শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

প্রতিদিনের আতঙ্ক ‘বাংলার টেসলা’, বালাই নেই নিয়ম-নীতির

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ০৮ মে ২০২৫, ০৮:২৭ এএম

শেয়ার করুন:

প্রতিদিনের আতঙ্ক ‘বাংলার টেসলা’, বালাই নেই নিয়ম-নীতির
          • উল্টো পথে চলছে বেপরোয়া
          • প্রতিনিয়তই ঘটছে দুর্ঘটনা
          • অনিয়ন্ত্রিত এই যানে অতিষ্ঠ সবাই
          • যান ও যন্ত্রাংশ আমদানি বন্ধের দাবি


রাজধানীর রাস্তায় এখন নতুন আতঙ্কের নাম ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না এই ঝুঁকিপূর্ণ যানটি। মূল সড়ক, গলিপথ, ওভারব্রিজের নিচ, স্কুলগেট-সবখানেই তাদের উপস্থিতি। ট্রাফিক আইন বলে কিছু নেই, সিগন্যাল মানে না, একমুখী রাস্তায় উল্টো দিক দিয়ে চালিয়ে দেয়। ব্যাটারিচালিত এই যানটিকে অনেকেই ‘বাংলার টেসলা’ বলে অবহিত করেছে। যাতে একবার উঠলে চালকরা আর সামনে-পেছনে তাকানোর সুযোগ পান না। এর কারণে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন সব ধরনের মানুষ।


বিজ্ঞাপন


রাজধানীর পুরানা পল্টনে অফিস শেষে বাস ধরার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা মাহফুজ। আচমকা একটি ব্যাটারি রিকশা ফুটপাতে উঠে তার হাঁটুর কাছে এসে থামে। অল্পের জন্য রক্ষা। তিনি হতবাক হয়ে চালককে প্রশ্ন করেন, ‘এইটা কি রাস্তা নাকি ফুটপাত?’ চালক হেসে উল্টো বলেন, ‘সময় নাই ভাই, সাইড দেন।’

ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলোর বেশির ভাগই অপ্রশিক্ষিত চালকদের হাতে, যাদের অনেকের বয়সই আঠারোর নিচে। আবার অনেকেই অতিরিক্ত যাত্রী বহন করে, কখনো চারজন, কখনো পাঁচজন। গতির নিয়ন্ত্রণ নেই, ব্রেক ঠিকঠাক কাজ না করলেও চালানো হয় অনায়াসে। সিগন্যাল লাল হলেও থামে না, বিপরীত দিক থেকেও ঢুকে পড়ে যানজটে।

গত বুধবার (৩০ এপ্রিল) রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় অটোরিকশার ধাক্কায় সড়কে পড়ে বাস চাপায় দুই মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, যানবাহনে ঠাসা ধীরগতির রাস্তায় একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা সজোরে এসে মোটরসাইকেলগুলোকে ধাক্কা দিলে আরোহীরা বাসের তলায় গিয়ে পড়েন।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে খিলগাঁও থানার ওসি দাউদ হোসেন বলেন, একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ধাক্কায় মোটরসাইকেল চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যান। পরে মিয়ামি পরিবহনের একটি বাস তাদের চাপা দেয়। এতে মোটরসাইকেল চালক আব্দুল্লাহ আল নোমান ঘটনাস্থলেই নিহত হন। পাভেল নামে মোটরসাইকেলের আরেক আরোহীকে গুরুতর আহত অবস্থায় ফরাজী হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তাররা মৃত ঘোষণা করেন।

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মিরপুর পল্লবী কালশী এলাকায় অটোরিকশা থেকে পড়ে জনি (২৬) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। তিনি একটি ডেন্টাল হাসপাতালের ল্যাব টেকনিশিয়ান ছিলেন। সন্ধ্যার দিকে বন্ধুদের সঙ্গে চা খাচ্ছিলেন তিনি। এ সময় জনির আরেক বন্ধু পেছন থেকে ডাক দেন। ঘাড় ঘোরানো মাত্রই অটোরিকশার ফাঁকা জায়গা দিয়ে নিচে পড়ে আহত হন তিনি। জনির বন্ধুরা দ্রুত তাকে প্রথমে নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে এলে চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মৃত ঘোষণা করেন।

প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও এভাবেই ঘটে চলছে অটোরিকশাসংক্রান্ত দুর্ঘটনা। চালকদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, তাদের কেউ ট্রাফিক আইন শেখায়নি, কীভাবে চলাচল করতে হয় সে ধারণাও তাদের নেই। ‘উল্টা দিক’ দিয়েই চলছে রাজধানীর শৃঙ্খলা। ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের মধ্যে এই রিকশা পরিচালনা নিয়ে নেই কোনো সমন্বয়। ট্রাফিক বিভাগ বলে, তারা এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না। কারণ এগুলোর কোনো রেজিস্ট্রেশন নেই, আবার গ্যারেজ মালিকরা বলেন, তারা তো ‘লোকজনকে কাজে দিচ্ছে’।

ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ে অনেককেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখা গেছে। গত ২৭ এপ্রিল জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবর সোশ্যাল মিডিয়ায় এক পোস্টে লিখেন, ‘টেসলা খ‍্যাত ব‍্যাটারিচালিত রিকশায় জনজীবন দুঃসহ। সরকার আত্মসমর্পণ করেছে, এদের (ব‍্যাটারিচালিত রিকশা) প্রতিরোধের সময় চলে এসেছে।’

পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী বাহন বলে পরিচিত ব্যাটারি রিকশাগুলো এখন হয়ে উঠছে বিশৃঙ্খলার প্রতীক। আইন না থাকা, অনিয়ন্ত্রিত চলাচল, নীতিমালার অভাব আর দায়িত্বজ্ঞানহীনতা—সব মিলিয়ে রাজধানীবাসীর প্রতিদিনের আতঙ্কে পরিণত হয়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। মাঝে-মধ্যে কিছু চিরুনি অভিযান হয়, কিছু রিকশা আটক হয়, সংবাদপত্রে আসে ছবি। কিন্তু দুই দিন পর আবার একই জায়গায় রিকশাগুলো চলে আগের মতো। মনে হয়, এই শহরকে কেউ আর নিয়ন্ত্রণ করতে চায় না কিংবা পারছে না।

বাসাবো এলাকার বাসিন্দা কামরুল হাসান বলেন, ‘আমার মায়ের পায়ে ব্যাটারি রিকশা উঠে গেছিল। বলি দাঁড়ান, চালক বলে, আমি কী করবো? একবারও পেছনে তাকায় না। এই শহরে আমরা বাস করছি না, এই রিকশাগুলোর দয়া নিয়ে চলছি।’

রাজধানীসহ দেশের শহরগুলোর প্রধান সড়কে ইজিবাইক চলাচল নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি ব্যাটারিচালিত রিকশা এবং এর যন্ত্রাংশ আমদানি বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সংগঠনটির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, দেশের সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে ৪০ লাখ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিবন্ধন ও চালকের হাতে নামমাত্র ফিতে লাইসেন্স প্রদান করা গেলে বছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হতে পারে। একইসাথে ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা জাতীয় মহাসড়কে চলাচল কঠোরভাবে বন্ধ করা, রাজধানীসহ দেশের শহরগুলোর প্রধান সড়কে ইজিবাইক চলাচল নিষিদ্ধ করা এবং জরুরিভিত্তিতে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও যন্ত্রাংশ আমদানি বন্ধ করতে হবে।

টিএই/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর