বুধবার, ৮ মে, ২০২৪, ঢাকা

পুরো একটা প্রজন্মকে ভুল শিক্ষা দিয়ে বিভ্রান্ত করা হয়েছে

হাবীব ইমন
প্রকাশিত: ২৮ মে ২০২৩, ০৪:১৯ পিএম

শেয়ার করুন:

পুরো একটা প্রজন্মকে ভুল শিক্ষা দিয়ে বিভ্রান্ত করা হয়েছে
ছবি : ঢাকা মেইল

অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান। তাঁর পেশাজীবন শুরু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে। এরপর কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ দায়িত্ব পালন করেছেন নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে। সংস্থাটির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের মূল লেখক টিমের অন্যতম সদস্য তিনি। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। সম্প্রতি দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতিসহ নানা বিষয় নিয়ে ঢাকা মেইলের সঙ্গে কথা বলেছেন বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাবীব ইমন। আজ প্রকাশিত হলো সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্ব।

প্রথম র্পব >> শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বৈষম্য বাড়ছে

তাতে কি রাজনৈতিক দলগুলো বা রাজনৈতিক নেতাদের ব্যর্থতা আছে?

সেলিম জাহান : রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির যে ব্যাপারগুলো আছে সেখানে রাষ্ট্রের একটা বড় ভূমিকা আছে। কারণ রাষ্ট্র আসলে এর চালচিত্র নির্ধারণ করে। অর্থনীতির দিক থেকে যেসব নীতি রাষ্ট্র গ্রহণ করে সেগুলো বৈষম্য বাড়ায় না কমায় তা রাষ্ট্রের নীতির ওপর নির্ভর করে। রাষ্ট্র যে ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করেছে সেগুলো কি উন্নয়নকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়, নাকি উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে, সেটা নির্ভর করে রাষ্ট্রের নীতির ওপর। রাজনৈতিক মূল্যবোধ যেগুলো আছে এবং সেখানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চার বিশেষ পদ্ধতি আছে। রাজনৈতিক পরিপক্কতার যেসব কথা আমরা বলেছি সেগুলোর ব্যাপারে রাষ্ট্রের ভূমিকা আছে। সেই সঙ্গে সংস্কৃতির দিক থেকেও রাষ্ট্র-সংস্কৃতির যে গতিধারা, আন্দোলন, সেটাকে সামনে নিয়ে যেতে পারে। সেটা আমরা অনেকভাবে দেখেছি।

রাষ্ট্র কোনো বিমূর্ত ব্যাপার নয়। কারণ রাষ্ট্র পরিচালনা করে সরকার, রাষ্ট্র পরিচালনা করে রাজনীতিবিদরাই। আমরা যদি ১৯৭৫ পর্যন্ত দেখি, বঙ্গবন্ধু, তখনকার বাংলাদেশ সরকার এক ধরনের উদারপন্থী, এক ধরনের প্রগতিশীল চিন্তাধারা নিয়ে কাজ করেছে। তারা যে সব জায়গায় সফল হয়েছে, সেটা আমি বলব না। মনে রাখতে হবে, প্রথম ৫ বছর বাংলাদেশে একটা ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি ছিল। রাজনৈতিক দিক থেকে নানাভাবে-নানা দিক থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে, সাংস্কৃতিক দিক থেকে আন্দোলন সামনে চলে গেছে। কিন্তু সব ব্যর্থতা বা নেতিবাচক দিকের পরও আমি বলব, সেই সময়টায় যে মূল্যবোধ ছিল, সেগুলো প্রগতিশীল, সেগুলো গণতান্ত্রিক। সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য অর্থনীতির দিক থেকে ন্যায্যতায় অগ্রণী ছিল।

আজকে যে আত্মকেন্দ্রিকতা আমাদের মধ্যে জন্ম নিয়েছে, তার ফলে একটা বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। এ বিভাজনের কারণে এবং আগের যে বিভাজনের কথা আমরা বলেছি, আমার মনে হয়, বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে, সেখানে সবাই ব্যক্তিগতভাবে তার পথ বেছে নিচ্ছে।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর আমরা যদি ’৯০ পর্যন্ত যাই, সেখানে আমাদের রাজনৈতিক দিক থেকে, বিশেষ করে যেসব মূল্যবোধ নিয়ে বাংলাদেশের জন্ম, সেগুলোকে একেবারে জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে। গণতন্ত্র জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে, দলবদলের রাজনীতিকে উৎসাহিত করা হয়েছে। অর্থ কোনো সমস্যা নয়- এটা যখন একটা দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা করেন, তখন স্বাভাবিকভাবে অর্থনীতির দিক থেকে দৃশ্যমানতা-জবাবদিহিতা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

ধর্মীয় দিক থেকে আমরা দেখেছি ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে ধর্মকে রাষ্ট্রের একটা মূল জায়গায় স্থাপিত করা হয়েছে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করা হয়েছে। আর যারা বাংলাদেশের উত্থান, বাংলাদেশের অভ্যুদয়, বাংলাদেশের সামনে এগিয়ে চলার যে মূল্যবোধ তার বিরোধিতা করেছিল ১৯৭১ সালে, তারা কিন্তু পেছনের দরজা দিয়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমরা দেখেছি রাজাকার, যারা বাংলাদেশের বিরোধিতার জন্য একাত্তরে চিহ্নিত হয়েছে, তারাই মন্ত্রী হয়েছে। বাংলাদেশের পতাকা গাড়িতে উড়িয়ে তারা মন্ত্রিত্ব করেছে।

ঢাকা মেইল : এর কি প্রভাব পড়েছে?

সেলিম জাহান : এই সময়টায় আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। একটা পুরো প্রজন্ম গেছে যাদেরকে ভুল শিক্ষা দিয়ে, ভুল তথ্য দিয়ে নানাভাবে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক কে সেটা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দেওয়ার মতো অধিকার জনগণ দিয়েছিল একজনকেই। তিনি হচ্ছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এখন যদি সরকার কবির উদ্দিন (এক সময়ের জনপ্রিয় সংবাদ পাঠক) বঙ্গবন্ধুর সেই বক্তব্যকে বাংলাদেশ বেতার থেকে ঘোষণা দিতেন, তাতে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক হতেন না। তিনি মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রের পাঠক হতেন। এ জাতীয় ব্যাপারগুলো ঘটিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র এবং রাজনৈতিক দলগুলো তখন, বিশেষত যারা ক্ষমতায় ছিলেন, তারা একটা ঘোট পাকিয়েছেন।

সাংস্কৃতিক দিক থেকে রাষ্ট্রযন্ত্র যে ভূমিকা পালন করতে পারত, সেটা করেনি। রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে আমাদের বুদ্ধিজীবী মহল ও উদারপন্থী যে প্রক্রিয়া, তাদেরও দায়ী করব। কারণ তাদের নিষ্ক্রিয়তার কারণে সংস্কৃতির নানা মূল্যবোধ নানা সময়ে অনুপ্রবেশ করেছে এবং জেঁকে বসেছে।

সাংস্কৃতিক দিক থেকে কবিতা উৎসবকে নানাভাবে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা হয়েছে। সেই সময় আমি মনে করি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দল, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিকে ক্রয় করার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে এবং মোহের কাছে বহু সাংস্কৃতিক ব্যক্তি বিক্রি হয়ে গেছেন। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদকে সরিয়ে বাংলাদেশে একটা গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থান যাত্রা শুরু করে। প্রথম দিকে যাত্রাটি ভালো ছিল। ১৯৯০, ১৯৯৬, ২০০০ সাল পর্যন্ত আমরা দেখেছি নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যদিয়ে অন্তবর্তী সরকার এনে আমরা অনেকখানি পিছিয়ে গেছি। তারপর বিশেষত ২০০০ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত আমরা দেখেছি, একটা সন্ত্রাস-সহিংসতার রাজনীতি শুরু হয়ে গেছে। তখন এসিড বোমা মারা হয়েছে। বাসের যাত্রীদের ওপর, সিএনজির যাত্রীদের ওপর, রাজনৈতিক নেতাদের ওপর হামলা হয়েছে। আমার মনে হয়, এসবের মাধ্যমে নানাভাবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে বিনষ্ট করা হয়েছে। রাজনীতির দিক থেকে আমরা যে জায়গায় যেতে পারতাম, সেই সুযোগটার সদ্ব্যবহার আমরা করতে পারিনি।

