদেশ এ অবস্থা পেরিয়ে এসেছে অনেক আগে। যে কথাটি বলছিলাম, কতগুলো সংস্কার আমাদের প্রয়োজন। সংস্কারের অভাবে বহু সমস্যা হচ্ছে। দাতারা এসে বলবে তখন আমরা করব, এটা একটা ভুল নীতি। এখন থেকে আমরা সংস্কার গ্রহণ করা দরকার।

ঢাকা মেইল : বিশ্ব বাজারে মন্দার পূর্বাভাস দেখা যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে বিশ্ব অর্থনীতি কোন পথে চলছে?

সেলিম জাহান : বিশ্ব অর্থনীতিতে চালক না হলেও এর ওপর বিরাট প্রভাব ফেলে দুটো দেশ- যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। প্রবৃদ্ধি অনেকটাই এগিয়ে যায় চীনের প্রবৃদ্ধির কারণে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি একটা নাজুক অবস্থায় আছে। কারণ ব্যাংক ব্যবস্থায় ধস নেমেছে। যতখানি শক্তভাবে অর্থনীতির ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, সেভাবে হচ্ছে না। এখন কোনো প্রাক্কলন বড় দুরূহ। কেননা ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে কি হবে শেষ পর্যন্ত, আমরা এখনও বুঝতে পারছি না।

যুদ্ধ তো চলছে, নানাভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বিশ্ব বাজারে আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিভিন্ন জিনিসের দাম বেড়ে যাচ্ছে, মূল্যস্ফীতি বিভিন্ন দেশে বেশ বেড়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ১১ শতাংশ, যুক্তরাজ্য ১৩ শতাংশের ওপরে। মূল্যস্ফীতি যদি বেড়ে যায়, তাহলে বিশ্ব অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সেই সঙ্গে খাদ্যেরও একটা সংকট দেখা দিতে পারে। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক খাদ্য সংস্থা থেকে বলা হয়েছে, সাহারা অঞ্চলে অর্থাৎ আফ্রিকা অঞ্চলে প্রায় ১৩০ কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষের শিকার হতে পারে। বিশ্ব অর্থনীতিতে আগামীতে খাদ্যের যে সংকট, সেটাও সামাল দিতে হবে।

এই অবস্থায় আগামী দুই-তিন বছরে বিশ্ব অর্থনীতি মোটামুটিভাবে একটা মন্দা প্রবৃদ্ধির মধ্যে কিংবা ফাঁদের মধ্যে পড়ে যেতে পারে। পৃথিবীর সবকটি দেশ যেহেতু অতিমারির শিকার হয়েছে, সেক্ষেত্রে পরস্পরকে সাহায্য করা বা পরস্পরের ওপর নির্ভর করা, এ ব্যাপারটি আস্তে আস্তে দূরে সরে যাবে। ফলে প্রত্যেকটি অর্থনীতি তার নিজের ঘর সামলাতে, তার নিজের ব্যবস্থা সামলাতে ব্যস্ত থাকবে। এ জাতীয় ব্যস্ততার কারণে অন্যকে সাহায্য করা, অন্যকে দেখার বদলে নিজের স্বার্থ দেখাকে সমীচীন মনে করবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আগামী দুই-তিন বছর শ্লথ প্রবৃদ্ধি দেখা যাবে, খাদ্য সংকটও দেখা দিতে পারে। জ্বালানি সংকটের কারণে নানাভাবে অর্থনীতিতে বিভাজন হতে পারে। শেষ পর্যন্ত এক ধরনের অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ আবার নতুন করে জানান দিতে পারে।

ঢাকা মেইল : বাংলাদেশ কিভাবে এ মন্দা মোকাবিলা করতে পারে?

সেলিম জাহান : বাংলাদেশ নানাভাবে মোকাবিলা করতে পারে। একটা হলো, খাদ্য সংকট এড়াতে হলে আমাদের উৎপাদন বাড়ানো দরকার। বণ্টন ব্যবস্থাও অন্যরকমের হওয়া দরকার। এটা যে সবসময় উৎপাদনের সমস্যা তা নয়, বণ্টনেরও সমস্যা। এখন পর্যন্ত সংকটের মধ্যে আমরা সেভাবে পড়িনি, সমস্যার মধ্যে আছি। আমরা জানি যে দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেছে, এটা পুরোটা যে রোজার কারণে, তা নয়। সরবরাহের কারণে, অর্থনীতির চালিকা শক্তি যেগুলো আছে, প্রক্রিয়া আছে, তার কারণে। সুতরাং আমাদের উৎপাদন বাড়াতে হবে।

বৈদেশিক মুদ্রা বাড়াতে হলে রফতানি বাড়াতে হবে, আমদানি ক্ষেত্রে আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে। রফতানি বিষয়ে আরেকটু সংস্কার করা দরকার। এই চিন্তাভাবনা এখনই করা দরকার। আরেকটা কথা মনে রাখতে হবে যে বাংলাদেশ তো স্বল্পোন্নত দেশগুলোর উপরে চলে আসছে, ২০২৭ সাল নাগাদ চলে আসবেও। সেটা যদি হয় তখন বাংলাদেশ অনেক সুযোগ হারাবে। যেমন বিনাশর্তে বা অল্প সুদে যে ঋণ, সেটা সে পাবে না। রফতানির ক্ষেত্রে যে ছাড় স্বল্পোন্নত দেশগুলো পায়, সেগুলো বাংলাদেশ পাবে না। সুতরাং সে অবস্থা বিবেচনা করে অর্থনীতিকে মজবুত করতে সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কি ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যায়, আগে থেকে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। যে সংস্কারগুলোর কথা বলছি, সেগুলো করা দরকার, তা না হলে আমাদের আর্থিক দুর্বলতা কাটবে না। তাহলে আগামীতে যে জাতীয় উন্নয়ন আমরা চাই, সেটা পাব না।

ঢাকা মেইল : সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমে উঠে এসেছে- ব্যাংকগুলোর ওপর মধ্যবিত্ত শ্রেণি আস্থা রাখতে পারছে না। সেই জায়গায় তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন?

সেলিম জাহান : খুব স্বাভাবিকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংকের একটা ভূমিকা আছে। কারণ জনগণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক কি করছে তার উপর অনেকখানি নির্ভর করে। সব দেশেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক ধরনের স্বাধীনতা ভোগ করে। কিন্তু বাংলাদেশে বহুক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব কর্মকাণ্ড করে থাকে সেগুলো অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে। এটা একদমই ঠিক নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আসল কাজ মুদ্রানীতি গ্রহণ করা, সে মুদ্রানীতিতে কতখানি সুদের হার হবে, কোথায় বিভিন্ন সঞ্চয়, বিভিন্ন ঋণ দেওয়া হবে, সেসব ব্যাপার ঠিক করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কাজ।

এখন আস্থাহীনতার কথা এসেছে। আস্থাহীনতা কোথায় থেকে আসে? আস্থাহীনতা আসে যখন ব্যাংকের কর্মকাণ্ডের ভেতর এমন কিছু জিনিস ঘটছে, যেমন সাধারণ মানুষের যে সঞ্চয়, সেটা নিয়ে খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে না, তখনই মানুষ টাকা তুলে ফেলে। এ ব্যাপার কখন আসে? যখন আপনি দেখবেন যে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বা ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় নানা রকমের বিশৃঙ্খলা চলছে। কোটি কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা চলে যাচ্ছে বলে বলা হচ্ছে- এ জাতীয় ব্যবস্থা যখন চলে, নৈরাজ্য যখন চলে, তখন স্বাভাবিকভাবেই মধ্যবিত্ত শ্রেণি বা সাধারণ মানুষ যারা সঞ্চয় করেন তারা কিন্তু পুরো ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন। এ আস্থা ফেরত আনার ব্যাপারে আমার মনে হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটা জোরালো ভূমিকা রয়েছে।

সেই সঙ্গে মনে রাখতে হবে বাংলাদেশে যে পরিমাণ ব্যাংক আছে সেটার প্রয়োজন আছে কিনা। এখন ব্যাংক স্থাপন করা জনগণকে আর্থিক সুবিধার কারণে নয়। বহু ক্ষেত্রে ব্যাংক স্থাপন করা হচ্ছে, যারা স্থাপন করছেন, তারা আর্থিক সুবিধা পাবেন। অতএব একটা ব্যাংক স্থাপন করে যারা পরিচালক তারাই ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন এবং অনেক টাকার ঋণ নিচ্ছেন। একটা ব্যাংক স্থাপন করে সেখানে নানারকম অনিয়ম করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ হচ্ছে খবরদারি করা। যখন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে, সে ব্যাংকটির চালানোর মতো ক্ষমতা বা তাদের উদ্দেশ্য কি, তাদের উদ্দেশ্য গ্রাহকদের আর্থিক সুবিধা দেওয়া কিনা, অথবা আমাদের গ্রামাঞ্চলে কতগুলো শাখা থাকবে, সেগুলো নির্ধারণ করা। এ জাতীয় প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীন ব্যবস্থাপনা বা স্বাধীনভাবে তাদের কার্যকলাপ করতে না পারে তাহলে পুরো ব্যাংকিং খাতে এক ধরনের নাজুকতা বিরাজ করবে। সেটার কারণে জনগণের মধ্যে এক ধরনের অনাস্থা সৃষ্টি হয়। জনগণ তখন তাদের সঞ্চয় তুলে নেয়, ব্যাংকের ওপর তারা আস্থা রাখতে পারে না।

আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে ব্যাংক ব্যবস্থার মধ্যে এক ধরনের লাল ফিতার দৌরাত্ম্য আছে, এত নিয়মকানুন, সুবিধাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে এত অভিযোগ। সঞ্চয় আনতে হলে একটা অনুপ্রাণিত ব্যবস্থা থাকতে হবে, যত সহজ করা যায়। কিন্তু তা না করে পুরো ব্যবস্থাটা জটিল করে রাখা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি এসব ব্যাপার না দেখে তাহলে ব্যাংকিং খাতে নাজুক অবস্থা সবসময় বিরাজ করবে।

ঢাকা মেইল : একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে এবারের বাজেট কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন?

সেলিম জাহান : জাতীয় নির্বাচন সামনে। তাই এবারের বাজেট নির্বাচন অভিমুখী হবে বলে আমি ধারণা করছি। অর্থাৎ এখানে বরাদ্দ, সম্পদের সঞ্চালন এমনভাবে হবে যাতে বিশেষ গোষ্ঠী, বিশেষ শ্রেণি অনুপ্রাণিত হয়। নির্বাচনের বাইরে যদি আমরা যাই, দ্রব্যমূল্য যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, বৈষম্য বাড়ছে, সেগুলোকে যদি সামনে রাখা হয় তাহলে বাজেটের চরিত্র অনেক রকম হতে পারে।

মনে রাখা দরকার এটা বৈশ্বিকভাবে কোভিড পরবর্তী প্রথম বাজেট। গত বছর যখন বাজেট দেওয়া হয় তখনও কোভিডের একটা প্রভাব ছিল। কোভিড পরবর্তী এ বাজেটে খাদ্য-জ্বালানির ব্যাপারগুলোতে প্রাধান্য দেওয়া দরকার। মূল্যস্ফীতি কিভাবে ঠিক রাখা যায়, এ বাজেটে তারও প্রতিফলন থাকা দরকার। বাজেট কেবল এক বছরের আয়-ব্যয়ের ব্যাপার নয়। বাজেট দীর্ঘমেয়াদি নির্দেশনার একটা খণ্ড। প্রতিটি বাজেটই এমনভাবে করা উচিত যাতে দীর্ঘমেয়াদি যে লক্ষ্য আছে, যে উদ্দেশ্য আছে, সেদিকে অগ্রসর হওয়া যায়। আমরা আশাবাদী যে এবারের বাজেটে বেশকিছু দিকনির্দেশনা থাকবে। কিন্তু একটা অস্থির সময় এবং বেশকিছু সমস্যা সামনে রেখে বাজেট প্রণীত হচ্ছে। সেক্ষেত্রে কতটা নজর দেওয়া হবে, সে ব্যাপারে সংশয় আছে।

/জেএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর