শনিবার, ১২ এপ্রিল, ২০২৫, ঢাকা

অর্থনৈতিক অঞ্চল ও বিনিয়োগের পরিবেশ

মো. মাঈন উদ্দীন
প্রকাশিত: ০৬ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:১১ এএম

শেয়ার করুন:

loading/img

এই মূহুর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় অনিশ্চয়তা হলো উৎপাদন খাতে। নানা রকম উদ্যোগের পরও সবচেয়ে বড় রপ্তানি শিল্প পোশাক খাতে উৎপাদনব্যবস্থা এখনো ভঙ্গুর রয়ে গেছে। ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের পূর্ব থেকেই সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুরের পোশাকশিল্প এলাকা শ্রমিক বিক্ষোভ দেখা গেছে।

সম্প্রতি পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও তা টেকসই হয়েছে কি না, সেটি এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। পোশাকশিল্পের মালিকদের সমিতি জানিয়েছে, তাদের উৎপাদন ও রপ্তানিতে যেমন ক্ষতি হয়েছে, তেমনই কিছু ক্রয়াদেশ অন্য দেশে চলে গেছে।


বিজ্ঞাপন


এদিকে দেশের রপ্তানিখাতকে বেগবান করার তৈরি করা হয়েছিল বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং অথরিটি অ্যাক্ট করা হয়। বাংলাদেশ রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য চীন, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডের অভিঙ্ঘতার ভিত্তিতে এক্সপোর্ট জোন করা হয়।

৪০ বছরে বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন অথরিটি (বেপজা) আটটি ইপিজেড করেছে ও এর আওতায় ২ হাজার ২৯০ একর জমি উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় এনেছে।

২০১০ সালে অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) প্রতিষ্ঠিত হয়।  এ পর্যন্ত বেপজার ইপিজেডগুলোতে ৩৮টি দেশ থেকে বিনিয়োগ এসেছে। সবচেয়ে বেশি এসেছে চীন থেকে। চীনের মোট ১০৮টি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ রয়েছে ইপিজেডে। এরপর বিনিয়োগ করেছে দক্ষিণ কোরিয়ার ৬১টি, জাপানের ২৯টি, ভারতের ১৯টি, যুক্তরাজ্যের ১৯টি, যুক্তরাষ্ট্রের ১৭টি ও শ্রীলঙ্কার ৭টি প্রতিষ্ঠান।

বর্তমানে আটটি ইপিজেড ও বেপজার অর্থনৈতিক অঞ্চলে মোট ৪৪৯ শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে। এর মধ্যে শতভাগ বিদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ২৫৮টি, যৌথ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ৪৯টি ও শতভাগ দেশীয় প্রতিষ্ঠান ১৪২টি।


বিজ্ঞাপন


ইপিজেডগুলোতে   বৈশ্বিক ও দেশের অভ্যন্তরীণ নানা কারণে গত ছয় মাসে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২২ শতাংশ কমে গেছে।   বিনিয়োগ যেকোনো দেশের শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উন্নতির একটি বড় বিষয়। দেশের অর্থনীতি নানা রকম চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। শিল্প, ব্যবসা, বিনিয়োগ-সব কিছুই যেন তার স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলছে। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকিং খাতের ওপর মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।

এদিকে সরকারের ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইজেড) প্রতিষ্ঠার কথা থাকলেও আপাতত পাঁচটি অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইজেড) নিয়ে ভাবছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। এ পাঁচটি অঞ্চলে আগামী দুই বছরের মধ্যে পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং সড়ক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথা রয়েছে।

জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর), শ্রীহট্ট ইজেড, জামালপুর ইজেড, মহেশখালীর ইজেড ও জাপানি ইজেড– এই পাঁচটির সড়ক ব্যবস্থা, পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সেবা নিশ্চিত করতে সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে।

আরও জানা গেছে, চট্টগ্রামের আনোয়ারায় প্রস্তাবিত চীনের অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ আট বছরের বেশি সময় ধরে স্থবির। অর্থনৈতিক অঞ্চলটিতে বিপুল বিনিয়োগের সম্ভাবনা থাকলেও এখন পর্যন্ত এর প্রকল্প প্রণয়ন (ডিপিপি) ও ডেভেলপারের সঙ্গে চূড়ান্ত চুক্তি (ডেভেলপার অ্যাগ্রিমেন্ট) হয়নি। তবে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরকে কেন্দ্র করে চীনের অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে হঠাৎ তোড়জোড় শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)  থেকে জানা গেছে, গত এক মাসের মধ্যে অর্থনৈতিক অঞ্চলটির ডিপিপি তৈরি ও ডেভেলপার নিয়োগ নিয়ে কাজ অনেকটা এগিয়েছে।  তবে সম্পূর্ণ কাজ শেষ হতে আরও দুই থেকে তিন মাসের মতো সময় লাগতে পারে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠিত হয়েছে তার সুফল এখনো কাঙিক্ষত হারে দেখা যাচ্ছে না। অর্থনীতি অঞ্চলগুলোতে নানা সমস্যা বিরাজমান।

অবকাঠামো গত সমস্যা, বিদ্যুৎ গ্যাস ও জ্বালানি সমস্যাতো রয়েছেই। এছাড়া দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ব্যবসা শুরু করার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। এসব এলাকায়  শ্রমিকদের আবাসন এখনো গড়ে ওঠেনি।

বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অবকাঠামোসহ প্রণোদনা পান না। বিদেশিরা এসে যেন যেন কারখানা স্থাপন করতে পারেন, সেটা  দেখার দায়িত্ব রয়েছে বেজার।

একাধিক অফিসে যেন বিনিয়োগকারীদের যেতে না হয়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। বেজার কার্যক্রম ডিজিটালাইস করতে হবে।  এ ছাড়া আশুলিয়াসহ যেসব এলাকায় কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে সেসব এলাকার বেকার  শ্রমিকদের পুনর্বাসন, কাজে নিয়োজিত করতে অর্থনীতি অঞ্চল গুলোকে ব্যবহার করা যেতে পারে।   এদিকে এসব অঞ্চলে বিনিয়োগের পরিবেশ নিয়েও চিন্তা করা উচিত।

তবে বাংলাদেশে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতাকে সবচেয়ে বড় সমস্যা বা ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। তবে এসব ঝুঁকি সত্ত্বেও সস্তা শ্রম ও বাজার সুবিধার কথা বিবেচনায় বাংলাদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণের আগ্রহ দেখিয়েছেন জাপানসহ অধিকাংশ বিদেশি ব্যবসায়ী গ্রুপ।

পত্রিকার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, গত বছরের আগস্ট–সেপ্টেম্বরে পরিচালিত এক জরিপে বাংলাদেশে কাজ করা ১৭৫টি জাপানি কোম্পানি তাদের মতামত দিয়েছে।

জরিপে দেখা যায়, ২০২৪ সালে এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বেশিরভাগ দেশে জাপানি কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক আস্থা বেড়েছে এবং মুনাফারও উন্নতি হয়েছে।

জরিপ থেকে আরও জানা যায়, জাপানি ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে  পাঁচটি বড় সুবিধা থাকার কথা বলেছেন, তার মধ্যে আছে সস্তা শ্রম, বাজার সম্ভাবনা, শ্রমিক ও কর্মচারীর সহজপ্রাপ্তি, ভাষাগত সুবিধা, করছাড় ও প্রণোদনাসুবিধা এবং বিশেষায়িত জনশক্তি। এগুলো নিঃসন্দেহে ইতিবাচক এবং বাংলাদেশ এই সুবিধা নিতে পারে অনায়াসে।

গত জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় থেকে দেশে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা রয়েছে এবং নতুন সরকারের বৈদেশিক নীতিরও কিছু পরিবর্তন হয়েছে। এসব বিষয় বিদেশি বিনিয়োগ কারীরা পর্যবেক্ষণ করছেন। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, ব্যবসা শুরুর অনুকূল পরিবেশ যত তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে ততই অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের সুযোগ তৈরি হবে। অর্থনীতির চাকা গতিশীল হবে।

ব্যবসার পরিবেশ ও বিশেষায়িত অঞ্চলে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছাই যথেষ্ট। বহু বছর ধরে ব্যবসা–বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে ওয়ান–স্টপ সার্ভিসের কথা শোনা গেলেও বাস্তবে তেমন অগ্রগতি হয়নি। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক সরকার ব্যবসায়ীদের সামনে প্রতিশ্রুতির মুলা ঝুলিয়ে বছরের পর বছর পার করেছে।

তবে অন্তর্বর্তী সরকার এ ক্ষেত্রে সাহসী ও কার্যকর পদক্ষেপ নেবে এ প্রত্যাশা সকলের। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফর উপলক্ষে চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ সকল অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজের গতি ফিরে আসবে বলে অনেকে ধারণা করছেন।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ব্যাংকার।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন