একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা আবিদুল ইসলাম সামি। রাজধানীর ডেমরা এলাকায় দুর্ঘটনার শিকার হন তিনি। পায়ে আঘাত পেয়ে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) বেডে কাতরাচ্ছেন। ভেঙে গেছে ডান পা। হাসপাতালে থাকতে হবে তাঁকে আরও কয়েক দিন এবং করতে হবে অস্ত্রোপচার। সুস্থ হতে লাগবে দীর্ঘ সময়।
জানতে চাইলে সামি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ব্যাটারিচালিত রিকশায় কর্মস্থল থেকে বাসায় যাচ্ছিলাম। অপর পাশ থেকে আসা গাড়ির ধাক্কায় রিকশা থেকে পড়ে যাই। এতে পা ভেঙে যায়।’
বিজ্ঞাপন
তিনি জানান, তিনি যে রিকশায় ছিলেন, রিকশাটি অস্বাভাবিক গতি এবং রং সাইড দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ বিপরীতমুখী গাড়ি এসে ধাক্কা দেয় রিকশাটিকে। যার কারণে এমন দুর্ঘটনার শিকার হন তিনি। রিকশায় থাকা চালকও দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। তবে চালকের আঘাত গুরুতর না।
সামি জানান, পায়ে বেশি আঘাত পাওয়ায় রাত হলে বেড়ে যায় যন্ত্রণা। এখন চিকিৎসকের নিয়ম অনুযায়ী চলাফেরা করছেন। আর গুনছেন কবে তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন এবং আগের মতো চলাফেরা করতে পারবেন।
বাড়ছে দুর্ঘটনার রোগী
নিটোর সূত্রে জানা গেছে, সময় যত যাচ্ছে, ততই বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। এর একটি বড় অংশ ব্যাটারিচালিত রিকশার কারণে। দুর্ঘটনার শিকার কারও পা ভেঙে যাচ্ছে, কারও ভেঙে যাচ্ছে হাত। কাউকে কাউকে আবার স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করে নিতে হচ্ছে।
জানতে চাইলে নিটোরের সহকারী পরিচালক ডা. মো. রাশেদুল আমীন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আঘাতের ওপর নির্ভর করে ক্ষতটা ভালো হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু। দুর্ঘটনায় যারা আঘাত কম পান, তাদের ক্ষত ভালো হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। আর যাদের ক্ষতটা বেশি থাকে, তাদের সুস্থ হতে সময় লাগে। অনেক সময় দেখা যায় ক্ষতের জায়গাটা কেটে ফেলতে হয়। আর পরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে কি না বা ফিরতে পারবে কতটুকু, তা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।’
হাত-পায়ে আঘাত বেশি
ব্যাটারিচালিত রিকশায় দুর্ঘটনায় চালকদের বেশি ক্ষতি না হলেও পেছনে থাকা যাত্রীদের পড়তে হচ্ছে বড় ক্ষতির মুখে। তাতে বেশির ভাগই আঘাত পান পা কিংবা হাতে। তবে শরীরের অন্যান্য স্থানে আঘাত কম পান।
জানতে চাইলে নিটোরের পরিচালক ডা. আবুল কেনান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনার রোগীদের মধ্যে বেশির ভাগ থাকে মোটরসাইকেল বা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার। যাদের বেশি ইনজুরি থাকে হাতে এবং পায়ে।’
এই চিকিৎসক বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনা সমাজের জন্য অভিশাপ। কেননা, দুর্ঘটনার শিকার হওয়া বেশির ভাগই থাকেন পরিবারের একমাত্র আয় করা ব্যক্তি। যার মাধ্যমে পরিবারের চাকা সচল থাকে। দুর্ঘটনা কমাতে এখনই করণীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।’
চালকদের অদক্ষতাকে দুষছেন বিশেষজ্ঞরা
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকদের বেপরোয়া গতি আর ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, চালকদের অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা, চালকদের কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা ও বেপরোয়া চালানোয় ঘটছে এসব দুর্ঘটনা। এছাড়া দুর্ঘটনা ঘটছে জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা এবং না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও সচেতনতার অভাবে।
তারা আরও বলছেন, ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলোর কোনো লাইসেন্স নেই, চালকেরা অধিকাংশ সময় অপ্রশিক্ষিত। এসব যানবাহন প্রধান সড়কে চলাচলের উপযোগী নয়। শহরের যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ এই রিকশা। অনেক সময় দেখা যায়, একটি রিকশা উল্টো পথে গিয়ে পুরো মোড় আটকে দিয়েছে। জরিমানা করলেও সমস্যার স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না। দরকার স্পষ্ট নীতিমালা, যার মাধ্যমে এসব যান নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য মতে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ হাজার ৫৩৮টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে মোট দুর্ঘটনার ১৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ ঘটে শুধু ব্যাটারিচালিত রিকশা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরই) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যানবাহনের কারণে সারাদেশে ৯০০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মাঝে ৫৮২টিই ছিল মারাত্মক।
এআরইর সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান জানান, এগুলোর মাঝে একটা বড় সংখ্যাই হলো ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা এবং দুর্ঘটনার সংখ্যা বাস্তবে নিশ্চয়ই আরও অনেক বেশি।
হাদিউজ্জামান বলেন, 'এই বাহনের ব্রেকিং সিস্টেম-কাঠামো এত দুর্বল, এটি এত ঝুঁকিপূর্ণ বাহন…এ নিয়ে বিতর্ক করার কোনো সুযোগ আমি এখানে দেখছি না। যানবাহনের স্ট্যাবিলিটি নির্ভর করে তার সেন্টার অব গ্রাভিটি কোথায় আছে, তার ওপর। কিন্তু পায়ে চালিত রিকশায় যখন বৈজ্ঞানিকভাবে দুই-চারটা ব্যাটারি বসানো হচ্ছে, তখন তার গ্রাভিটি চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে এবং তাকে একটি ভারসাম্যহীন বাহনে পরিণত করছে।'
'সেজন্য দেখবেন যেকোনো মোড়ে যখন এরা দ্রুত বেগে বাঁক নিচ্ছে, তখন এরা উল্টে পড়ে যাচ্ছে। কারণ তার সেন্টার অব গ্রাভিটি জায়গামতো নাই’ যোগ করেন তিনি।
এসএইচ/জেবি