এক।
১৪ ফেব্রুয়ারি আজ। ঐতিহাসিক দিন- ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’। ইতিহাসে রক্তস্নাত এদিন, অথচ আমরা তা কতোটুকুই বা জানি। হয় সে অস্পষ্ট, ভঙ্গুর। অথবা প্রাসঙ্গিকতা ছেড়ে যায় তাকে। অপূর্ণ ইতিহাসচর্চার কারণে আজ প্রজন্মের সামনে ছাত্র সমাজের উজ্জ্বল দিনের কথা অস্পষ্ট।
বিজ্ঞাপন
দুই।
‘আজি দখিন-দুয়ার খোলা/এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত এসো...’-এভাবেই বসন্তকে আহ্বান করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই বসন্ত এসে গেছে। আহা! কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে।
বসন্তের পহেলা দিনই ছিল ছাত্রসমাজের জন্য এক কলঙ্কময় দিন। ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস হিসেবে পৃথিবীব্যাপি পরিচিত হলেও আমাদের দেশের ইতিহাসে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ১৯৮৩ সালের এদিন। কিন্তু খুব বিস্ময়ের বিষয়, সেই বছরের এই দিনে ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে ঢাকার রাজপথ, সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল-বুকের তাজা রক্ত ঢেলে।
গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয় তাদের-সেদিনের শহীদ দিপালী সাহা, জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল, আইয়ূব, কাঞ্চনসহ নাম না জানা অসংখ্য শহীদকে- ‘ভালোবাসার ফুল তাদের চরণে’। একে বলে-ফাগুনে আগুন। ভালোবাসার প্রাণ এই বাংলা। সেই ভালোবাসার কল্যাণেই এই মাটির ইতিহাস কখনোই ভুলবার নয়।
বিজ্ঞাপন
তিন।
১৯৮২ সালে বাংলাদেশে তৎকালীন সামরিক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খানের ঘোষিত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে। ছাত্রসমাজের দাবি ছিল একটি অবৈতনিক বৈষম্যহীন শিক্ষানীতি। কিন্তু ড. মজিদ খান যে নীতি ঘোষণা করেন, সেখানে বাণিজ্যিকীকরণ আর ধর্মীয় প্রতিফলন ঘটেছে বলে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন। তাই শুরু থেকেই ওই নীতির বিরোধিতা করতে শুরু করেন শিক্ষার্থীরা।
সে বছর ১৭ সেপ্টেম্বর ওই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের বিষয়ে একমত হয় ছাত্র সংগঠনগুলো। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৩ সালের ১১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বটতলায় সমাবেশ ও সচিবালয় অভিমুখে মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করে। সেদিন সকালে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী যখন বটতলায় সমবেত হয়েছে তখন কেন্দ্রীয় নেতারা অনিবার্য কারণবশত আজকের কর্মসূচি পালন করা যাবে না বলে সিদ্ধান্ত দেন। ছাত্র-ছাত্রীরা সেটি মানলেন না। সেদিনই বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের হাতে বটতলায় নেতারা লাঞ্ছিত হলেন। পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করা হলো ১৪ ফেব্রুয়ারি। সেই ১৪ ফেব্রুয়ারিতে বটতলায় সমবেত হয়েছিল জীবনবাজি রেখে সামরিক স্বৈরাচারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা।
ছাত্র-জনতার শত বছরের আকাঙক্ষা গণতান্ত্রিক অধিকার জনতার হাতে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মূলত সেই ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসের কর্মসূচিতে শামিল হয়। অকুতোভয় ও শেকলভাঙা ছাত্রসমাজ কার্জন হলের মুখে সামরিক জান্তার পুলিশের ব্যারিকেডের মুখে পড়ে। কিন্তু জান্তার কি সাধ্য সেই দুর্বার আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য মিছিলকে প্রতিহত করার!
হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ মিছিলটি হাইকোর্টের গেটের সামনে ব্যারিকেডের সামনে বসে পড়ে এবং ছাত্রনেতারা তারের ওপর উঠে বক্তৃতা শুরু করে। এসময় পুলিশ বিনা উসকানিতে তারের একপাশ সরিয়ে রায়ট কার ঢুকিয়ে দিয়ে রঙিন গরম পানি ছিটাতে থাকে, বেধড়ক লাঠিচার্জ, ইট-পাটকেল ও বেপরোয়া গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। গুলিবিদ্ধ হয় জয়নাল। এরপর গুলিবিদ্ধ জয়নালকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়।
এসময় দিপালীও গুলিবিদ্ধ হন এবং পুলিশ তার লাশ গুম করে ফেলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিহত ও আহতদের অ্যাাম্বুলেন্স পাঠিয়ে নিয়ে আসতে চাইলে ঘটনাস্থলে ঢুকতে দেয়নি পুলিশ। কিছু না ঘটা সত্ত্বেও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করা হয়েছে, এমন অপপ্রচার চালিয়ে সামরিক সরকার উস্কে দেয় পুলিশকে। ওইদিন নিহত হয়েছিল জয়নাল, জাফর, কাঞ্চন, দীপালীসহ আরও অনেকে। সরকারি মতেই গ্রেফতার করা হয় ১ হাজার ৩৩১ জন ছাত্র-জনতাকে, বাস্তবে এই সংখ্যা আরও বেশি ছিল। খোঁজ মেলেনি অনেকেরই।
এই ঘটনার জোয়ার লাগে চট্টগ্রাম শহরেও। মেডিক্যাল ও অন্যান্য কলেজের শিক্ষার্থীদের মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ ও গুলি চালালে নিহত হয় কাঞ্চন। ছাত্রদের তিনটি মৌলিক দাবিতে ১৮ ফেব্রুয়ারি শিক্ষানীতি স্থগিত হয়ে যায়।
সেই কারণেই ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির পর এটাই ছিল ইতিহাসে লিখে রাখার মতো ছাত্রবিক্ষোভের এবং নিপীড়নের ঘটনা।
এ কাঙিক্ষত আন্দোলন অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর স্বৈরাচারী এরশাদের পতন ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিজয় সূচনা করে। ৬ ডিসেম্বর এরশাদ আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হন।
চার।
১৯৯৩ সালে শফিক রেহমান বাংলাদেশে প্রবর্তন করেন ‘ভালোবাসা দিবস’। ‘যায়যায়দিন’খ্যাত সাপ্তাহিকে পরকিয়ার আখ্যান ‘দিনের পর দিন’কলামে ‘মিলা ও মইনের’ টেলিফোনে কথোপকথনের ভালোবাসার মূর্তরূপ ধারণ করে ১৪ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস বাংলাদেশে পালিত হয় তারুণ্যের হলুদাভ বস্ত্রের ও গাঁদা ফুলের মর্মর মিলনমেলার আচ্ছাদনে। নগর থেকে বন্দর রাজপথ থেকে শিক্ষাঙ্গন ছেয়ে যায় হলুদাভ ভালোবাসায়- ‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত’।
আজ আমরা যে ভালোবাসা দিবস পালন করছি এর পেছনে রয়েছে ইতিহাস। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মতপার্থক্যও রয়েছে। সে প্রায় সাড়ে সতের শত বছর আগে একজন রোমান ক্যাথলিক ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের কথা। সেই ইতিহাস আমাদের হয়তো কমই জানা। ফেব্রুয়ারিতে এই সময়েই শুরু হয় বসন্ত ঋতু। বসন্ত ফুল ফোটার সময় আর বসন্ত প্রেমের সময় বলে একটি কথা প্রচলিত আছে। ফুল আর প্রেম এগুলোর একটা ব্যাপার ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র একটা বন্ধন মনে মনে হলেও চলে আসে।
প্রিয়জনের প্রতি মানুষের ভালোবাসা থাকে অবিরাম। ফলে ভালোবাসা কোনো দিবস, মাস, বছর কিংবা কালে আবদ্ধ নয়। সব সময়ই থাকে প্রিয়জনের জন্য একরাশ ভালোবাসা। এটি সর্বজনীন। অথচ এই ভালোবাসা দিবসকে উপলক্ষ করে পুঁজিবাদী গোষ্ঠী সাধারণ জনগণের কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। পুঁজিবাদী গোষ্ঠীর বাণিজ্যিক কৌশলের প্রধান হাতিয়ার এ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। সেখানে সত্যিকারের ভালোবাসা কতটুকু আছে?
পাঁচ।
ইতিহাস সূর্যের আলোর মতো। সময়ের দূরবর্তীতে ইতিহাস তার নায়কদের প্রতিস্থাপন করে, আবার আদর্শিক জায়গায় ইতিহাস তার খলনায়কদের সরিয়ে নিতে ‘পিছপা’ হয় না। প্রজন্ম সেই সাক্ষ্য দেয় এবং দেবে। এটা হলো, ইতিহাসের মাজেজা। আখেরি, কোনো কোনো নায়ক সবসময় নায়কের অবতীর্ণ হতে পারে না। আজকের তারুণ্যকে জানতে হবে প্রিয়জনে ফুল ছড়িয়ে দেওয়া ভালোবাসার দিনটির আরেকটি অন্যরকম মহিমা আছে— বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে তারুণ্য-জাগানিয়া ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ বলে একটি দিন আছে। বিস্মরণের অতলে হারালেই কী ইতিহাসের ধ্রুব সত্যকে নিশ্চিহ্ন করা যায়?
জহির রায়হানের মতো বলতে চাই- ‘আসছে ফাগুনে আমাদের দ্বিগুণ হতে হবে।’
লেখক: সাংবাদিক