ঢাকার সড়কে এখন গলার কাঁটা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। গত কয়েক মাস থেকে ট্রাফিক বিভাগ এই যানটিকে প্রতিরোধে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় পরীক্ষামূলক ট্র্যাপার বসানো হয়েছে। তাতে ফলও মিলেছে। এখন সেগুলোর সংখ্যা বাড়িয়ে নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে আরও বসানো হবে। এছাড়া এই রিকশা প্রতিরোধে হচ্ছে নতুন নীতিমালা। এটির কাজও চলমান।
ডিএমপি ও সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিজ্ঞাপন
গত কয়েক দিন মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালনকারী কয়েকজন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছে ঢাকা মেইলের পক্ষ থেকে। তারা জানিয়েছেন, সারাদিন রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সম্প্রতি অটো বা ব্যাটারিচালিত রিকশার জ্বালায় তারা অতিষ্ঠ। অলিগলি থেকে হুট করে রিকশাগুলো সড়কে চলে আসছে। সেই রিকশাকে ধরে রাস্তা থেকে বের করে দিতে চাইলেই ট্রাফিক সদস্যের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক এমনকি মারামরি পর্যন্ত বাধছে। বিষয়টিতে অনেকে ভিডিও ধারণ করে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এতে নেতিবাচক বার্তা যাচ্ছে। এসব কারণে সড়কে ট্রাফিকের পাশাপাশি ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের কাজ কঠিন হচ্ছে।
তারা আরও জানিয়েছেন, গত কয়েক মাস ধরে রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি কাজ করছেন ছাত্র বা জুলাই আন্দোলনের কর্মীরা। তারা যানজট নিরসনে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন। তাদের নিয়োগ দিয়েছে ডিএমপি। এসব ছাত্রকে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজের পাশাপাশি বাড়তি ব্যাটারিচালিত রিকশাকেও সামাল দিতে হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
ধানমন্ডি এলাকায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন মহি নামে এক ছাত্র। তিনি বলছিলেন, আমরা এখন যানজট নিরসনের বাইরে রিকশাকে নিয়ন্ত্রণ করি। কোনো রিকশা অলিগলি থেকে বের হয়ে মূল সড়কে আসার চেষ্টা করলেই থামিয়ে দিচ্ছি। এতেও তারা কথা শুনে না। আমরা ছাত্র বলে আমাদের নানাভাবে হেনস্তার চেষ্টা করে।
মামলা ও জরিমানা চ্যালেঞ্জ
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের ব্যাপারে ডিএমপির ওপর মহল বেশ উদ্বিগ্ন। প্রথম দিকে গাড়িগুলো ধরে ধরে মামলা দেওয়া হতো। কিন্তু সেই অবস্থান থেকে তারা এখন সরে এসেছেন। এখন প্রতিটি গাড়ি মূল সড়কে এলেই ডাম্পিংয়ে পাঠানো হচ্ছে।

ধানমন্ডি এলাকায় কাজ করেন এমন একজন সার্জেন্ট বলছিলেন, আমরা কাজ করছি। একদম হার্ডলাইনে আছি। মূল সড়কে এলেই ডাম্পিং করা হচ্ছে। ক্যাবল বা তার কেটে দেওয়ার পর ডাম্পিংয়ে পাঠানো হচ্ছে। ব্যাটারি তো খুলে নেওয়া যায় না। কারণ সেগুলো যেহেতু দাহ্য পদার্থ। শুধু সেটির ক্যাবল কর্তন করছি। এতেও অনেকে কথা শুনছে না। তবে আমরা ডাম্পিং স্টেশনগুলোতে অভিযান শুরু করব। প্রথম দিকে যে নির্দেশনা ছিল তা এখনো বহাল। কোনো ব্যাটারিচালিত রিকশা মূল সড়কে আসতে পারবে না।
আরেকজন বলেন, আসলে এসব যানের জরিমানা করাও একটা চ্যালেঞ্জ। কারণ সেগুলোর তো ডকুমেন্ট নেই। ফলের ফাইন করাও কঠিন। মামলা কীভাবে দেব! তার তো ড্রাইভিং লাইসেন্সই নাই। তাছাড়া যানটি অনিবন্ধিত।
তবে সারা শহর যখন এধরনের রিকশার জ্বালায় অতিষ্ঠ তখন গুলশান ট্রাফিক বিভাগ সেই এলাকার মূল সড়কে কোনো ব্যাটারিচালিত রিকশা চলতে দিচ্ছে না। যদিও বিষয়টি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে গত মাসে নানা ঝামেলা পোহাতে হয়েছে তাদের। তবে তারা সফলও হয়েছেন। তাদের এখন সহায়তা করছে পায়ে প্যাডেল চালিত রিকশার চালক ও মালিকরা।
সিটি করপোরেশন যা বলছে
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান ঢাকা মেইলকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয় কাজ করছে। তারা সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আমাদের জানাবে। আমরা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। তবে আমরা কোনো ব্যাটারিচালিত রিকশার অনুমোদন দিচ্ছি না।

এদিকে দুই সিটি করপোরেশনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন সংস্থাটির আঞ্চলিক ও প্রধান কার্যালয়ে লাইসেন্স পাওয়ার জন্য লোকজন ভিড় করছে। যদিও এখনো এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি সিটি কর্তৃপক্ষ। তারা আগের সিটি করপোরেশনের লোকদের দিয়ে তদবিরও করছেন। কেউ কেউ বিষয়টিকে জায়েজ করার জন্য বিভিন্ন সময়ে চালক ও বহিরাগত লোকদের দিয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা প্রধান সড়কে চালুর দাবিতে আন্দোলনও করাচ্ছে।
হচ্ছে নতুন নীতিমালা
ঢাকা সিটি করপোরেশন, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় ও ঢাকা মহানগর পুলিশ যৌথভাবে এসব রিকশা প্রতিরোধ ও বন্ধে কাজ করছে। এ নিয়ে যখন আন্দোলন তুঙ্গে সেই মুহূর্তে মন্ত্রণালয় নীতিমালা তৈরির কাজ হাতে নিয়েছে। সেই কাজও এগিয়ে চলছে। এই নীতিমালায় একজন চালকের প্রশিক্ষণ, কোন রুটে কতটি গাড়ি চলবে, কখন কখন চলবে, গাড়ির ফিটনেট ব্যবস্থা কেমন হবে এবং কোন কোন কোম্পানি এটি উৎপাদন করতে পারবে তা ঠিক করে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। এর ফলে ব্যাটারি চালিত রিকশার উৎপাত অনেকাংশে কমে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ঢাকায় কারা কারা বিনা অনুমতিতে এসব অননুমোদিত যান তৈরি করে বাজারে ছাড়ছে তাও দেখভালের ব্যবস্থা থাকবে। কেউ বিনা অুনমতিতে তৈরি করে বাজারজাত করলেই তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মো. সরোয়ার ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা ট্র্যাপার বসিয়ে সফলতা পেয়েছি। ফলে বিষয়টিকে জোর দিয়ে এর সংখ্যা বাড়ানো হবে। এছাড়াও আমরা যাতে কোনো রিকশা প্রধান সড়কে আসতে না পারে সেজন্য কাজ করছি। নতুন নীতিমালাও হচ্ছে। এ নীতিমালা অনযায়ী ঢাকায় এসব রিকশা চলবে। তবে মূল সড়কে নয়। তবে উৎপাদন বন্ধেও নীতিমালা হচ্ছে।’
নগরীতে বসবে ৪০০ ট্র্যাপার
ঢাকা মহাগর ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার রমনা, ধানমন্ডিসহ আরও কয়েকটি স্থানে রিকশা প্রতিরোধে ট্র্যাপার বসিয়ে সুফল মিলেছে। এই ট্র্যাপার গলিতে মাত্র ৫ শতাংশ রিকশা যাতায়াত করতে পারছে। বাকি রিকশার চালকরা ভয়ে যাচ্ছে না। ফলে বিষয়টিতে সফলতা মিলেছে ধরে নিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, ট্র্যাপারে সুফল মিলছে। রিকশার চালকরা এসব মাড়িয়ে যেতে চান না। যদিও রিকশার যাত্রীরাই বেশি উদ্বুদ্ধ করেন। ঝুঁকি সত্ত্বেও অনেকে রিকশা নিয়ে এসব ট্র্যাপার পার হন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ৪০০ ট্র্যাপার বসতে যাচ্ছে। এ বিষয়ে চূড়ান্ত আলোচনা করেছেন তারা। তাদের সাহায্য করছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন।
নগরবাসীকে এসব রিকশায় না ওঠার আহ্বান
ব্যাটারি চালিত রিকশা অলিগলিতে আস্তে ধীরে চলাচল করলেও প্রধান সড়কে এসে গতি বাড়িয়ে দেন চালকরা। ফলে প্রতিনিয়ত নানা দুর্ঘটনা ঘটছে। তবে চালকের চেয়ে যাত্রীরাই এসব যানে চড়তে আগ্রহী বেশি বলে জানিয়েছেন ট্রাফিক সদস্যরা।
তাদের মতে, চালকরা বেশির ভাগ সময় প্রধান সড়কে আসতে চান না। কিন্তু যাত্রীরা তাদের সুবিধার্থে চালকদের জিম্মি করে প্রধান সড়কে নিয়ে আসছেন। ফলে পুলিশ সেই রিকশাকে আটকে দিলে বা ধরলে যাত্রীরা তাদের ওপর হামলাও করে বসছে।
সম্প্রতি এমন একটি ঘটনা ঘটেছে রাজধানীতে। এক নারী যাত্রীকে নিয়ে রিকশা চালক আসছিলেন। প্রধান সড়কে ওঠামাত্র ট্রাফিক সদস্য সেটি আটকে দেন। আর যেতে দেননি। কিন্তু এ বিষয় নিয়ে নারী যাত্রী ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং সেই ট্রাফিক সদস্যের ওপর তার হাতে থাকা ভ্যানিটি ব্যাগ দিয়ে হামলা করে বসেন। পরে সেই ট্রাফিক সদস্য থানা পুলিশকে জানান। তারা ছুটে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে এবং সেই নারীর বিরুদ্ধে ট্রাফিক বিভাগ আইনি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মো. সরোয়ার বলেন, আমরা নগরবাসীকে অনুরোধ করব। আপনারা এই ঝুঁকিপূর্ণ যানটি এড়িয়ে চলুন। এর অতিরিক্ত গতির কারণে প্রতিনিয়ত নগরীতে নানা জায়গায় দুর্ঘটনার খবর পাচ্ছি আমরা। নগরবাসী এসব গাড়িতে না উঠলেই বন্ধ হয়ে যাবে। ব্যাটারিচালিত রিকশা প্রতিরোধে নগরবাসীকেই সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। নয়ত এটি প্রতিরোধ করা পুলিশের একার পক্ষে সম্ভব নয়।
এমআইকে/জেবি