বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

টেকসই ও সুষম উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্র প্রয়োজন

ঢাকা মেইল ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৯ মে ২০২৩, ০৮:৫৩ পিএম

শেয়ার করুন:

টেকসই ও সুষম উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্র প্রয়োজন

অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান। তাঁর পেশাজীবন শুরু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে। এরপর কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ দায়িত্ব পালন করেছেন নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে। সংস্থাটির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের মূল লেখক টিমের অন্যতম সদস্য তিনি। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। সম্প্রতি দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতিসহ নানা বিষয় নিয়ে ঢাকা মেইলের সঙ্গে কথা বলেছেন বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাবীব ইমন। আজ প্রকাশিত হলো সাক্ষাৎকারের তৃতীয় পর্ব। 

ঢাকা মেইল : গণতন্ত্রের সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক কি?


বিজ্ঞাপন


সেলিম জাহান : গণতন্ত্র এমন একটি ব্যাপার যা তার নিজস্ব গুণে মূল্যবান। সরদার ফজলুল করিম একবার বলেছিলেন, গণতন্ত্র মানে হচ্ছে গণতন্ত্রের জন্য নিরন্তর সংগ্রাম। ভারি সুন্দর কথাটা। সুতরাং গণতন্ত্রের একটা অন্তর্নিহিত মূল্য আছে। গণতন্ত্র উন্নয়নকে সাহায্য করে কিংবা সাহায্য করে না- আমরা মতে সেটা গণতন্ত্রের মূল্যায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ না। গণতন্ত্র যদি উন্নয়নকে ইতিবাচকভাবে সাহায্য করে, সেটা আমাদের বাড়তি পাওনা। আমি মনে করি না যে উন্নয়নে গণতন্ত্র কতখানি অবদান রাখলো, উন্নয়নের ক্ষেত্রে গণতন্ত্র কতখানি সাহায্য করলো, সেজন্য গণতন্ত্র মূল্যবান। গণতন্ত্র তার নিজস্ব অন্তর্নিহিত মূল্যের জন্য মূল্যবান।

প্রথম পর্ব >> শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বৈষম্য বাড়ছে

এরপরও উন্নয়নের ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের একটা ভূমিকা আছে। ভূমিকাটি এরকম- আমরা যদি সুষম উন্নয়ন চাই, আমরা যদি বৈষম্যবিহীন উন্নয়ন চাই, তাহলে বিভিন্ন ব্যক্তি, বিভিন্ন গোষ্ঠীর অংশগ্রহণ খুব দরকার। সেটা না হলে উন্নয়ন কখনও সুষম হবে না। একটা অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আমরা হয়তো অগ্রগতি অর্জন করব, যেটা বিভিন্ন রাষ্ট্রে হয়েছে, তার সুফল সবার কাছে সমানভাবে যাবে না। অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যে উন্নয়ন হবে, সে উন্নয়ন কখনও টেকসই হবে না। টেকসই হবে না বলে সে উন্নয়নের মাঝে অনেকরকম ফাঁক থেকে যাবে। যেমন দেখা যাবে উন্নয়ন হবে, কিন্তু সুষম উন্নয়ন নয়, তাহলে সে উন্নয়নের মাঝখানে আমরা দেখতে পাব দুর্ভিক্ষও হচ্ছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উন্নয়ন হলে যদি সেখানে খাদ্যের ঘাটতিও থাকে, সেটা সম্পর্কে কথা বলা যাবে, সেটা নিয়ে আলোচনা করা যাবে, সেটাকে উৎরানোর একটা ব্যবস্থা থাকবে।

আমি মনে করি, গণতন্ত্রের সঙ্গে একেবারে অন্তর্নিহিতভাবে উন্নয়নের কি সম্পর্ক, সেই জায়গায় না যাওয়াই ভালো। কিন্তু উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্র অত্যন্ত দরকার। কিন্তু যদি টেকসই উন্নয়ন আমরা চাই, সুষম উন্নয়ন যদি চাই, তাহলে গণতন্ত্রের একটা ভূমিকা রয়েছে। আমরা দেখেছি যে একনায়কোচিত রাষ্ট্রে উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু উন্নয়ন পরবর্তী সময়ে টেকেনি। কারণ তাকে একটা গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে দাঁড় করানো যায়নি, একটা জনগণ-নির্ভর উন্নয়ন করা যায়নি, সবার কণ্ঠস্বর সমানভাবে শোনা যায়নি, সে উন্নয়নে সম্পদের বণ্টন সুষম হয়নি। সুতরাং সেদিক থেকে গণতন্ত্র উন্নয়নে অত্যন্ত মূল্যবান।


বিজ্ঞাপন


ঢাকা মেইল : উন্নয়নের রাজনীতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা কি?

সেলিম জাহান : সত্যিকারের উন্নয়নের রাজনীতিতে উন্নয়নের ধারা ও রাজনীতি দুটোই জনকল্যাণমুখী হতে হবে। সে কাঠামোতে জনগণই উন্নয়নের লক্ষ্য ও কর্মকাণ্ডের মূলবিন্দুতে থাকবে। সে উন্নয়ন হবে জনগণের উন্নয়ন, জনগণের জন্য উন্নয়ন ও জনগণের দ্বারা উন্নয়ন। জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র তখনই হতে পারে যখন জনগণের কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ প্রতিনিধিরা রাষ্ট্র কাঠামোর হাল ধরে থাকেন।

ঢাকা মেইল : গণতন্ত্রের একটা অন্যতম শর্ত হচ্ছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। গত কয়েক বছরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে মতপ্রকাশের সেই স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কি?

সেলিম জাহান : আমরা যখন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলছি, সেখানে কয়েকটা কথা আমাদের প্রথমেই মনে রাখা দরকার। একটা হচ্ছে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কতগুলো পরিসীমা থাকা দরকার। যেমন- আমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কিন্তু চূড়ান্ত না। এ অর্থে যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ব্যবহার করে আমি কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে পারব না। অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারব না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ব্যবহার করে আমি এমন কিছু করতে পারব না যেটা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত করে। এই পরিসীমাগুলো আমাদের মেনে নিয়ে কথা বলতে হবে।

আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ল্যাটিন আমেরিকার বহু দেশে যেখানে স্বৈরতন্ত্র আছে, সেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কিভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায়, সেখানে কিভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমি মনে করি বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে, আবার কোনো কোনো মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছে। এখন এ ব্যাপারটি ভালোভাবে মূল্যায়ন করা দরকার। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে, সেই সঙ্গে তথ্যেরও একটা স্বাধীনতার ব্যাপার আছে। তথ্যের অধিকার আমাদের থাকতে হবে। অনেক সময় সাংবাদিকরা বা আমরা নিজেরাও যখন মতপ্রকাশ করি, তথ্যভিত্তিক করি না। অনেকটা আবেগভিত্তিক করে ফেলি। অনেকটা চমকপ্রদ করার ব্যাপার হাজির করি। সুতরাং আমি মনে করি মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সেসব দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা দরকার, যেটা বস্তুনিষ্ঠ, যেটা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিসীমা মেনে চলে, যেটা কখনোই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন না করে, এটা হচ্ছে প্রথম কথা।

দ্বিতীয় পর্ব>> পুরো একটা প্রজন্মকে ভুল শিক্ষা দিয়ে বিভ্রান্ত করা হয়েছে

দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, যেসব উদাহরণ, যেসব দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে, সেগুলো মূল্যায়ন করা দরকার। এগুলোর তদন্ত যদি না করি, যেসব আইন আছে সেগুলোর অপব্যবহার যদি বিভিন্ন পেশার কাজে বিঘ্ন ঘটায়, তাহলে রাষ্ট্রের উচিত তা খতিয়ে দেখা। কারণ দুটো ঘটনা হচ্ছে, পাঁচটি ঘটনা হচ্ছে, সাতটি ঘটনা হচ্ছে- প্রত্যেকটি ঘটনাই মূল্যবান। অনেকে বলবে যে এরকম পাঁচটা ঘটনা ঘটেছে, এর বেশি তো হয়নি। মনে রাখতে হবে, আজকে পাঁচটা ঘটনা হলে কাল আরও বাড়বে। আমার মনে হয়, সেদিক থেকে মতপ্রকাশে স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা হওয়া দরকার।

ঢাকা মেইল : বাংলাদেশে উন্নয়ন হচ্ছে। অন্যদিকে বৈষম্যও বাড়ছে। এই বিপরীতমুখী দুটি প্রবণতার কারণে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা তৈরি হওয়ার কোনো আশঙ্কা কি আপনি করেন?

সেলিম জাহান : সত্যি কথা যদি বলি, অসমতা যদি আরও বেড়ে যায়, অসমতার ফারাক যদি আরও বেড়ে যায়, একটা সময় এ অসমতা আর সহনীয় পর্যায়ে থাকবে না। যদি সহনীয় পর্যায়ে না থাকে খুব স্বাভাবিকভাবে যারা দরিদ্র শ্রেণি, যারা বঞ্চিত শ্রেণি, তারা কিন্তু এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে। তখনই দেখা দেবে সামাজিক বিশৃঙ্খলা।

সবসময় মনে রাখতে হবে, বৈষম্য যদি থাকে তাহলে অর্থনীতির যে উন্নয়ন সেটাও কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে ব্যাহত হবে। কারণ বৈষম্য মানে একটা শ্রেণি উন্নয়নে অংশগ্রহণ করতে পারছে না। উন্নয়নের যে সুফল তারা সেটা ভোগ করতে পারছে না। স্বাভাবিকভাবেই, উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় যে ধরনের গতিময়তায় সবাই অংশগ্রহণ করতে পারতো, সেটা কিন্তু হবে না। সুতরাং একদিকে উন্নয়ন ব্যাহত হবে, যে উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি হার আমরা এখন পর্যন্ত বজায় রাখছি, সেটা ব্যাহত হবে। টেকসই উন্নয়ন হবে না, কারণ বঞ্চনা যখন বাড়ে, বঞ্চিত মানুষেরা পরিবেশ নষ্ট করবে। বঞ্চনা ও অসাম্য যদি অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছায়, তাহলে সামাজিক আন্দোলনে বিশৃঙ্খলা-অস্থিরতা হবে, যেটা রাজনীতিতেও বিরূপ প্রভাব ফেলবে। সেটা কিন্তু আমাদের জন্য সুখকর-স্বস্তিকর কোনো ব্যাপার নয়।

ঢাকা মেইল : মুক্তিযুদ্ধের যে আকাঙ্ক্ষা কিংবা মুক্তিযুদ্ধের যে চার মূলনীতি, সে জায়গা থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি। ওই জায়গায় ফিরে আসার পথটা কি?

সেলিম জাহান : ওই জায়গায় ফিরতে পারব কিনা আমার নিজের সন্দেহ আছে। সমাজতন্ত্র বা সামাজিক ন্যায্যতার কথা যদি বলি ওই জায়গায় আমরা আর ফিরতে পারব না। কারণ বিভাজন অর্থনৈতিক দিক থেকে হয়ে গেছে। অর্থনীতির একটা প্রক্রিয়া ও ব্যাপার রয়েছে, সেটা হচ্ছে আমরা কোথায় যেতে চাই। আমরা কোথা থেকে এসেছি- এই প্রশ্ন কেউ করে না। আমি কোথায় যাব, অর্থনৈতিক দিক থেকে কতখানি লাভ করতে পারব, সেদিকে আমরা যাচ্ছি। অন্য যে মূল্যবোধ, যে চেতনাগুলো আছে, ক্রমান্বয়ে সেগুলোতে অবক্ষয় হয়েছে। সেটাতে কবে ফেরত আসব, আদৌ ফেরত আসতে পারব কিনা- এটা একটা বড় প্রশ্ন। আমার নিজের ধারণা, ওইখানে বোধহয় আমরা আর ফিরে আসতে পারব না।

ঢাকা মেইল : সংস্কৃতিতে রুচির দুর্ভিক্ষ আর রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন- এ আলোচনা এখন হরহামেশা হচ্ছে। এ দুটো বিষয় আপনি কিভাবে দেখছেন?

সেলিম জাহান : আমার মনে হয়, সংস্কৃতিতে রুচির দুর্ভিক্ষ- এ কথাটা প্রথমে বলেছিলেন জয়নুল আবেদীন। ষাটের বা সত্তর দশকের কথা এটা। রুচির ব্যাপারটি অনেকটা ব্যক্তিগত। আবার রুচির মাধ্যমে আমরা গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করতে পারি। যেমন- আমরা বলি বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের রুচি- সেটা এক ধরনের গোষ্ঠী রুচি। আবার যদি বলি গ্রামীণ মানুষের রুচি, সেটা ভিন্ন ধরনের। যদি বলি, যারা বিত্তবান, পাশ্চাত্যের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, তাদের রুচিও আলাদা।

এখন রুচির দুর্ভিক্ষের কথা শিল্পাচার্য বলে গেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে নাট্যকার মামুনুর রশিদ একই কথা বলেছেন। দুর্ভিক্ষের কথা বলতে গেলে রুচির একটা মানদণ্ড আমরা ঠিক করে দিয়েছি, সেই মানদণ্ড থেকে যখন রুচি বহুদূরে চলে যায়, তখন আমরা মনে করতে পারি রুচির দুর্ভিক্ষ না হলেও রুচির একটা ঘাটতি সেখানে রয়ে গেছে। সেই অর্থে মধ্যবিত্ত বাঙালির যে রুচি নানাভাবে তার পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। এ পরিবর্তন বৈশ্বায়নের কারণে হয়েছে, এ পরিবর্তন তথ্যপ্রযুক্তির কারণে হয়েছে।

যেমন বইপড়ার ক্ষেত্রে রুচির একটা দুর্ভিক্ষ দেখা যাচ্ছে। বেশিরভাগ মানুষ এখন বই পড়ে না, হয়তো মুঠোফোনের মধ্যে তারা আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। ব্যাপারটা হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গির। তবে রুচির যথেষ্ট ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে।

আর রাজনীতিতে দুর্বৃত্তদের অংশগ্রহণ বাড়ছে, সেটা তো হয়েছেই। আগেই বলেছি, রাজনীতিতে যে সহনশীলতা, পরিপক্কতা, পরমত সহিষ্ণুতার প্রয়োজন ছিল সেটা আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। বরং সংঘর্ষ, সহিংসতা, সন্ত্রাস দিয়ে রাজনীতিটাকে সামনে নিয়ে এসেছি। সন্ত্রাস যদি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার উপকরণ হয়, সহিংসতা যদি সেখানে গেঁড়ে বসে, তখন স্বাভাবিকভাবেই দুবৃর্ত্তদের ওপর রাজনীতিকে নির্ভর করতে হবে। সে জায়গাতে আমি মনে করি রাজনীতিতে দুর্বৃত্তদের হামলা বেড়ে গেছে, তারাই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বড় খুঁটি হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনগণের জন্য রাজনীতির তো একটা ইতিবাচক ভূমিকা আছে। সেটা থেকে জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই জনগণ রাজনীতি থেকে বহুদূরে থাকছে। তাদের নিরাপত্তার জন্যও থাকছে, আর রাজনীতি দিয়ে কিছু হবে না- এরকম ভাবনা তাদের মধ্যে চলে আসছে।

ঢাকা মেইল : সাম্প্রতিককালে সরকারি সংস্থা বলছে- বেকারের সংখ্যা কমছে। আবার বেসরকারি কয়েকটি সংস্থা বলছে, কমছে না বরং বাড়ছে। পরস্পরবিরোধী পরিসংখ্যানকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

সেলিম জাহান : পরিসংখ্যানের জায়গায় সবসময় এক ধরনের মতানৈক্য থাকেই। বেকারের সমস্যা বাড়ছে কিংবা কমছে- এ জাতীয় পরিসংখ্যান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময় বলছে। আমার মনে হয় যে জিনিসটা মাথায় রাখা প্রয়োজন, পুরো শ্রমবাজার তো বদলে যাচ্ছে, সেটা বিভিন্নভাবে বদলে যাচ্ছে। যেমন- যেসব সেবা আগে ছিল না, এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি। এই যে পাঠাও, উবার, ফুডপাণ্ডা- এসব সেবা তো আগে ছিল না। নতুন করে হচ্ছে। সুতরাং নতুন শ্রমবাজার গড়ে উঠছে। মানুষের কাজের ধরন বদলে যাচ্ছে। তরুণরা এখন তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে কাজ করতে পারছে।

এ কথাগুলো বলার কারণ, বেকারের সংখ্যা কমছে না বাড়ছে, সেটা একমাত্র নির্ণায়ক নয়। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, এ পরিবর্তিত শ্রমবাজারে আমাদের তরুণরা কি করছে, তার দিকে নজর দেওয়া দরকার। তাদেরকে সেই স্পেস, সেই মাধ্যমগুলো দেওয়া দরকার। যারা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে তাদের জন্য পরিবর্তিত এ শ্রমবাজার সমস্যা করবে না। কিন্তু যারা সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত কিংবা শিক্ষার বাইরে আছে, এদের সংখ্যা খুব বেশি। তাদেরকে কিভাবে এ শ্রমবাজারে নিয়োজিত করব, এ ভাবনাটা দরকার। অনেক দেশেই সেভাবে শ্রমবাজার নীতি তৈরি করেছে। আমাদেরকেও তা করতে হবে।

ধরেন, আমাদের কৃষি ব্যবস্থাকে সংস্কার করা যায়, আধুনিক করা যায়। কৃষিকে যদি মুনাফার দিকে আরও ইতিবাচক করা হয় তাহলে অনেক তরুণ কৃষিতে কাজ করার জন্য অনুপ্রাণিত হবে। সুতরাং যদি গ্রাম পর্যায়ে কাজের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করা যায়, তাহলে বেকারের যে সংখ্যাটি আমরা বলছি, তাদেরকে ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারব।

দ্বিতীয়ত, নতুন নতুন ক্ষেত্র আছে যেগুলোতে তরুণদের কাজে লাগানো যেতে পারে। যেমন- প্রকাশনা শিল্প। বাংলাদেশের এ শিল্পটা অনেক উন্নত, এটা ছাপার দিক থেকে হোক, বইয়ের বাঁধাইয়ের দিক থেকে হোক। পশ্চিমা অনেক প্রকাশনা সংস্থা নিজেরা এখন বই ছাপে না, তারা পাণ্ডুলিপি সোজা সিঙ্গাপুরে পাঠিয়ে দেয়। এখন তো পাঠাতে সময় লাগে না, ইমেইলে সহজে পাঠানো যায়। সিঙ্গাপুর পুরো প্রসেস করে বইটা ছাপে। এ কাজটা কিন্তু বাংলাদেশে আসতে পারে। এটা কেউ খেয়াল করছে না, এ কাজটা আসলে কোটি কোটি ডলার বাংলাদেশ আয় করতে পারে।

বাংলাদেশকে অপ্রথাগত (নন-ট্র্যাডিশনাল) কাজগুলোর কথা ভাবতে হবে। শুধু পোশাক রফতানি করব, জনশক্তি রফতানি করব- সেটা করলে আর চলবে না। কারণ বিশ্বের শ্রমবাজার বদলে গেছে। অতএব বেকারের সংখ্যার চাইতে বেকারের প্রকৃতি কি, কারা বেকার, সামাজিকভাবে তারা কি অবস্থায় আছে, যদি এগুলো সামনে রেখে একটা নীতিমালা করতে পারি, তাহলে আমাদের তরুণদেরকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগাতে পারি।

ঢাকা মেইল : শ্রমিকদের ওপর নিপীড়নের অভিযোগ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সবসময়। বিভিন্ন ঘটনায় শ্রমিকদের মেরে তাদেরকেই আসামি বানানো হয়। এটা রাষ্ট্র কেন করছে?

সেলিম জাহান : রাষ্ট্র কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়। রাষ্ট্রের নানান নির্ণায়ক গোষ্ঠীর নানান স্বার্থ থাকে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে বিভিন্ন গোষ্ঠী স্বীয় স্বার্থে ব্যবহার করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে পুঁজিপতি, বৃহৎ ব্যবসা রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশে গেঁড়ে বসে এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা, রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রভাব বিস্তার করে। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই শ্রমিকদের নানাভাবে নিষ্পেষণ করে কায়েমি স্বার্থবাদীরা তাদের স্বার্থ বজায় রাখে। শ্রমিক ঐক্যে ভাঙন ধরানো, শ্রমিকদের ছাঁটাই করা, শ্রমিকদের মেরে তাদেরই আসামি বানানো- এসব নিষ্পেষণের বিবিধ অপকৌশল।

/জেএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর