পাকিস্তান ক্রিকেট লম্বা সময় ধরেই কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ম্যান ইন গ্রিনরা গত বছর ওয়ানডে বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছিল অন্যতম ফেভারিট হিসেবে। তবে ভারতে অনুষ্ঠিত সেই টুর্নামেন্টে তারা সেমিফাইনালেও ওঠতে পারেনি। এরপর অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হতে হয়েছে, নিউজিল্যান্ড সফরে টি-টোয়েন্টি সিরিজেও হেরেছে শাহিন আফ্রিদিরা।
পাকিস্তান ক্রিকেটে ধারাবাহিক ব্যর্থতার তালিকায় সবশেষ সংযোজন ছিল চলতি বছর অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাজে পারফর্ম্যান্স। এ টুর্নামেন্টে গ্রুপ পর্বে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটি জয়ের পথে থাকলেও শেষ পর্যন্ত অল্প ব্যবধানে হারে ম্যান ইন গ্রিনরা। পরাজিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও, ফলে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায়ও নিতে হয় সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটের ক্রিকেটের সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের।
বিজ্ঞাপন
জুনে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে ব্যর্থ হয়ে ফেরার পর লম্বা বিরতিতে ছিলেন ম্যান ইন গ্রিনরা। এরই মধ্যে শাহিন আফ্রিদিদের লাল বলের প্রধান কোচ হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন সাবেক অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার জেসন গিলেস্পি। ব্যর্থতার চক্র ভেঙে সফলতার মুখ দেখতে নতুন কোচের অধীনে ঘরের মাঠে বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে খেলতে নেমেছিল পাকিস্তান। তবে টাইগারদের বিপক্ষে এই সিরিজটিও ২-০ ব্যবধানে হেরেছে শান মাসুদের দল। ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডের পর দ্বিতীয় দল হিসেবে পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করে সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ।
পাকিস্তানের মতোই বাজে সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন দেশটির তারকা ক্রিকেটার বাবর আজম। দেশটির তিন ফরম্যাটের ক্রিকেটের অধিনায়ক ছিলেন তিনি, তবে ওয়ানডে বিশ্বকাপে ব্যর্থতার দায় নিয়ে সব সংস্করণের অধিনায়ক পদ ছাড়েন তিনি। এরপর আবার তাকে ক্যাপ্টেন হিসেবে ফেরানো হয়েছে, তবে সেটি কেবল টি-টোয়েন্টিতে, যদিও এই সংস্করণে তিনি কতদিন দলের নেতা হিসেবে থাকতে পারবেন সেটিও অনিশ্চিত।
বিজ্ঞাপন
তবে ভক্ত-সমর্থকরা বাবরকে নিয়ে উদ্বিগ্ন আরও একটি কারণে। পাকিস্তান দলকে নেতৃত্ব দেয়ার ভার হারানোর পাশাপাশি তাঁর ব্যাটিংও জৌলুশ হারিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর পারফর্ম্যান্সেই তা স্পষ্ট যা মানতে পারছেন না সমর্থকরা। টি-টোয়েন্টিতে তিনি যে ধাচে ব্যাট করেন তা নিয়ে আগে থেকেই সমালোচনা আছে, ওয়ানডেতে তিনি এখনো বেশ মানানসই থাকলেও টেস্ট ক্রিকেটে তিনি লম্বা সময় ধরেই ব্যর্থতার বৃত্তে বন্দী আছেন।
সাদা পোশাকে বাবরের এমন হতাশাজনক পারফর্ম্যান্স মেনে নিতে পারছেন না তাঁর একনিষ্ঠ সমর্থকরাও। বিশেষ করে ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তিনি যে ব্র্যান্ডের ক্রিকেট খেলেছেন তা যেন এখন হ্যালির ধূমকেতু হয়ে ওঠেছে।
২০১৯ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ঘরে-বাইরে মিলিয়ে যেসব টেস্ট সিরিজ খেলেছে পাকিস্তান সেসবের অধিকাংশ সিরিজেই বাবর ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল। এই সময়ে সাদা পোশাকে তাঁর ব্যাটিং গড় ছিল প্রায় ৬০ এর কাছাকাছি। প্রতিপক্ষের মাঠে টেস্ট সিরিজ গুলোতেও তিনি প্রচুর রানের দেখা পেয়েছেন, ২০১৯-২৪ এই চার বছরের মধ্যে শ্রীলঙ্কায় তাঁর ব্যাটিং গড় ছিল প্রায় ৭০ এর কাছাকাছি, অস্ট্রেলিয়ায় ছিল ৫০ এর উপরে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং ইংল্যান্ডেও তিনি ৫০ এর কাছাকাছি গড়ে রান করেছেন।
সেই একই সময়ে ঘরের মাঠে বাবরের ব্যাটিং গড় ছিল ৮০ এর উপরে। তারকা এই ব্যাটার শুধু জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই ভালো খেলতে এমন কথাও সাম্প্রতিক সময়ে অনেকেই ব্যাঙ্গ করে বলেছেন। তবে ২০১৯-২২ সময়ে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাবরের ব্যাটিং গড় মাত্র ১। এই সময়কালে বাবরের পারফর্ম্যান্স দেখে ভক্ত-সমর্থকরা তাকে ফ্যাব ফোরের সঙ্গেও তুলনা করেছেন। আলোচনাটা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, হয় ফ্যাব ফোরকে সম্প্রসারণ করতে হবে, নয়তো কাউকে সরিয়ে তাকে জায়গা করে দিতে হবে- এমন দাবীও করেছেন অনেক সমর্থক।
কিন্তু পরের বছর থেকেই মুদ্রার ওল্টো পিঠ দেখতে শুরু করেন পাকিস্তানের আধুনিক ক্রিকেটের সেরা এই ব্যাটার। ২০২৩ সাল থেকে শুরু করে গতকাল শেষ হওয়া বাংলাদেশ সিরিজের আগ পর্যন্ত সাদা পোশাকে বাবর ৩৭.৪২ গড়ে ব্যাট করেছেন। এই সময়ের মধ্যে ৯ টি টেস্ট খেলে তিনি কেবল একটি সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছেন। বাংলাদেশের সিরিজের ২ টেস্ট বিবেচনায় নিলে এ তালিকা আরও দীর্ঘই হচ্ছে। একমাত্র সেই শতকটিও এসেছে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা সেই ১৬১ রানের ইনিংসের পর থেকে বাবর সাদা পোশাকে রান করেছেন যথাক্রমে ১৪, ২৪, ২৭, ১৩, ২৪, ৩৯, ২১, ১৪, ১, ৪১, ২৬, ২৩। সবশেষ বাংলাদেশ সিরিজেও চার ইনিংসে তিনি করেছেন যথাক্রমে ০, ২২, ৩১ এবং ১১ রান। সবশেষ এই ১৬ ইনিংস লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তিনি ক্রিজে সেট হয়েছেন তবে এরপর আর বড় রানের দিকে এগোতে পারেননি।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়া সিরিজেও বাবর বেশ কয়েকবার ক্রিজে সেট হয়েছিলেন, তবে সেসব মাচেও পেসারদের বিপক্ষে তাকে ভুগতে হয়েছে বেশ। ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময়ে বাবর লেগ বিফোর উইকেট বা বোল্ড আউট হয়েছেন ৪১ ইনিংস খেলে ১১ বার। কিন্তু এরপর ১৭ ইনিংসেই তিনি ৮ বার এভাবে আউট হয়েছেন। গত কয়েক বছরে বাঁহাতি স্পিনারদের বিপক্ষে তাঁর দুর্বলতা লক্ষ্য করা গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে ডান হাতি পেসারদের বিপক্ষেও তাঁর দুর্বলতা লক্ষ্য করা গেছে।
সবশেষ অস্ট্রেলিয়া সফরে ৬ ইনিংসে তিনবারই তিনি আউট হয়েছে প্যাট কামিন্সের বলে, এছাড়া মিচেল মার্শ, জশ হ্যাজলউডরাও তাকে বেশ ভুগিয়েছেন। বাংলাদেশ সিরিজে চার ইনিংসে দুইবারই তিনি তরুণ পেসার নাহিদ রানার শিকারে পরিণত হয়েছেন, একবার করে তাকে আউট করেছেন শরিফুল ইসলাম এবং সাকিব আল হাসান।
লম্বা সময় ধরে বাবরের এমন ব্যর্থতার কারণ কি তা নির্দিষ্ট করে বলা শক্ত। তবে এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে হলে নিজের ব্যাটিং কৌশল নিয়ে গভীরভাবে কাজ করতে হবে। এদিকে ব্যক্তিগত ব্যর্থতার মতই পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ব্যর্থতার পেছনেও তিন ফরম্যাটের সাবেক অধিনায়ক বাবরের দায় আছে বলেই মনে করছেন ম্যান ইন গ্রিনদের সাবেক প্রধান নির্বাচক মোহাম্মদ ওয়াসিম।
সম্প্রতি পাকিস্তানের স্থানীয় এক সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সত্যি বলছি বাবরের সঙ্গে কাজ করাটা খুব যন্ত্রনাদায়ক। দলে পরিবর্তন করার যে সুফল সেটা ওঁকে বোঝাতে যাওয়াটা খুব যন্ত্রনাদায়ক ছিল। ও খুব খুব জেদি ছিল। আমি সত্যি বলছি ওঁর সঙ্গে কাজ করাটা সমস্যার। ওকে দলের অধিনায়ক করতে আমি অনেক লড়াই করেছি। নিজের ক্ষমতার বাইরে গিয়েও লড়াই করেছি। কিন্তু ওঁকে আমি দলে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে পারিনি। কোন রকম কোন পরিবর্তনকে মেনে নেওয়ার পক্ষেই ও ছিল না।’
ওয়াসিম আরও বলেন, ‘আমি কারোর নাম নেব না। তবে এটা বলব যে এর আগে চারজন প্রাক্তন কোচ এক কথা বলেছিলেন। তাদের বক্তব্য ছিল বেশ কিছু ক্রিকেটার দলের জন্য ক্ষতিকারক হয়ে উঠছে। তারা কার্যত দলের ক্যান্সার। দলের উন্নতিতে তারা বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এদেরকে পরিবর্তন করা প্রয়োজন। এদেরকে না সরালে পাকিস্তান জয় (আইসিসি টুর্নামেন্টে) পাবে না। আমি তাদেরকে দল থেকে সরানোর চেষ্টা করি। কিন্তু টিম ম্যানেজমেন্ট তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়।তাদেরকে দলে ফেরত নিয়ে আসে।’
চলতি বছর এবং আগামী বছর মিলিয়ে সামনে পাকিস্তান আরও ৭টি টেস্ট খেলবে। ঘরের মাঠে ইংল্যান্ড সিরিজ এবং এরপর দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাবে পাকিস্তান। হাই প্রোফাইল এই দুই সিরিজের পর পাকিস্তান সফর করবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আসন্ন এই ম্যাচগুলো দিয়েই বাবর আজম নিজের সেরা ছন্দে ফিরে আসবেন নাকি ধারাবাহিক ব্যর্থতার জেরে জায়গা হারাবেন দলে, এমন প্রশ্নই এখন অনেক সমর্থকের মনে।