রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জের ধরে বিশ্বজুড়ে দেখা দিয়েছে অর্থনৈতিক মন্দা। দেশে দেশে বেড়েছে মুদ্রাস্ফীতি, কমেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। পরিস্থিতি সামলাতে ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। আমদানি পণ্যেও আরোপ হয়েছে নানা বিধি-নিষেধ। রফতানি বন্ধেরও পদক্ষেপ নিয়েছে অনেক দেশ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর পরও এর ফল ভোগ করছে গোটা বিশ্ব।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জের ধরে রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল, গ্যাসসহ দাম বেড়েছে নিত্যপণ্যের। সেই সঙ্গে পরিবহণ ব্যবস্থায় সমস্যা তৈরি হয়েছে। অনেক উন্নত দেশেও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ব্যয় ভয়াবহ আকারে বেড়েছে।
বিজ্ঞাপন
খাদ্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত ইউক্রেন ও রাশিয়ার সংঘাত বিশ্বজুড়ে খাদ্য ঘাটতি ও দামে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। যুদ্ধের এক বছরে এখনও ধুঁকছে বিশ্ব। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ইলনিয়সের গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে মোট গম উৎপাদনের ৩০ শতাংশ হয় ইউক্রেন ও রাশিয়ায়। আর ভুট্টা উৎপাদনের ২০ শতাংশ উৎপাদিত হয় এই দুই দেশে। তুরস্কের মধ্যস্থতায় ইউক্রেন থেকে খাদ্য রফতানি চললেও তার পরিমাণ ও ব্যবস্থাপনা আগের তুলনায় অনেক কম।
যুদ্ধের প্রভাবের মধ্যে মূল্যস্ফীতিকে সবচেয়ে ‘বড় সমস্যা’ হিসেবে চিহ্নিত করছেন অর্থনীতিবিদরা। উন্নত দেশগুলোতেও এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। দরিদ্র দেশগুলোর অবস্থা হয়েছে আরও ভয়াবহ। যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে বদলে গেছে কোটি কোটি মানুষের জীবনের ছক। যাপিত জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। বেড়েছে বেকারত্ব। যুক্তরাষ্ট্রের লাভজনক শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোও অকল্পনীয় হারে কর্মী ছাঁটাই করেছে। যুদ্ধে পাল্টে গেছে বিশ্বায়নের ধারাও। 'নিজে বাঁচো' নীতিই এখন বেশিরভাগ দেশের মূলনীতি। বদলে গেছে ভূ-রাজনীতি।
রাশিয়ার ওপর ব্যাপক নিষেধাজ্ঞার কারণে উল্টো বিপাকে পড়েছিল ইউরোপ। তবে রাশিয়ার তেল-গ্যাস ছাড়া শীতে গোটা ইউরোপ জমে যাবে বলে যেমনটি আশঙ্কা করা হয়েছিল বাস্তবে তেমনটি ঘটেনি। সংকট বাড়লেও ইউরোপ এটি খুব ভালোভাবে সামাল দিয়েছে। তারপরও মুদ্রাস্ফীতি ও বাজারদর নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।
বিজ্ঞাপন
বিশ্বব্যাংকের গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টাসে বলা হয়েছে, যুদ্ধের ধাক্কায় ২০২৩ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে আসবে। এটা প্রায় তিন দশকের মধ্যে তৃতীয় সর্বনিম্ন। জার্মান ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্সের গবেষণা বলছে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ২০২৩ সালে তামাম বিশ্বে উৎপাদন ক্ষতির পরিমাণ আরও ১ ট্রিলিয়ন ডলার বা তার বেশি হতে পারে।
জার্মান ইন্সটিটিউট অফ ইকোনমিক্স তাদের সমীক্ষায় জানিয়েছে, ‘ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ও উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাহত হয়েছে। উপরন্তু, বিদ্যুতের দাম আকাশচুম্বী হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতি বিশ্বের সর্বত্র তীব্রভাবে বেড়েছে এবং ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করেছে।’
এ গবেষণায় বলা হয়েছে, ‘অনিশ্চিত অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান সুদের হার এবং মূলধনী পণ্যের ব্যয় বৃদ্ধি হয়েছে। এ কারণে ক্রমবর্ধমানভাবে অর্থায়নের ব্যয়ও বেড়েছে। এ কারণে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন কোম্পানি বিনিয়োগে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছে।’
তবে গবেষকরা জানিয়েছেন, তারা আশা করছেন যে- ২০২২ সালের তুলনায় এবার সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক ক্ষতি কিছুটা কম হবে। জার্মানির ব্রেমেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ নিকোলে মিত্রোখিন আল জাজিরাকে বলেন, যুদ্ধ ২০২৩ সালের শেষের দিকে বা ২০২৪ সালের মধ্যে শেষ হতে পারে।
বিশ্বজুড়ে সংকটে সবচেয়ে বেশি ভুগছেন সাধারণ মানুষ। যাদের আয়ের পরিধি অনেক কম। বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে যাদের তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। তাদের আশা- দ্রুত পরিস্থিতি ঠিক হোক, দুই বেলা খাবার খেয়ে পৃথিবীতে যেন কিছুটা শান্তি পান তারা।
একে