সাংস্কৃতিক দিক থেকে রাষ্ট্রযন্ত্র যে ভূমিকা পালন করতে পারত, সেটা করেনি। রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে আমাদের বুদ্ধিজীবী মহল ও উদারপন্থী যে প্রক্রিয়া, তাদেরও দায়ী করব। কারণ তাদের নিষ্ক্রিয়তার কারণে সংস্কৃতির নানা মূল্যবোধ নানা সময়ে অনুপ্রবেশ করেছে এবং জেঁকে বসেছে।

ধর্মীয় শিক্ষার ব্যাপারটি যদি বলি, মাদরাসার উত্থান যদি বলি, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ধর্মীয় মূল্যবোধকে এখানে নিয়ে আসার ব্যাপারটা যদি বলি, আমাদের বুদ্ধিজীবী মহল ও উদারপন্থীদের নিষ্ক্রিয়তা যেমন কাজ করেছে, রাজনৈতিক দল ও সরকারের নিষ্ক্রিয়তাও কাজ করেছে।

ঢাকা মেইল : কেন রাজনৈতিক দলের নিষ্ক্রিয়তা কাজ করেছে?

সেলিম জাহান : আমরা যেখানে এসে বলছি যে মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়েছে, আমাদের নৈতিকতার অবক্ষয় হয়েছে, সাংস্কৃতিক দিক থেকে আমরা ঘোট পাকিয়ে ফেলেছি, আমরা বুঝতে পারছি না, আমার মনে হয়, এ দায়ভার আমাদের সবার, রাষ্ট্রযন্ত্রের, রাজনৈতিক দলগুলোর।

ঢাকা মেইল : আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে নতুন নেতৃত্ব চাইছে মানুষ। সে জায়গায় বামপন্থী দলগুলো চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। কেন পারছে না?

সেলিম জাহান : ঐতিহাসিক দিক থেকে বিষয়টি আমি দেখতে চাই। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বামপন্থী দল, বামপন্থী জোটে যারা ছিল, তারা সে সময় আওয়ামী লীগকে বা সে সময়ের রাজনৈতিক দল যারা ক্ষমতায় ছিল, তাদেরকে সমর্থন করেছে। তাতে কোনো অসুবিধা নাই। কারণ তখন এক ধরনের জাতীয় ঐক্যেরও প্রয়োজন ছিল। সেই কারণে তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে কাজ করেছে। কিন্তু সেই সঙ্গে তাদের যে স্বতন্ত্র সত্তা আছে, সেটা কমিউনিস্ট পার্টি হতে পারে বা অন্য কোনো বামপন্থী দল হতে পারে, সেই জায়গায় তারা অত্যন্ত দুর্বল ছিল। এ কারণে তারা সরকারের যেসব জায়গায় সমালোচনা করা দরকার ছিল, রাষ্ট্রযন্ত্রের যেসব জায়গায় ভুল ধরিয়ে দেওয়ার কথা ছিল, তা করেনি। সেটা না করার কারণে রাজনীতিতে তারা কিন্তু ভূমিকা রাখতে পারেনি।

যেসব তরুণ অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে, তারা রাজনীতির মধ্যে ঢুকছে না। কিন্তু যারা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে অর্থনৈতিক দিক থেকে তাদের সঙ্গে এক ধরনের আঁতাত কিন্তু করছে।

দ্বিতীয়ত, জনগণের কাছে ভিন্ন সত্তা, ভিন্ন মতবাদ উপস্থাপন করতে পারেনি। তারা আস্তে আস্তে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এসব কারণে আমরা পরবর্তী সময়েও দেখেছি, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তারা যে ভূমিকা রাখতে পারত, চিহ্নিত করতে পারত বাঙালি চিন্তাচেতনাকে, সেটার ধারবাহিকতা তারা রাখতে পারেনি। ৮০’র দশকে যখন নানাভাবে ভুল তথ্য, ভুল গ্রন্থ, ভুল পাঠ্যসূচি দিয়ে তরুণ সমাজকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে, নানাভাবে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে, তখনও বামপন্থীরা ভূমিকা রাখতে পারেনি। পরবর্তীকালে সাম্প্রদায়িক ও সাংস্কৃতিক হামলার সময় বামপন্থী সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো যে ভূমিকা রাখতে পারত, তারা সেটা পারেনি। যার কারণে আমি বলব, এটা তাদের ব্যর্থতা। কেন এটা হয়েছে? একটা কারণ হতে পারে যে অনেক সময় লেজুড়বৃত্তির কারণে জনবিচ্ছিন্ন হয়েছে, অন্যদিকে তাদের নিজেদের যে সত্তা ছিল সেটা বিসর্জন দিয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দেওয়ার মতো অধিকার জনগণ দিয়েছিল একজনকেই। তিনি হচ্ছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোতে রাজনীতিকরণ করা হয়েছে। রাজনীতিকরণ করা হয়েছে তাদের সাংগঠনিক জায়গা থেকে, তাদের চিন্তাচেতনার দিক থেকে। ফলে তারা সবসময় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে ওই দলের কার্যকলাপ চালিয়ে গেছে। স্বতন্ত্র সত্তা তারা কখনও প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।

তৃতীয়ত, আমাদের বন্ধুবান্ধব, রাজনৈতিক মহল, বুদ্ধিজীবী মহল, সাংস্কৃতিক জোট সবসময় বলে, আমরা মাঠে আছি, আমরা আন্দোলনের সঙ্গে আছি। কিন্তু আমরা দেখি, তারা অর্থের কাছে, মোহের কাছে পরাজিত হয়েছে। যেভাবে অর্থ দিয়ে বুদ্ধিজীবী সমাজকে, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিকে ক্রয় করা হয়েছে, সেভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনকেও নষ্ট করা হয়েছে। অর্থায়নের মাধ্যমে কিছু কিছু বামপন্থী বিক্রি হয়ে গেছে, এটাও তাদের পতনের কারণ। এসব কারণে জনগণ তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। অথচ একটা সময় ছিল সাধারণ জনগণ তাকিয়ে থাকত বামপন্থীদের দিকে। তারা যেটা বলেছে, জনগণ সেটা মেনেছে। কারণ তাদের ওপর জনগণের একটা পরিপূর্ণ আস্থা ছিল। আজ সে আস্থার জায়গাটা আর নেই। জনগণ যেমন বুদ্ধিজীবীদের ওপর আস্থা হারিয়েছে, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ওপর আস্থা হারিয়েছে, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোর ওপরও আস্থা হারিয়েছে। আস্থাহীনতার কারণে বামপন্থীরা সঠিকভাবে নেতৃত্ব দিতে পারছে না।

ঢাকা মেইল : আপনি বলছেন, সাংস্কৃতিক শূন্যতা, রাজনৈতিক শূনতার কথা। এ অবস্থায় বাংলাদেশের জনগণের ভবিষ্যৎ কি?

সেলিম জাহান : বাংলাদেশের জনগণের চরিত্রের একটা বিশ্লেষণ করা দরকার। এ জনগণের মধ্যে নানা রকমের বিভাজন আছে। একটা বিভাজন হচ্ছে অতিদরিদ্রের। সাংস্কৃতিক দিক থেকে যদি দেখেন, একটি গোষ্ঠী এখনও উদারপন্থী, যারা কিনা বাঙালির সাংস্কৃতিক আন্দোলনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। আরেকটি গোষ্ঠী আছে, যারা বিপরীতমুখী ধর্মভিত্তিক সংস্কৃতির দিকে চলে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতির দিকে চলে যাচ্ছে। আরেকটি গোষ্ঠী আছে যারা একেবারে আন্তর্জাতিকভাবে অর্থাৎ পশ্চিমা সংস্কৃতির দিকে চলে গেছে।

এখন যদি সরকার কবির উদ্দিন (এক সময়ের জনপ্রিয় সংবাদ পাঠক) বঙ্গবন্ধুর সেই বক্তব্যকে বাংলাদেশ বেতার থেকে ঘোষণা দিতেন, তাতে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক হতেন না। তিনি মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রের পাঠক হতেন।

রাজনৈতিক বিভাজনও জনগণের মধ্যে আছে। রাজনৈতিক দিক থেকে জনগণ আস্থা হারিয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের জনগণ কোন দিকে যাবে? আমার মনে হয়, বাংলাদেশের জনগণ খুব বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। অর্থনৈতিক সুযোগ কোথায় আছে, সুফল কোথায় আছে, উন্নতির জন্য কোন জায়গাটা আমরা বেছে নেব- আমরা এখন ‘আমি’তে পরিণত হয়েছি। এই যে আত্মকেন্দ্রিকতা, এর কারণে আমাদের যে সহমর্মিতা থাকার ছিল, অন্যের প্রতি সহানুভূতি ছিল, সেটা কিন্তু চলে গেছে।

এটা মনে রাখা দরকার যে বাংলাদেশের সব আন্দোলন, সব প্রক্রিয়া, সব অগ্রগতি কিন্তু আমরা যুথবদ্ধভাবে করেছি। মুক্তিযুদ্ধ যখন হয়েছে, তখন আমরা সবাই অংশগ্রহণ করেছি। একটা দল কিংবা একটা অংশ ছাড়া সবাই। আমাদের সত্তা কি, আমাদের পরিচয় কি- সেটা একেবারে গৌণ ছিল।

আজকে যে আত্মকেন্দ্রিকতা আমাদের মধ্যে জন্ম নিয়েছে, তার ফলে একটা বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। এ বিভাজনের কারণে এবং আগের যে বিভাজনের কথা আমরা বলেছি, আমার মনে হয়, বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে, সেখানে সবাই ব্যক্তিগতভাবে তার পথ বেছে নিচ্ছে। তাদের মধ্যে একটা ব্যাপার কাজ করছে, তা হচ্ছে আত্মকেন্দ্রিকভাবে আমরা কতটুকু সামনে যেতে পারি, আমরা কি করতে পারি, কি অর্জন করতে পারি। বাইরে কারা আছে, বৈষম্যের কি ব্যাপার আছে, সেটা তাদের কাছে ধর্তব্যের বিষয় নয়।

দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দিক থেকে তারা নিষ্ক্রিয়, তারা এটা নিয়ে ভাবেও না। যার জন্য রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তারা যে অবদান রাখতে পারত, সেটা তারা রাখতে পারছে না। অর্থনৈতিক দিক থেকে সেটা খুব বড় ব্যাপার। এখন মানুষ হিসেবে সাফল্য নির্ধারণ করি অর্থনৈতিক সাফল্য দ্বারা। কৃষ্টিগত সাফল্য কতখানি, সাংস্কৃতিক সাফল্য কতখানি, আমরা জনগণের জন্য, প্রতিবেশির জন্য কতখানি করতে পেরেছি, সমাজকে কতখানি দিতে পারছি- সেটা দিয়ে আজকে একজন মানুষের সাফল্য নির্নিত হচ্ছে না।

যেভাবে অর্থ দিয়ে বুদ্ধিজীবী সমাজকে, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিকে ক্রয় করা হয়েছে, সেভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনকেও নষ্ট করা হয়েছে। অর্থায়নের মাধ্যমে কিছু কিছু বামপন্থী বিক্রি হয়ে গেছে।

আগামী যে প্রজন্ম, তারাও সাফল্যের মাপকাঠি ঠিক করেছে- আমি কত ধনী হতে পারব, কিভাবে আমি আমার সম্পদ আহরণ করতে পারব, কিভাবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, সামাজিক প্রক্রিয়াকে সেভাবে লাগাতে পারব- সেদিকেই তারা ধাবিত হচ্ছে। আমি মনে করি, ধনতান্ত্রিক এবং অর্থগত অর্জন যখন সাফল্যের মাপকাঠি হয়, তখন জনগণ অন্যান্য শূন্যতা বাদ দিয়ে অর্থনৈতিক দিকটাকে লক্ষ্য মনে করছে।

সুতরাং জনগণ কোন দিকে যাবে? আমি মনে করি, জনগণ অনেকটা আত্মকেন্দ্রিকভাবে তাদের নিজস্ব ধারায় চলছে। যার জন্য আমরা সমসত্ব একটা প্রক্রিয়া না রাজনৈতিক দিক থেকে দেখতে পাচ্ছি, না অর্থনৈতিক দিক থেকে দেখতে পাচ্ছি, না সাংস্কৃতিক দিক থেকে দেখতে পাচ্ছি। একটা বড় রকমের বিভাজন এখানে আছে। যে বিভাজনের কারণে বাংলাদেশের মূল্যবোধ, বাঙালি হিসেবে যুথবদ্ধভাবে যে অগ্রযাত্রা করতে পারতাম, সেটা আমরা করতে পারছি না।

ঢাকা মেইল : তাহলে কি আমরা ধরে নেব তরুণ প্রজন্ম যাদের আগামী বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা, রাষ্ট্র তাদেরকে বিরাজনীতিকরণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে?

সেলিম জাহান : এক অর্থে ঠেলে দিচ্ছে। কারণ তরুণ প্রজন্ম সম্পর্কে আমি খুবই আশাবাদী। আমি জানি এরা অত্যন্ত সৃজনশীল, সৃষ্টিশীল। তারা নানারকমভাবে অর্থনৈতিক দিক থেকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এখন রাজনৈতিক দিক থেকে যদি সহযোগিতা না পাওয়া যায় তাহলে অর্থনৈতিক সাফল্য পাওয়া মুশকিল। রাজনৈতিক প্রক্রিয়া অর্থনীতিতে নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করছে। অর্থনৈতিক সম্পদের বণ্টন, সম্পদের ব্যবহার, সেটা তারা নির্ধারণ করছে।

সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই যেসব তরুণ অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে, তারা রাজনীতির মধ্যে ঢুকছে না। কিন্তু যারা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে অর্থনৈতিক দিক থেকে তাদের সঙ্গে এক ধরনের আঁতাত কিন্তু করছে। সুতরাং আমরা একটু চোখ রাখলে দেখতে পাব এ আঁতাতের ফলে যেটা হচ্ছে- ওই আঁতাতের মাধ্যমে, যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছে, তাদের মধ্যে একটা অংশ হয়তো তরুণ প্রজন্মকে সাহায্য করছে। আবার বহু সৃষ্টিশীল-সৃজনশীল প্রক্রিয়াকে তারা সাহায্য করছে না।

আমি মনে করি, এভাবে বিরাজনীতিকরণ হচ্ছে। একটি-দুটি ব্যতিক্রম ছাড়া তরুণ প্রজন্মকে রাজনীতির মধ্যে দেখতে পাচ্ছি না। না সংসদ সদস্য হিসেবে, না রাজনৈতিক দলের মধ্যে তরুণ প্রজন্মকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। একটা যতিসীমা আমরা দেখতে পাচ্ছি আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। যেটা আমরা ষাটের দশকে চিহ্নিত করতে পারতাম।

হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধু এগিয়ে এসেছেন পঞ্চাশের দশক থেকে, ষাটের দশক থেকে, সত্তরের দশকে একজন রাজনৈতিক জ্যোতিষ্ক হিসেবে। একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তাকে বহু মানুষ সেসময় চিহ্নিত করেছে। সেটা কিন্তু রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গড়ে উঠেছে। আমি মনে করি, তরুণ প্রজন্ম যদি রাজনীতির মাঝখানে না আসে তাহলে ভবিষ্যতে যে ধরনের পরিবর্তনের কথা আমরা বলছি, যে ধরনের পরিবর্তন আমরা চাই, সেটা আমরা পাব না।

/জেএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর