বর্তমানে শহর থেকে গ্রাম—সবখানেই ইজিবাইক বা ব্যাটারিচালিত রিকশার চলাচল বেড়েছে ব্যাপক হারে। পরিবেশবান্ধব ও স্বল্প ব্যয়ের এই বাহনটি জনগণের মধ্যে দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কিন্তু এর নেতিবাচক দিকও রয়েছে—এই যানের লাগামহীন বিস্তারে চাপ বেড়েছে দেশের বিদ্যুৎব্যবস্থায়। বর্তমানে দেশে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ লাখ ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও রিকশা চলাচল করছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, সাধারণত একটি ইজিবাইকের জন্য চার থেকে পাঁচটি ১২ ভোল্টের ব্যাটারি প্রয়োজন। আর প্রতি সেট ব্যাটারি চার্জের জন্য গড়ে ৯০০ থেকে এক হাজার ১০০ ওয়াট হিসেবে পাঁচ থেকে ছয় ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হয়। এতে অনায়াসে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা চালানা যায়। সে হিসেবে প্রায় ৬০ লাখ ইজিবাইক বা ব্যাটারিচালিত রিকশা চার্জের জন্য জাতীয় গ্রিড থেকে প্রতিদিন তিন থেকে চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হওয়ার কথা। কিন্তু ৮০ ভাগ গ্যারেজে চুরি করে ও লুকিয়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে এসব ব্যাটারি রিচার্জ করায় সরকার দৈনিক প্রায় ২০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দেশের জেলা প্রশাসন বা ট্রাফিক বিভাগের কাছে ইজিবাইক কিংবা অটোরিকশার কোনো পরিসংখ্যান নেই।
বিজ্ঞাপন
বেশির ভাগ চালকই সামান্য অর্থের বিনিময়ে অবৈধভাবে বৈদ্যুতিক লাইন থেকে গাড়িগুলোতে চার্জ করিয়ে নিচ্ছেন। তারা এই গাড়িগুলো যে গ্যারেজে রাখছেন সে জায়গা থেকেই রাতভর একটি গাড়ির শুধু চার্জের জন্য গ্যারেজ মালিককে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা করে দিচ্ছেন।
বিদ্যুৎ খাতের ওপর প্রভাব
বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিড ইতোমধ্যেই চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহে হিমশিম খাচ্ছে। ইজিবাইকের অতিরিক্ত চার্জিং ডিমান্ডের কারণে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর, যখন সাধারণ মানুষ ঘরে ফেরে এবং বিদ্যুতের ব্যবহার স্বাভাবিকভাবে বাড়ে, তখন ইজিবাইকের চার্জিং আরও বাড়তি চাপ তৈরি করে। অনেক গ্যারেজে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে ইজিবাইক চার্জ দেওয়া হচ্ছে, যা বিদ্যুৎ চুরির অন্যতম কারণ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ব্যাটারি রিকশার একটা বড় অংশে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয় অবৈধ সংযোগ থেকে। ফলে বিপুল বিদ্যুৎ থেকে বঞ্চিত হয় বিপণন সংস্থাগুলো। ডিপিডিসির বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নের অভিযান পরিচালনা করলেও খুব একটা সফল হচ্ছে না গ্যারেজ মালিকদের কৌশলের কারণে। তাই ডিপিডিসি ব্যাটারিচালিত রিকশার বিদ্যুতের জন্য আলাদা একটি ট্যারিফের ব্যবস্থা করেছে। তাতে কিছু রিকশা মালিক বৈধ বিদ্যুৎ সেবা নিচ্ছেন বলে জানান কর্মকর্তারা।
বিজ্ঞাপন
বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, সারাদেশে প্রায় ৪০ লাখ ইজিবাইক এবং ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা রয়েছে। একটি ইজিবাইক ১২ ভোল্টের ছয়টি করে ব্যাটারি ব্যবহার করে। এতে সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা তৈরি হয়।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ২০ ধরনের যানবাহনের নিবন্ধন দেয়। গত অক্টোবর পর্যন্ত নিবন্ধিত যানবাহন হচ্ছে ৬২ লাখ। এর মধ্যে গণপরিবহনের মূল বাহন বাস-মিনিবাস আছে মাত্র ৮৪ হাজার। যা মোট নিবন্ধিত যানের ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। তিন চাকার যানবাহনের মধ্যে শুধু অটোরিকশা ও অটোটেম্পোর নিবন্ধন দেয় বিআরটিএ। এ দুটি যানের বৈধ সংখ্যা প্রায় তিন লাখ ৪২ হাজার।
অনিয়ন্ত্রিত চার্জিং স্টেশন
অধিকাংশ চার্জিং পয়েন্ট অনুমোদনহীন ও অনিয়ন্ত্রিত। এতে নিরাপত্তা ঝুঁকি যেমন বাড়ছে, তেমনি বৈদ্যুতিক অপচয়ও হচ্ছে মারাত্মকভাবে।
ইজিবাইক যেমন একদিকে কর্মসংস্থান ও পরিবেশবান্ধব যোগাযোগের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে, অন্যদিকে তা এখন বিদ্যুৎ খাতের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সঠিক পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণ ছাড়া এই সংকট ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, একটি ইজিবাইকে একটি পরিবারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। ফলে চাইলেও ইজিবাইককে বাদ দেওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া গ্রামীণ জনপদে সহজ যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে উঠেছে ইজিবাইক। একজন ইজিবাইক চালকের পরিবারে গড়ে পাঁচজন লোক থাকলে প্রায় দুই কোটি মানুষের নিত্যদিনের জীবনযাপনের অর্থ আসে এখান থেকে। ফলে প্রত্যক্ষভাবে এসব মানুষ ইজিবাইকের ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে ইজিবাইক মেরামত এবং ইজিবাইক শিল্প কারখানা এবং ব্যাটারি শিল্পও বিকশিত হয়েছে ইজিবাইকের মাধ্যমে। ফলে এখানেও বিপুল মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এখন গ্রামে বসবাসকারী ৮০ ভাগ মানুষের যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম ইজিবাইক।
অবৈধ যানের দাপট বেশি
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ২০ ধরনের যানবাহনের নিবন্ধন দেয়। গত অক্টোবর পর্যন্ত নিবন্ধিত যানবাহন হচ্ছে ৬২ লাখ। এর মধ্যে গণপরিবহনের মূল বাহন বাস-মিনিবাস আছে মাত্র ৮৪ হাজার। যা মোট নিবন্ধিত যানের ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। তিন চাকার যানবাহনের মধ্যে শুধু অটোরিকশা ও অটোটেম্পোর নিবন্ধন দেয় বিআরটিএ। এ দুটি যানের বৈধ সংখ্যা প্রায় তিন লাখ ৪২ হাজার।
অন্যদিকে নিবন্ধিত যানবাহনের বাইরে ৬০ থেকে ৭০ লাখ তিন চাকার ছোট যানবাহন চলাচল করে। এগুলোকে সরকার অবৈধ হিসেবে বিবেচনা করে। এসব যানের মধ্যে রয়েছে নছিমন, করিমন, আলমসাধু, ভটভটি, ইজিবাইক ও পাখি। সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে ব্যাটারি বা যন্ত্রচালিত রিকশা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদীউজ্জামান বলেন, তিন চাকার এসব অবৈধ যান শুরুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ভালো হতো। নানা ত্রুটিযুক্ত বিপুল পরিমাণ এসব যানের চলাচল নিঃসন্দেহে ঝুঁকিপূর্ণ।
এমআর/জেবি