জান্নাত আরবি শব্দ। অর্থ বাগান বা উদ্যান। প্রচলিত অর্থে বেহেশত। ইসলামি পরিভাষায়, পার্থিব জীবনে যেসব মুসলিম আল্লাহর আদেশ নিষেধ মেনে চলবে, পরকালের হিসাবে যাদের পুণ্যের পাল্লা ভারী হবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করবে তাদের জন্য আল্লাহ তৈরি করে রেখেছেন জান্নাত। যারা জান্নাতে প্রবেশ করবেন তারা অনন্তকাল জান্নাতেই থাকবেন। জান্নাত চিরস্থায়ী ভোগ-বিলাসের স্থান। যেখানে মৃত্যু নেই, রোগ-বালাই নেই, বার্ধক্য নেই।
জান্নাতের সুশীতল ছায়া, আপ্যায়ন, পানীয়, চক্ষু শীতলকারী নারীসঙ্গী, পরিবেশকগণ, বহুতলবিশিষ্ট সুউচ্চ মনোরম প্রাসাদ, বাগান, ঝর্ণা, জান্নাতিদের প্রতি অভিবাদন এবং সবকিছুর ওপরে আল্লাহর সন্তুষ্টি—সকল নেয়ামতে পরিপূর্ণ থাকবেন চিরস্থায়ী জান্নাতিরা। জান্নাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে রাসুল (স.) বলেন, ‘মহান আল্লাহ বলেছেন, আমি আমার নেককার বান্দাদের জন্য এমন জিনিস তৈরি করে রেখেছি, যা কোনো চক্ষু দেখেনি, কোনো কান শোনেনি এবং যার সম্পর্কে কোনো মানুষের মনে ধারণাও জন্মেনি। তোমরা চাইলে এ আয়াতটি পাঠ করতে পারো, ‘কেউ জানে না, তাদের জন্য তাদের চোখ শীতলকারী কী জিনিস লুকানো আছে।’ (সুরা সাজদাহ: ১৩; বুখারি: ৩২৪৪)
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: দুই অঙ্গের সঠিক ব্যবহারে জান্নাতের নিশ্চয়তা
আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদের জন্য রয়েছে চির বসন্তের জান্নাত, যার পাদদেশে প্রবাহিত হতে থাকবে নদী, সেখানে তাদের সোনার কাঁকনে সজ্জিত করা হবে, সেখানে তারা সূক্ষ্ম ও পুরু রেশম ও কিংখাবের সবুজ বস্ত্র পরিধান করবে এবং উপবেশন করবে উঁচু আসনে বালিশে হেলান দিয়ে, চমৎকার পুরস্কার এবং সর্বোত্তম আবাস!’ (সুরা কাহাফ: ৩১)
‘অবশ্য মুত্তাকিদের জন্য সাফল্যের একটি স্থান রয়েছে। বাগ-বাগিচা, আঙুর, নবযৌবনা সমবয়সী তরুণীবৃন্দ এবং উচ্ছ্বসিত পানপাত্র। সেখানে তারা শুনবে না কোনো বাজে ও মিথ্যা কথা। প্রতিদান ও যথেষ্ট পুরস্কার তোমাদের রবের পক্ষ থেকে।’ (সুরা নাবা: ৩১-৩৬)
‘..যেখানে থাকবে বহমান ঝর্ণাধারা। সেখানে উঁচু আসন থাকবে, পানপাত্রসমূহ থাকবে। সারি সারি বালিশ সাজানো থাকবে এবং উৎকৃষ্ট বিছানা পাতা থাকবে’ (সুরা গাশিয়া: ৮-১৬)। ‘..সেখানে থাকবে পাক-পবিত্র স্ত্রীগণ এবং তারা সেখানে থাকবে চিরকাল।’ (সুরা বাকারা: ২৫)
বিজ্ঞাপন
হুর জান্নাতের একটি বিশেষ নেয়ামত। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে হুরদের দৈহিক অবয়বের বিবরণ দিয়েছেন। যেমন ‘তাদের করেছি কুমারি, সোহাগিনী, সমবয়ষ্কা’ (সূরা ওয়াকেয়া: ৩৬-৩৭)। ‘মুত্তাকিদের জন্য রয়েছে সাফল্য, উদ্যান, আঙ্গুর এবং স্ফীত স্তনবিশিষ্টা সমবয়সী বালিকা।’ (সুরা নাবা: ৩১-৩৩)
আরও পড়ুন: জান্নাতে পুরুষের জন্য হুর, নারীর জন্য কী?
জান্নাতে প্রতি জুমাবার বাজার বসবে। পৃথিবীর বাজারগুলোর চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা ওই বাজার। ওখান থেকে শারীরিক সৌন্দর্য বর্ধনের কোনো প্রসাধনী বা ফিটনেসের জন্যে কোনো ইন্সট্রুমেন্ট কিনতে হবে না জান্নাতিদের। বেচা-কেনা হবে না নতুন জামা বা অলংকারও। বাজারে এক বায়ুপ্রবাহেই জান্নাতিদের সৌন্দর্য বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। এমনকি ওই বাতাসে অপরূপ সাজে সজ্জিত হবে প্রকৃতিও।
হজরত আনাস বিন মালিক (রা.) বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে, ‘জান্নাতে একটি বাজার থাকবে। প্রত্যেক জুমার দিন জান্নাতি লোকজন সেখানে একত্রিত হবেন। এরপর উত্তর দিকের মৃদু বায়ু প্রবাহিত হয়ে সেখানকার ধুলোবালি তাদের মুখমণ্ডল ও পোশাক-পরিচ্ছদে গিয়ে লাগবে। এতে তাদের সৌন্দর্য বহুগুণে বেড়ে যাবে। শরীরের রং হয়ে উঠবে আরও আকর্ষণীয়। এরপর তারা নিজেদের পরিবারের কাছে ফিরে যাবে। এসে দেখবে, পরিবারের লোকদের শরীরের রঙ ও সৌন্দর্যও বহুগুণ বেড়ে গেছে। পরিবারের লোকেরা তাদের বলবে, আল্লাহর শপথ! আমাদের কাছ থেকে যাওয়ার পর তোমাদের সৌন্দর্য বেড়ে গেছে। উত্তরে তারাও বলবে, আল্লাহর শপথ! তোমাদের সৌন্দর্যও আমরা তোমাদের কাছ থেকে যাওয়ার পর বহুগুণে বেড়ে গেছে।’(মুসলিম: ২৮৩৩, ১৮৮৯)
‘যখনই কেউ কোনো ধরনের মুখাবয়ব ধারণ করতে চাইবে, সঙ্গে সঙ্গে সেই আকৃতি ধারণ করতে পারবে।’ (মেশকাত: ৫৬৪৬; তিরমিজি: ২৫৫০)
হাদিসে জান্নাতিদের ৬০ মাইল বিশিষ্ট মণি-মুক্তার তাঁবু দেওয়ার ঘোষণা এসেছে। আবদুল্লাহ ইবনু কায়স (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘জান্নাতে মুমিনদের জন্য ভেতর ফাঁকা মুক্তার তাঁবু হবে। এর প্রস্থ হবে ৬০ মাইল। এর প্রত্যেক প্রান্তেই পরিবার (স্ত্রী) থাকবে। তারা ঘুরে ঘুরে তাদের সঙ্গে মেলামেশা করবে, অন্যদের দেখতে পাবে না।’ (সহিহ মুসলিম: ৬৮৯৫)
আরও পড়ুন: জান্নাতের প্রাসাদ কেমন হবে?
জান্নাতিদের বিভিন্ন পাখির রান্না করা গোশত ও ভুনা রোস্ট সরবরাহ করা হবে সকাল-সন্ধ্যা। এসব পাখি হাওজে কাউসারসহ বিভিন্ন সমুদ্র ও ‘যানজিল’ নামক হ্রদে বিচরণ করবে। পাখিগুলো দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি ভিন্ন রকম স্বাদে ভরা। উড়ন্ত পাখির প্রতি নজর দিলে এবং খাওয়ার ইচ্ছে করলে রান্না ও ভুনা হয়ে হাজির হয়ে যাবে। (তাযকিরাহ কুরতুবি: ২/৪৮৫, ২/৫২০; মুসনাদ আহমদ: ৪/৩৬৭; ইবনে আবিদ্দুনয়া, সিফাতুল জান্নাত: ১০৫; তাফসির ইবনে কাসির: ৭/৪৯৮)
জান্নাতিদের খাবারদাবারে থাকবে বিভিন্ন পদ ও প্রকার। তাদের পান করতে দেওয়া হবে সুপেয় পানীয়, নেশাহীন শরাব। কোরআনে জান্নাতিদের খাবারদাবারের সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আমি তাদের দেব ফলমূল এবং মাংস, যা তারা চাইবে’ (সুরা তুর: ২১)। ‘সেখানে আছে ফলফলাদি, খেজুর ও আনার’ (সুরা আর রহমান: ৬৮)। ‘তাদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পরিবেশন করা হবে বিশুদ্ধ শুরাপূর্ণ পাত্রে, শুভ্র উজ্জ্বল, যা হবে পানকারীদের জন্য সুস্বাদু, তাতে ক্ষতিকর কিছু থাকবে না এবং তারা মাতালও হবে না।’ (সুরা আস-সাফফাত: ৪৫-৪৭)
জান্নাতবাসীদের অভ্যর্থনা ও সেবায় নিয়োজিত থাকবে বালক বা শিশু-কিশোররা। তাদেরকে ‘গিলমান’ ও ‘বিলদান’ বলা হয়েছে। আরবিতে ‘গিলমান’ শব্দটি ‘গোলাম’-এর বহুবচন এবং ‘বিলদান’ শব্দটি ‘ওয়ালাদ’-এর বহুবচন, দুটির অর্থই হলো বালক। এর বর্ণনায় পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘তাদের আশপাশে ঘোরাফেরা করবে চিরকিশোররা। পানপাত্র, জগ ও প্রবাহিত ঝরনার শরবতপূর্ণ পেয়ালা নিয়ে।’ (সুরা ওয়াকেয়া: ১৭-১৮)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তাদের সেবায় চারপাশে ঘুরবে বালকদল; তারা যেন সুরক্ষিত মুক্তা’ (সুরা তুর: ২৪)। ‘আর তাদের চারপাশে প্রদক্ষিণ করবে চিরকিশোররা; তুমি তাদের দেখলে বিক্ষিপ্ত মুক্তা মনে করবে।’ (সুরা দাহর: ১৯)
তবে, জান্নাতের সবচেয়ে বড় পুরস্কার হচ্ছে মহান আল্লাহর দর্শন। হাদিসে এসেছে, জান্নাতিরা যেই মুহূর্তে আল্লাহ তাআলাকে দেখবেন, তারা ইতোপূর্বের সকল নেয়ামতের কথা ভুলে যাবেন। অর্থাৎ আল্লাহর দিদারের তুলনায় সবকিছু ফিকে মনে হবে। ইতোপূর্বে তারা কল্পনাও করেনি যে মহান আল্লাহর দিদার এতটা সুখকর ও প্রশান্তিময় হতে পারে। (সহিহ মুসলিম: ৪৬৭)
আরও পড়ুন: জান্নাতিরা যে মুহূর্তে সকল নেয়ামত ভুলে যাবে
নারী-পুরুষ সব জান্নাতিকে আল্লাহ তাআলা তৃপ্ত করবেন, সন্তুষ্ট রাখবেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘সেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে যা কিছু তোমাদের মন চাবে এবং যা কিছু তোমরা ফরমায়েশ করবে। এগুলো পাবে ক্ষমাশীল পরম দয়ালুর পক্ষ থেকে আতিথেয়তাস্বরূপ’ (সূরা হা মিম সাজদা: ৩১)। আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘সেখানে রয়েছে যা কিছু মন চায় এবং যা কিছুতে নয়ন তৃপ্ত হয়। তোমরা সেখানে চিরস্থায়ী হবে।’ (সুরা যুখরুফ: ৭১)
গুণ ও বৈশিষ্ট্যের বিবেচনায় আল্লাহ তাআলা জান্নাতের যেসব নাম ব্যবহার করেছেন, সেখানে ৮টি নাম পাওয়া যায়। সেগুলো হলো- ১) জান্নাতুল ফিরদাউস, ২) জান্নাতুন নাঈম, ৩) জান্নাতুল মাওয়া, ৪) জান্নাতুল আদন, ৫) দারুস সালাম, ৬) দারুল খুলদ, ৭) দারুল মাকাম ও ৮) দারুল কারার।
চিরসুখের জান্নাতলাভের জন্য কোরআন-হাদিসে প্রতিযোগিতা করতে বলা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘দৌঁড়াও এবং একে অপরের চেয়ে অগ্রগামী হওয়ার চেষ্টা করো, তোমার রবের মাগফেরাতের দিকে এবং সেই জান্নাতের দিকে যার বিস্তৃতি আসমান ও জমিনের মতো। তা প্রস্তুত রাখা হয়েছে সে লোকদের জন্য যারা আল্লাহ ও তার রাসুলদের প্রতি ঈমান এনেছে। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ। যাকে ইচ্ছা তিনি তা দান করেন। আল্লাহ বড়ই অনুগ্রহশীল।’ (সুরা হাদিদ: ২১)
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে চিরসুখের জান্নাত ও মহান রবের সাক্ষাৎলাভের জন্য প্রয়োজনীয় সকল আমল যথাযথ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।