ঘটনাটি মুসা (আ.)-এর যুগের। ফেরাউনের দাসত্ব থেকে মুক্তিলাভের পর বনি ইসরাইলকে আল্লাহ তাআলা কিছু নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। একইসঙ্গে তাদের পৈতৃক দেশ শামকেও (বর্তমান সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও বায়তুল মুকাদ্দাস) তাদের অধিকারভুক্ত করার সুসংবাদ দেন। সেটি বাস্তবায়নের জন্য মুসা (আ.)-এর মাধ্যমে তাদের জিহাদ করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
কিন্তু বনি ইসরাইল ছিল প্রকৃতিগতভাবেই বক্র স্বভাবের। তাদেরকে আল্লাহ তাআলা অসংখ্য নেয়ামত দিয়েছেন এবং একের পর এক নবী পাঠিয়ে সম্মানিত করেছেন। তবুও তারা ছিল নাশোকর জাতি। ফেরাউনের সাগরডুবি, মুসা (আ.)-এর মোজেজা ও তাদের মিসর অধিকার ইত্যাদি দেখেও তারা আল্লাহর নির্দেশের বিরুদ্ধে অন্যায় জেদ ধরে বসে থাকল। কারণ তাদের মতে শামের বিরুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব নয়।
বিজ্ঞাপন
পবিত্র কোরআনে তাদের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে—‘তারা বলল, হে মুসা, নিশ্চয়ই সেখানে এক দুর্দান্ত সম্প্রদায় আছে এবং তারা সে স্থান থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত আমরা কখনো সেখানে কিছুতেই প্রবেশ করব না। অতঃপর তারা সেখান থেকে বের হয়ে গেলে তবে নিশ্চয় আমরা সেখানে প্রবেশ করব।’ (সুরা মায়েদা: ২২)
বিভিন্ন তাফসিরে এসেছে, তখন সিরিয়া ও বায়তুল-মুকাদ্দাস আমালেকা সম্প্রদায়ের দখলে ছিল। তারা ছিল আদ সম্প্রদায়ের একটি শাখা। দৈহিক দিক দিয়ে তারা অত্যন্ত সুঠাম, বলিষ্ঠ ও ভয়াবহ আকৃতিবিশিষ্ট ছিল। তাই বনী-ইসরাইল নবীর কথার কর্ণপাত করল না, উপরন্তু বিশ্রী ভঙ্গিতে ‘তারা বলল, ‘হে মুসা, তারা যতক্ষণ সেখানে থাকবে ততক্ষণ আমরা সেখানে কখনো প্রবেশ করব না; কাজেই তুমি আর তোমার রব গিয়ে যুদ্ধ করো। নিশ্চয়ই আমরা এখানেই বসে থাকব।’ (সুরা মায়েদা: ২৪)
আরও পড়ুন: নবী-রাসুলদের কার কী পেশা ছিল
পরিণতিতে মহান আল্লাহ তাদের শাস্তি দেন। তারা ৪০ বছর পর্যন্ত একটি সীমাবদ্ধ এলাকায় অবরুদ্ধ ও বন্দি হয়ে রইল। বাহ্যত তাদের চারপাশে কোনো বাধার প্রাচীর ছিল না এবং তাদের হাত-পা শেকলে বাধা ছিল না; বরং তারা ছিল উন্মুক্ত প্রান্তরে। পবিত্র কোরআনে এই অদ্ভুত শাস্তি এভাবে বর্ণিত হয়েছে—
বিজ্ঞাপন
‘তিনি (মুসা) বলেন, ‘হে আমার রব, আমি ও আমার ভাই ছাড়া আর কারো ওপর আমার অধিকার নেই। সুতরাং আপনি আমাদের ও অবাধ্য সম্প্রদায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ করে দিন। তিনি (আল্লাহ) বলেন, যুদ্ধ থেকে বিরত থাকার জন্য তাদের এই শাস্তি দেওয়া হয়েছিল যে তারা ৪০ বছর যাবত দিন-রাত সকাল-সন্ধ্যা তিহ ময়দানে উদ্দেশ্যহীনভাবে ভবঘুরে জীবন যাপন করবে। সুতরাং আপনি ফাসিক কওমের জন্য আফসোস করবেন না।’ (সুরা মায়েদা: ২৫-২৬)
আরও পড়ুন: জাদুকরদের নিয়ে ফেরাউনের রাজনীতি
তাফসিরের কিতাবে এসেছে, তারা স্বদেশে অর্থাৎ মিসর ফিরে যাওয়ার জন্য প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পথ চলত; কিন্তু তারা নিজেদের সেখানেই দেখতে পেত, যেখান থেকে সকালে রওনা হয়েছিল। ইত্যবসরে মুসা ও হারুন (আ.)-এর মৃত্যু হয়ে যায় এবং বনি ইসরাঈল তিহ প্রান্তরেই উদ্ভ্রান্তের মতো ঘোরাফেরা করতে থাকে। অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাদের হেদায়াতের জন্য অন্য একজন নবী পাঠালেন। ৪০ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর বনী ইসরাঈলের অবশিষ্ট বংশধর তৎকালীন নবীর নেতৃত্বে শাম দেশের সে এলাকা তথা সিরিয়া ও বায়তুল মুকাদ্দাসের জন্য জিহাদের সংকল্প গ্রহণ করে এবং আল্লাহ তাআলার ওয়াদাও পূর্ণতা লাভ করে। (ইবনে কাসির)
‘জিহাদের নির্দেশ অমান্য করার শাস্তি ৪০ বছর নির্ধারণের কারণ সম্ভবত এই ছিল যে, এ সময়ের মধ্যে অধিকাংশের মৃত্যু হবে, দীর্ঘদিন ফেরাউনের দাসত্বের কারণে যাদের ইজ্জতের জীবন যাপনের প্রাণশক্তি অবশিষ্ট ছিল না। পরবর্তীতে যারা সেই কঠোর প্রতিকুল অবস্থায় জন্মলাভ করেছিল তারাই শত্রুদের পরাভূত করার মত সাহসী হতে পেরেছিল।’ (সাদি)
এভাবেই মহান আল্লাহর অসংখ্য নেয়ামত ভোগ করেও যারা তাঁর ওপর আস্থা রাখে না, তাদের জীবন উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়ে। হতাশা, ব্যর্থতা, গুনাহ ও দুঃখের আবর্তে তারা আটকে পড়ে। দুনিয়ার সব শান্তির উপকরণ দিয়েও তাদের আত্মিক শান্তি অর্জন হয় না। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে বনী ইসরাইলের এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার তাওফিক দান করুন। বাধ্য অনুগত মুসলিম হিসেবে আমাদের কবুল করুন। আমিন।