প্রথম ম্যাচ, দুর্বল সৌদি আরবের বিপক্ষে। সুপার টেকনোলজির প্রথম বিশ্বকাপ। মেসির পেনাল্টি গোলে খেলা শুরু কিন্তু একের অপর এক গোল বাতিল হতে থাকলো সুপার টেকনোলজি দিয়ে। কী দিয়ে কী হচ্ছিল কিছুই যাচ্ছিল না বোঝা। অল্প সময়ের একটা ট্রমায় সৌদি আরব উলটে দিয়ে দিল দুই গোল।
সারা পৃথিবী জুড়ে নেমে এলো হতাশার ঘনঘটা। এক জোড়া খেজুর হাতে ফিরে আসলো মেসির আর্জেন্টিনা। এমন ট্রলই তো হচ্ছিল সব জায়গায়। কেউ আবার ২০১০ বিশ্বকাপে স্পেনের পুনরাবৃত্তি দেখছিলেন। সেই স্বপ্ন দেখা মানুষের সংখ্যাও কম নয়। খোদ মেসিও ছিলেন তাদের দলে। দলের সবাইকে ডেকে বলেছিলেন, আমাদের সবগুলো ম্যাচই এখন ফাইনাল ম্যাচ, জিততে হবে। গ্রুপ পর্বের প্রতিপক্ষই তো সহজ না। তার মধ্যে যা শুরু হয়ে গেল বিশ্বকাপে। যে যাকে যেদিক দিয়ে পারছে হারিয়ে দিচ্ছে। গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেওয়ার পথে অনেক বড় দল। সত্যি করে বলতে আর্জেন্টিনাও সেই দলেরই সম্ভাব্য সদস্য ছিল।
বিজ্ঞাপন
মেক্সিকো ম্যাচে একজন বাস পার্ক করে রেখেছিল মেক্সিকো। ম্যাড়মেড়ে একটা ম্যাচ হচ্ছিল। প্রথমার্ধের শেষ দিকে ইমিলিয়ানো মার্টিনেজের দারুণ ফ্রি কিক সেইভ সম্ভবত দলের মধ্যে নতুন করে সাহস আর শক্তি এনে দেয়। যেভাবে ওরা ডিফেন্স আটকে রাখছিল তখন একটা অস্বাভাবিক অতিমানবীয় কিছু করার দরকার ছিল। আর সেটা করতে হলে মেসিকেই করতে হতো। মেসি সেটাই করলেন। কোনো এক দূরত্ব থেকে গোল দিয়ে ডেডলক খুললেন। এই ম্যাচে লিসান্দ্রো মার্টিনেজের অন্তর্ভুক্তি, জুলিয়ান আলভারেজ আর এঞ্জো ফার্নান্দেজের সাবস্টিটিউট ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। পরের ম্যাচ থেকে এরা তো নিয়মিত হয়ে যায়। এঞ্জো ফার্নান্দেজের ওই বাঁকানো গোল বলে দেয় এই ছেলে রাজত্ব করতে এসেছে।
পরের ম্যাচ পোল্যান্ডের সাথে, হিসাব খুব বেশি কঠিন না তবে সহজও না। এর মধ্যে মেসি করে ফেললেন পেনাল্টি মিস। ঠিক ২০১৮ বিশ্বকাপের চিত্রে ভেসে উঠলো মানসপটে। আবারো কি তেমন কিছু হিতে যাচ্ছে? নাহ, এ যাত্রায় ম্যাক এলিস্টার এবং জুলিয়ান আলভারেজ ত্রাতা হয়ে দাঁড়ালেন। বাদ পড়তে পড়তে দলটা গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই উঠলেন দ্বিতীয় রাউন্ডে।
দ্বিতীয় রাউন্ড আর কোয়ার্টার ফাইনালে একটা চিত্র একদম এক, প্রথমেই দুই গোলের লিড। অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে প্রথম গোল মেসির, দ্বিতীয় গোল জুলিয়ান আলভারেজের। একটা গোল কোনোক্রমে শোধ করে দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া, ফলাফল ২-২ হতেও পারতো যদি না ঠিক ২০১৪ বিশ্বকাপের মাসচেরানোর ট্যাকলটার মতো ট্যাকল লিসান্দ্রো মার্টিনেজ না করতো।
বিজ্ঞাপন
নেদারল্যান্ডস ম্যাচের আগে মিডিয়ায় মোটামুটি নেদারল্যান্ডস জিতেই গেছেন। সেই রাগেই তো মেসি মলিনার করা গোলের সময় চুপচাপ থাকলেও নিজের করা গোলটার পরে স্বয়ং নেদারল্যান্ডসের কোচকে দিয়ে ভেংচি কেটে ফেলেন। কিন্তু ভাগ্য তো সহায় হলো না, দুই গোল শোধ হয়ে গেল এরপরে। মনে হচ্ছিল ব্রাজিলের মতো আর্জেন্টিনাও বিদায় নিবে। কিন্তু না, ২০১৪ বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসের সাথে টাইব্রেকারে নায়ক ছিল গোলরক্ষক সার্জিও রোমেরো আর এবার আবার সেই ইমিলায়ানো মার্টিনেজ। পেনাল্টি না ঠেকালে যেন তার পেটের ভাত হজম হয় না।
সেমি ফাইনালে ক্রোয়েশিয়া, স্মৃতিতে ২০১৮ বিশ্বকাপে সেই কলঙ্কিত ম্যাচ, ৩-০ গোলের। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, ফলাফল এবারও ৩-০ কিন্তু তা আর্জেন্টিনার পক্ষে।
আবারও ফাইনাল, আবারও মেসি খুব কাছাকাছি। এবার তো অল্প সময়ের মধ্যেই বিজয়ের বাজনা বাজাতে শুরু করে দিলেন সবাই। মেসির গোলের সাথে, ফাইনালের অবধারিত গোলদাতা ডি মারিয়ার গোল। কিন্তু ৭৯ মিনিটে গিয়ে নতুন এক নাটক, দুই মিনিটের মাথায় এমবাপ্পের দুই গোল। খুব কাছে থেকেও কি আবারও হাত ফসকে যাবে নাকি! এই ভয় যখন মনে দানা বেঁধে উঠেছিল তখন এক্সট্রা টাইমে লিওনেল মেসির গোল, এবার আর পেনাল্টিতে নয়, ওপেন প্লেতে তাও আবার আবার ডান পায়ে। ধারাভাষ্যকার তো বলেই দিলো, Lionel Messi perhaps scored the winning goal of the final....
আরও পড়ুন- ২০২৬ বিশ্বকাপেও খেলবেন মেসি!
কিন্তু না, শেষ হইয়াও হইলো না শেষ। আবার এমবাপ্পের গোল। ফলাফল ৩-৩ শেষ মুহূর্তে টানটান উত্তেজনা। খেলার শেষ বাঁশি বাজার আগ মুহূর্তে তো গোল দিয়েই দিয়েছিলেন কোলো মুয়ানি কিন্তু ত্রাতার ভূমিকায় ইমিলিয়ানো মার্টিনেজ। তাকে যে আবার ত্রাতা হতে হবে, খেলা গড়িয়েছে টাইব্রেকারে।
এমবাপ্পের প্রথম শ্যুট হাতে লাগিয়েও রক্ষা করতে পারলেন না মার্টিনেজ। মেসির শ্যুট, একদম ঠাণ্ডা মাথায় গোল। এবার আসলেন কোমান, রূপ দেখা গেল মার্টিনেজের, ধারাভাষ্যকার বললেন, Martinez punching the air again....
আসলেন দিবালা, অল্প সময়ের সুযোগ তার, মাঠে নেমেছেন এই শ্যুটটার জন্যই, একদম একশোতে একশো। এবার শুয়ামেনির পালা, মার্টিনেজ খেললেন এক মানসিক খেলা, বল ছুড়ে মারলেন দূরে, ওইটুকু একটা ছেলেকে এমন চাপ দিলে ভেঙে পড়াটাই স্বাভাবিক। মারলেন বাহিরে।
এবার আসলেন পারেদেস, একদম সরাসরি গোল। ধারাভাষ্যকার "nearly there, so very nearly there" কোলো মুয়ানিকে গোলটা করতেই হতো, করেছেন।
এবার গঞ্জালো মন্টিয়েলের পালা, ক্যারিয়ারের সবগুলো পেনাল্টিতে গোল করার রেকর্ড তার। আস্তে আস্তে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছেন একটা গোল করার জন্য। যেই গোলটা এনে দিবে একটা বিশ্বকাপ, গোটা চারটা বছর সবাই বলবে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, মেসিকে সবাই বলে ফেলবে সর্বকালের সেরা।
এরপর পিটার ড্রুরিই বলুক...... ‘Montiel... Argentina, champions of the world. Again. At last. And the nation will tango all night long. 36 years ago since Maradona and Mexico, here finally is a nation's new throng of immortals. Scaloni will be fated, Messi will be sainted.
নিঃশ্বাস বন্ধ ছিল অনেকের, অনেকেই চেঁচিয়ে কেঁদেছেন, বাচ্চাদের মতো আর্তনাদ করেছেন, লাফঝাঁপ দিয়েছেন। এইদিনটা কাঁদেননি শুধু মেসি নিজে। আজ আর কাঁদার দিন নয়, এবার শুধুই হাসার।
এনএম