কোরআন-হাদিসে বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে হজরত মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের ওপর ফেরাউনের অত্যাচারের ঘটনা অন্যতম। সত্যের আওয়াজ স্তব্ধ করার জন্যে এমন কোনো অমানবিক পদক্ষেপ বাকি ছিল না, যা সে গ্রহণ করেনি। মুসা (আ.)-এর বিরুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর নিজের জাদুকরদের বিরুদ্ধেও সে রাজনৈতিক কূটচালের আশ্রয় নিয়েছিল।
একদিন মুসা (আ.) তার বড় ভাই হারুনকে সঙ্গে নিয়ে ফেরাউনের দরবারে এসে হাজির হলেন। ফেরাউনকে উদ্দেশ্য করে মুসা (আ.) বললেন, ‘আপনি যে নিজেকে খোদা বলে প্রচার করছেন, তা অত্যন্ত অন্যায়। সর্বশক্তিমান আল্লাহ ছাড়া আর কেউ মানবের উপাস্য নেই। আমি আল্লাহর প্রেরিত পয়গম্বর’। ফেরাউন তাকে তাচ্ছিল্য করে বলল, ‘কেমন করে বুঝবো যে, খোদাই তোমাকে পাঠিয়েছে? তুমি কি কোনো প্রমাণ দিতে পারবে’?
বিজ্ঞাপন
মুসা (আ.) তার হাতের লাঠি মাটিতে ফেলে দিলেন, সঙ্গে সঙ্গে সেই লাঠি এক ভয়ানক সাপে পরিণত হলো। তার মুখ হতে আগুনের ফুল্কি বের হতে লাগলো। সেই আগুনে গাছপালা, মানু্ষ, পশু-পাখি পুড়ে ছাই হয়ে যেতে লাগলো। ফেরাউন ছুটে গিয়ে মুসা (আ.)-এর হাত ধরে এসব বন্ধ করার অনুরোধ করল। মুসা (আ.) আবার অজগরের গায়ে হাত দিতেই সেটি পুনরায় লাঠিতে পরিণত হলো।
মুসা (আ.) তখন ফেরাউনকে বললেন, ‘আশা করি আপনি এখন অহঙ্কার ত্যাগ করে ধর্মপথে আসবেন’। ফেরাউন বিবেচনা করে পরের দিন জবাব দেবে বলে সেদিন মুসাকে (আ.) চলে যেতে বলে। মুসা (আ.) চলে গেলেন। এ বিষয়ে ফেরাউন উজির-নাজিরদের সঙ্গে পরামর্শ করে। কুচক্রী এবং কূটবুদ্ধিসম্পন্ন উজির হামান তাকে বুঝিয়ে দিল যে, মুসা (আ.)-কে জব্দ করার একমাত্র কৌশল রাজ্যের যত বড় বড় জাদুকর আছে সবাইকে ডাকতে হবে। তাদের প্রত্যেকের বিদ্যাবুদ্ধির কাছে হার মেনে মুসা সেখান থেকে পালিয়ে যাবে।
হামানের পরামর্শ অনুযায়ী দক্ষ জাদুকরদের জড়ো করেছিল ফেরাউন। তাদের মধ্যে প্রসিদ্ধ পাঁচ জাদুকর ছিল শামউন, সাদুর, গাদুর, খতাত ও মুসাফা। শামউন অন্য চারজনের গুরু ছিল। জাদুর প্রতিযোগিতা হয়েছিল মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে। সেখানে স্থানীয় অধিবাসীরা, ফেরাউনের সভাসদ ও সেনা-সামন্তরা উপস্থিত ছিল। ফেরাউন নিজেও একটি মঞ্চে বসে এ দৃশ্য দেখছিল। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতঃপর মুসা মনে মনে কিছুটা ভীতি অনুভব করলেন’ (সুরা ত্বহা: ৬৭)। ‘আমি বললাম- ভয় করো না, তুমি বিজয়ী হবে।’ (সুরা ত্বহা: ৬৮)
জাদুকররা হজরত মুসা (আ.)-কে অলৌকিক বিষয় প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা শুরু করার আহ্বান জানালে তিনি সবিনয়ে তাদেরকেই আগে শুরু করতে বলেন। তারা মাটিতে দণ্ড ও দড়ি রেখে সম্মোহনী জাদু-বিদ্যার প্রয়োগ শুরু করে, ফলে উপস্থিত জনতার দেখল- প্রাণহীন দণ্ড ও রশিগুলো হঠাৎ করে সাপের মত নড়েচড়ে এগিয়ে আসছে। ফেরাউন ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের মুখে এ সময় ছিল বিজয়ের হাসি।
বিজ্ঞাপন
মহান আল্লাহ মুসা (আ.)-এর উদ্দেশে বলেন, ‘তোমার ডান হাতে যা আছে তা নিক্ষেপ করো। এটি তারা যা করেছে তা গ্রাস করে ফেলবে। তারা যা করেছে তা শুধু জাদুকরের কৌশল। জাদুকর যেখানেই আসুক, সফল হবে না। (সুরা ত্বহা: ৬৯)
তখন হজরত মুসা (আ.) তাঁর লাঠি নিক্ষেপ করলে সেটি এক বিশাল অজগরে পরিণত হয় এবং তা জাদুকরদের সব সাপ, কল-কাঠি গিলে ফেলে। ফলে পরিস্থিতি ও পরিবেশ পাল্টে যায়। অনেকে ভয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে। ফেরাউন ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা এমন অপ্রত্যাশিত দৃশ্য দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
জাদুবিদ্যা বিশেষজ্ঞ জাদুকরদের বুঝতে বাকি রইল না যে, এই কাজ জাদুর জোরে হতে পারে না; বরং নিঃসন্দেহে এটা মোজেজা। তাই তারা আত্মসমর্পণ করে এবং ঈমান আনার ঘোষণা দেয়। ‘অতঃপর জাদুকররা সিজদাবনত হলো এবং বলল, আমরা হারুন ও মুসার রবের প্রতি ঈমান আনলাম।’ (সুরা ত্বহা: ৭০)
জাদুকরদের পরাজয়ের পর ফেরাউন তার রাজনৈতিক কূটচালের মাধ্যমে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। ফেরাউন নিজের জাদুকরদের বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করল। বলল, এই জাদুকররা সবাই মুসার শিষ্য। তারা চক্রান্ত করেই তার কাছে নতি স্বীকার করেছে। এটা একটা পাতানো খেলামাত্র। পবিত্র কোরআনে ফেরাউনের সেই কূটচালের বিষয়টি এসেছে এভাবে—
‘ফেরাউন বলল, ‘কী, আমি তোমাদেরকে অনুমতি দেয়ার আগেই তোমরা তার প্রতি ঈমান আনলে? নিশ্চয় সে-ই তোমাদের প্রধান, যে তোমাদেরকে জাদু শিখিয়েছে। সুতরাং আমি অবশ্যই তোমাদের হাত ও পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলব এবং আমি তোমাদেরকে খেজুর গাছের কাণ্ডে শূলিবিদ্ধ করবই। আর তোমরা অবশ্যই জানতে পারবে, আমাদের মধ্যে কার আজাব বেশি কঠোর এবং বেশি স্থায়ী।’ (সুরা ত্বহা: ৭১)
সে আরো বলল, হে জনগণ, এ লোকটি তোমাদের ধর্ম পরিবর্তন করে দেবে এবং দেশময় বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। (সুরা মুমিন/গাফির:২৬)। এভাবে ফেরাউন জাদুকরদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু জাদুকররা তাদের ঈমান ও বিশ্বাসের ব্যাপারে অবিচল থাকে। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে নবী-রাসুলদের জীবনী থেকে শিক্ষা নেওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।